স্ত্রীর চিকিৎসার টাকার জন্য মাকে জবাই করেন ছেলে! 

প্রকাশিত: ২৮ নভেম্বর ২০১৬, ০৪:০৫ পিএম

অস্বাভাবিক নির্মমতা। মৃত্যুপথযাত্রী মা। আশি-ঊর্ধ্ব শরিফুন্নেছা। স্ত্রীর জন্য এই বৃদ্ধা মাকেই জবাই করে খুন করলো নিজ সন্তান পাষণ্ড রফিকুল ইসলাম বাবু (৪৫)। সঙ্গে ছিল দু’সহযোগী। স্ত্রীর বড় ভাই জাহিদ আসলাম বাবু (৪৫) ও নিজের বাসার ভাড়াটিয়া বন্ধু শওকত আলী (৪৬)। টাকার জন্যই এই নির্দয় হত্যাকাণ্ড। পরিস্থিতিও মর্মান্তিক। হাসপাতালে স্ত্রীর সেবা-যত্নের পর বাসায় ফিরেই মাকে জবাই। গত ১৬ই নভেম্বর রাতে মিরপুরের পল্লবী থানাধীন ১০ নম্বর সেকশনের এ-ব্লকের ১ নম্বর এভিনিউয়ে নিজের ছয়তলাবিশিষ্ট ৪৪ নম্বর বাসার তৃতীয় তলায় ঘটে এই হত্যাকাণ্ড। স্ত্রীর প্রতি বিকৃত ভালোবাসার কাছে জন্মদাত্রী মমতাময়ী মাতৃত্বের করুণ পরাজয়।

খুনের পর অপরাধ ঢাকতে বাবু নানা নাটকীয়তার আশ্রয় নেয়। প্রথমে নিজে বাদী হয়ে পল্লবী থানায় দু’আইনজীবী পাঠিয়ে মামলা দায়ের করে। কিন্তু সন্দেহভাজন নেই উল্লেখ করে। আবার তদন্ত ও রহস্য উদঘাটনে অনীহা দেখায়। খুনের পর থেকে অসুস্থতার ভান করে নানা কৌশলে এড়িয়ে যাচ্ছিলো মায়ের দাফন-কাফন ও মামলায় নিজের দায়িত্ব ও আনুষ্ঠানিকতা। সে চেষ্টা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ঘটনার এক সপ্তাহ পর গত বুধবার গ্রেপ্তার হলো তার সহযোগী জাহিদ। এরপর উদঘাটন হয় রহস্য। পরদিন সে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। এতে সে ঘটনার লোমহর্ষক বর্ণনা দেয়। জানায় তারা তিনজন কিভাবে অসহায় বৃদ্ধার জীবননাশ করে। এরপর গত বৃহস্পতিবার গ্রেপ্তার হয় বাবু নিজে এবং তার ছোট বেলার বন্ধু ও বাসার নিচ তলার ভাড়াটিয়া শওকত আলী।

শুরু থেকে ঘটনার তদন্তকারী কর্মকর্তা পল্লবী থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) ফারুকুজ্জামান মল্লিক বলেন, প্রথম থেকেই শোকাহত ও অসুস্থতার ভান করে বাবু দাফন ও মামলার কার্যক্রমগুলো এড়িয়ে যাচ্ছিল। নিজে বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা দুর্বৃত্তদের আসামি করে থানায় মামলা দায়ের করে। কিন্তু সন্দেহভাজন নেই উল্লেখ করে তদন্ত ও রহস্য উদঘাটন না করতে তদবির করে যাচ্ছিল। তারপরও তার ওপর সন্দেহ হচ্ছিল না। অন্যদিকে খুনের পর জাহিদ কিছুটা আত্মগোপনে থাকায় তাকে সন্দেহ হয়। গুপ্তচর লাগিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করতে হয়। সে গ্রেপ্তার হওয়ার পর আদালতে দেয়া ১৬৪ ধারার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে কেন কিভাবে বৃদ্ধা মাকে খুন করেছে তার বর্ণনা দেয়। এরপর বাবু ও শওকতকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নেয়া হয়।

জাহিদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি এবং পুলিশ সূত্রে জানা যায়, ২০০৬ সালে প্রেমের বিয়ের পর থেকে নিঃসন্তান বাবু-লকেট (৩৫) দম্পতি। গত নভেম্বর থেকে টেস্টটিউব বেবি নেয়ার জন্য পাশের দেশ ভারতে গিয়ে চিকিৎসা করে আসছিলো। এ জন্য খরচ হয় ২০ লাখ টাকার বেশি। এক ভাগ্নে থেকে ধার করে ১ লাখ টাকা। অপর একটি প্রতিষ্ঠান থেকে ২ লাখ টাকা। আরো বিভিন্ন জনের কাছ থেকে ধার করে বিভিন্ন অঙ্কের টাকা। এরপরও স্ত্রীর ব্যয়বহুল চিকিৎসায় খরচের টান পড়ে। তাছাড়া, নিজের নানা সমস্যায়ও ধার-দেনা বাড়ে। তবে বৃদ্ধ মা শরিফুন্নেছার মিরপুরের সেনপাড়াস্থ অগ্রণী ব্যাংক শাখার একাউন্টে ১৫ লাখ ২২ হাজার টাকা ছিল। নিজের স্ত্রীর চিকিৎসার খরচ মেটাতে বেশ কিছুদিন ধরে মায়ের ওই টাকার জন্য চাপ দিচ্ছিল। মা তাকে টাকা দিতে রাজি না হওয়ায় ঘটনার কয়েকদিন আগে তাকে খুন করার পরিকল্পনা করে। এরই মধ্যে স্ত্রী গত ১২ই নভেম্বর লালমাটিয়ায় অবস্থিত সিটি হাসপাতালে এক কন্যা সন্তানের জন্ম দেয়। চিকিৎসার জন্যও টাকার প্রয়োজন। ঘটনার দিন ১৬ই নভেম্বর দুপুরে বাবু বাসা থেকে হাসপাতালে যায়। তখন রাস্তায় দেখা হয় জাহিদের সঙ্গে।

