ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ, প্রক্টর, ছাত্র-উপদেষ্টা ও প্রভোস্ট কাউন্সিলের সভাপতিকে গালিগালাজ ও কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করার অভিযোগ উঠেছে শাখা ছাত্রদলের তিন নেতার বিরুদ্ধে। গতকাল মঙ্গলবার রাতে শাখা ছাত্রদলের সদস্য রাফিজ আহমেদের ব্যক্তিগত ফেসবুক আইডি থেকে লাইভে এসে এসব মন্তব্য করা হয়। অভিযুক্ত তিন নেতা হলেন, শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক সাহেদ আহমেদ, সদস্য রাফিজ আহমেদ ও নুর উদ্দিন।
জানা গেছে, গতকাল মঙ্গলবার রাতে মহান বিজয় দিবস এবং ২০১৮-১৯ ও ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীদের বিদায় উপলক্ষে উম্মুল মুমিনীন আয়েশা সিদ্দিকা হল কর্তৃপক্ষ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও আলোচনা সভার আয়োজন করে। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. নকীব মোহাম্মদ নসরুল্লাহ, কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. জাহাঙ্গীর আলম, প্রক্টর অধ্যাপক ড. শাহীনুজ্জামান, ছাত্র উপদেষ্টা অধ্যাপক ওবায়দুল ইসলাম ও প্রভোস্ট কাউন্সিলের সভাপতি অধ্যাপক ড. জালাল উদ্দিনসহ অন্যরা। তবে নির্ধারিত সময়ের চেয়ে দেরিতে অনুষ্ঠান শেষ করায় পাশের হলগুলোর শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটতে থাকে।
এ বিষয়ে প্রতিবাদ জানাতে শাখা ছাত্রদলের সদস্য রাফিজ আহমেদ ফেসবুক লাইভে আসেন। এ সময় অভিযুক্ত তিন নেতা সংশ্লিষ্ট হলের সামনে অবস্থান নেন। লাইভে রাফিজ আহমেদ অভিযোগ করেন, এর আগে ফুটবল মাঠে আয়োজিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পড়াশোনা ব্যাঘাত ঘটার অযুহাতে প্রশাসন বন্ধ করে দিলেও এদিন রাত সাড়ে ১১টা পর্যন্ত প্রশাসনের উপস্থিতিতে উচ্চ শব্দে গান বাজানো হয়েছে।
পরে অনুষ্ঠান চলাকালে গাড়ি নিয়ে সংশ্লিষ্ট হল থেকে বেরিয়ে যান উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ, প্রক্টর ও ছাত্র উপদেষ্টা। এ সময় শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক সাহেদ আহমেদ বলেন, ‘‘লুচ্চামি করে বেড়াচ্ছে। আরেক সমুন্ধি কথায় কথায় আল্লাহর কিরা বলে। ফাঁক্কা হুজুর! সোমবার-বৃহস্পতিবার রোজা রাখে।”
পরে আহ্বায়ক সাহেদ প্রক্টরকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “লুচ্চামি বন্ধ করেন, আসেন গল্প করি। বউ রেখে লুচ্চামি করতে সুবিধা হয়। মানুষ মনে করে বউ আছে। প্রক্টর কই, প্রক্টর? প্রক্টরের সমস্যা হচ্ছিল ফুটবল মাঠের অনুষ্ঠানে? ছাত্র উপদেষ্টা কই? এরা সারাদিন নামাজ-কালাম-রোজা করে, আর রাতের বেলায় লুচ্চামি করে বেড়ায়!”
এরপর প্রভোস্ট কাউন্সিলের সভাপতি অধ্যাপক ড. জালাল উদ্দিন হল থেকে বের হওয়ার সময় তাকে উদ্দেশ্য করে সাহেদ আহমেদ বলেন, “এ শুয়োরের বাচ্চারে ধর। এসব শুয়োরের বাচ্চা। জালাল শুয়োরের বাচ্চা! জামায়াতি-বিএনপি শুয়োরের বাচ্চারা বেশি করে!”
এ সময় ছাত্রদলের সদস্য রাফিজ আহমেদ লাইভে বলেন, “এখন সময় ১১টা ০৬ মিনিট। উম্মুল মুমিনীন আয়েশা সিদ্দিকা হল থেকে প্রশাসনের উপাচার্য ও ট্রেজারারের গাড়ি বের হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন সব তাফসীরুল-কারক মনোরঞ্জন করতেছে। এখন এখানে পড়াশোনার কোনো ক্ষতি হচ্ছে না! এরপর আল-কুরআন বিভাগের অধ্যাপক ড. এবিএম জাকির হোসেন হল থেকে বের হওয়ার সময় রাফিজ লাইভে তাকে প্রশ্ন করেন, “স্যার, প্রোগ্রাম কেমন হলো?” জবাবে অধ্যাপক ড. জাকির হোসেন বলেন, “অসাধারণ।”
পরে রাফিজ জানতে চান, অনুষ্ঠানে কারা কারা উপস্থিত ছিলেন। উত্তরে তিনি বলেন, “ভিসি স্যার ও ট্রেজারার স্যারসহ অন্যরা ছিলেন।”
এ সময় রাফিজ বলেন, “আচ্ছা, সবাই কর্তব্যরত ব্যক্তি, সবাই তো তাফসীরুল কারক। সবাই নামাজ-কালাম করেন। আল-কুরআনের স্যাররা, আপনারা মেয়েদের যে ডিস্টার্ব করছেন! স্যার, অনেক শিক্ষার্থীর পরীক্ষা আছে। এখানে কি তাদের কোনো সমস্যা হচ্ছে না?”
এরপর প্রভোস্ট কাউন্সিলের সভাপতি অধ্যাপক ড. জালাল উদ্দিন হল থেকে বের হওয়ার সময় তাকে উদ্দেশ্য করে রাফিজ বলেন, “ড. জালাল স্যার হল থেকে মনোরঞ্জন করে বের হচ্ছেন। তিনি আবার সিন্ডিকেট সদস্য। স্যার, খুবই মনোরঞ্জন করে খুবই তৃপ্তি পেয়েছেন মনে হচ্ছে!”
এ সময় রাফিজ অধ্যাপক জালাল উদ্দিনকে প্রশ্ন করেন,“স্যার, ফুটবল মাঠের অনুষ্ঠানের কারণে সাদ্দাম হলের পরীক্ষার্থীদের সমস্যা হচ্ছিল। ওইখানে অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে।”
সবশেষে তিনি প্রক্টরকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “এখন সময় ১১টা ১৬ মিনিট। এখনো প্রক্টর ও ছাত্র উপদেষ্টাকে দেখতে পাচ্ছি না। তারা হয়তো এখনো মনোরঞ্জনে ব্যস্ত আছেন।”
লাইভ চলাকালে আরেক সদস্য নুরউদ্দিন অধ্যাপক ড. জালাল উদ্দিনকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘জামাতি-বিএনপিকে আগে ধরতে হবে। প্রক্টরকে উদ্দেশ্য করে নুর উদ্দিন বলেন, তারা এখনও রঙ্গলিলায় ব্যস্ত আছে।’
এ বিষয়ে শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক সাহেদ আহমেদ বলেন, “যে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে, তার জন্য আমি দুঃখ প্রকাশ করছি।”
অপর সদস্য রাফিজ আহমেদ বলেন, “আমার লাইভটি ছিল বৈষম্যের বিরুদ্ধে। কারণ এর আগে ফুটবল মাঠের অনুষ্ঠান শিক্ষার্থীদের আপত্তির অজুহাতে প্রশাসন বন্ধ করে দেয়। অথচ ওই হলে রাত সাড়ে ১১টা পর্যন্ত প্রশাসনের উপস্থিতিতে উচ্চ শব্দে গান বাজানো হয়েছে। এতে পাশের হলগুলোর শিক্ষার্থীরা অসুবিধার মুখে পড়ে। মূলত আমাদের উদ্দেশ্য ছিল প্রশাসনের বৈষম্যমূলক আচরণের প্রতিবাদ জানানো। এর মধ্যে যদি কোনো অপ্রীতিকর ভাষা ব্যবহার হয়ে থাকে, সে জন্য আমি দুঃখ প্রকাশ করছি।”
এ বিষয়ে জানতে অভিযুক্ত নুর উদ্দিনকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তার মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপিপন্থী এক অধ্যাপক বলেন, “জিয়া পরিষদের একটি পক্ষের প্ররোচনায় তারা এসব কথা বলতে পারে। ওই পক্ষ দীর্ঘদিন ধরে প্রশাসনকে অসহযোগিতা করে আসছে। সর্বশেষ সিন্ডিকেট সদস্য নিয়োগ সংক্রান্ত ঘটনাকে কেন্দ্র করেই এসব পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। মূলত এটি চাওয়া-পাওয়ার বিষয়। এ বিষয়কে কেন্দ্র করেই তারা এমন আচরণ করেছে”
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. শাহীনুজ্জামান বলেন, “বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক ও কষ্টদায়ক। অনুষ্ঠান দেরিতে শেষ হওয়ার বিষয়টি হলের প্রভোস্ট অবগত ছিলেন, কারণ এটি একান্তই হল কর্তৃপক্ষের বিষয়। অতিথিদের অন্য হলে কর্মসূচি থাকায় ওই অনুষ্ঠানে যেতে কিছুটা দেরি হয়। তবে হল কর্তৃপক্ষ চাইলে অতিথিরা যাওয়ার আগেই অনুষ্ঠানের কিছু অংশ শেষ করতে পারত।”
প্রভোস্ট কাউন্সিলের সভাপতি অধ্যাপক ড. জালাল উদ্দিন বলেন, “সমালোচনা করার অধিকার সবারই আছে। তবে মানুষ হিসেবে কোন ভাষায় তা করা হবে, সেটি তার পারিবারিক শিক্ষা ও ব্যক্তিবোধের ওপর নির্ভর করে। খুবই বাজে একটি ইস্যুকে বেশি গুরুত্ব দিতে চাই না। তারা কেন আমাকে ‘জামায়াতি’ বলছে, সেটা তারাই জানে। আমার কোনো কার্যক্রম কি জাতীয়তাবাদী স্বার্থের বাইরে গেছে?”
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, “ছাত্র হিসেবে তারা যে মন্তব্য করেছে, সেটি তাদের বিবেকের ওপর ছেড়ে দিলাম। এ বিষয়ে আমি আর কোনো মন্তব্য করতে চাই না।”
অনুষ্ঠান দেরি শেষ হওয়ার বিষয়ে হলটির প্রভোস্ট অধ্যাপক এ.কে. এম. ড. রাশেদুজ্জামান বলেন, “আমরা অনুষ্ঠানটি সাড়ে আটটার মধ্যে শেষ করতে চেয়েছিলাম। তবে আমন্ত্রিত অতিথিরা দেরিতে আসায় অনুষ্ঠান শেষ হতে দেরি হয়। পরবর্তীতে যেন এমন পরিস্থিতি না ঘটে, সে বিষয়ে প্রভোস্ট কাউন্সিলের সভায় দাবি জানাব। আমরাও চাই, এ ধরনের অনুষ্ঠানগুলো রাত সাড়ে আটটার মধ্যেই শেষ হোক।”
সালাউদ্দিন/সাএ
সর্বশেষ খবর