তখন বাবু বলে রাত ১১টায় বাসায় দেখা করবি। কাজ আছে। এরপর সে স্ত্রীর কাছে হাসপাতালে চলে যায়। সেখানে রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত ছিল। স্ত্রীর জন্য ওষুধপথ্য কিনে দেয়। সেবা-যত্ন করে। এরপর হাসপাতাল থেকে বাবু বাসার দিকে যায়। বাসায় ওঠার সময় নিচ তলার ভাড়াটিয়া ছোট বেলার বন্ধু শওকতসহ বাবু তৃতীয় তলায় উঠে। কথামতো রাত সাড়ে ১১টায় একই বাসায় উঠে জাহিদ। তারপরই মায়ের উপর উত্তেজিত বাবু বৃদ্ধ মা শরিফুন্নেছাকে জোরে গলা ধাক্কা দেয়। এতে তিনি ছিটকে গিয়ে বাথরুমের দেয়ালে আছড়ে পড়ে মেঝেতে পড়ে যান। অচেতন হয়ে পড়েন। তারপর বাবু বলে ‘খালাস করেন। পা ধরেন।’ পরে জাহিদকে ধমক দিয়ে বলে, ‘পা ধর’।

তখন জাহিদ দু’পা চেপে ধরে। শওকত গলায় ছুরির পোঁচ দিয়ে গলা কাটে। এরপর ছুরি বাবু নিয়ে নেয়। একটি আলমারির পেছনে ফেলে রাখে। তারপর বলে এখন আপনারা ‘সেইফ হন। চলে যান।’ তারপর জাহিদ আগে কক্ষ থেকে বের হয়। এরপর বের হয় শওকত। হত্যাকাণ্ডের বেশ কিছুক্ষণ পর রাত ১২টার দিকে বাবু ওই ঘরে ‘আমার মাকে কারা খুন করেছে’ বলে কেঁদে উঠে। লোকজনকে শুনানোর উদ্দেশ্যে বিলাপ জুড়ে দেয়। তা শুনে আশেপাশের লোকজন ওই বাসায় ভিড় জমায়। পুলিশ এসে রাতেই লাশ উদ্ধার করে। তখন রক্ত কিছুটা জমাট বেঁধে যায় বলে জানান মামলার তদন্ত কর্মকর্তা।

জানা যায়, নিহত শরিফুন্নেছার স্বামী মুক্তিযোদ্ধা ও সেনাবাহিনীর সাবেক হাবিলদার মহব্বত আলী ২৫ বছর আগে ১৯৯১ সালে মারা যান। তার ৩ ছেলে ও ২ মেয়ে। বড় ছেলে মাহবুব আল ইসলাম অস্ট্রেলিয়ায় সিডনিতে থাকেন। অপর ছেলে মজিবুর রহমান থাকেন মালয়েশিয়ায়। তিনি ঘটনার কিছুদিন আগে অসুস্থ অবস্থায় দেশে ফিরে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। ঘটনার সময় তার অপর মেয়ে স্কুল শিক্ষিকা মেহেরুন্নিছা মিনি ছিলেন ভারতে। আরেক মেয়ে মনোয়ারা বেগম থাকেন রাজধানীর জামালকোট এলাকায়। রাজধানীতে তাদের বেশ কিছু জায়গা-সম্পত্তি ছিল। অনেক আগেই তা ভাগ হয়ে গেছে। আর বৃদ্ধা মা শরিফুন্নেছা থাকতেন দেশে থাকা একমাত্র ছেলে বাবুর কাছে। ওই বাসায় তিন তলার ফ্ল্যাটে বাবু ও তার মা থাকতেন।

চতুর্থ তলায় থাকতো বাবুর শাশুড়ি ও শ্বশুর বাড়ির এক নারী। কিন্তু বাবুর স্ত্রী তৃতীয় তলায় থাকেন না। থাকেন চতুর্থ তলায় নিজের মায়ের সঙ্গে। শাশুড়ি তৃতীয় তলায় থাকলেও তার দেখাশুনা করতো না। উল্টো তার সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদ করতো। বাবু অবশ্য থাকতো মায়ের সঙ্গে একই ফ্লোর তথা তৃতীয় তলায়। আর খুনের সহযোগী তার সমন্ধি জাহিদের বাসা ও গ্রিলের দোকান মিরপুর ৫ নম্বর এভিনিউতে হলেও প্রায় সময় এ বাসায় মায়ের কাছে আসা-যাওয়া করতো। নিচ তলায় থাকতো বাবুর বন্ধু শওকত। বাবু নিজে কিছু করতো না। মাসে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা বাড়ি ভাড়া পেতো। তাই দিয়ে সে চলতো। প্রায় একযুগ আগে বিয়ে করলেও দীর্ঘ দিন লকেটের গর্ভে কোনো সন্তান আসে নি। এ জন্য বাবু ভারতে ব্যয়বহুল চিকিৎসা করে আসছিল। তাছাড়া, সে বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গেও অনৈতিক কাজকর্মে টাকা উড়াতো। আরো একাধিক কারণে সে দেনায় পড়ার পর থেকে টাকার জন্য মাকে চাপ দিচ্ছিল। বেশ কয়েকমাস আগেও তার মা তাকে ৬ লাখ টাকা দেন। এর আগে ওই বাড়ি নির্মাণের সময় দেন আড়াই লাখ টাকা।

তারও আগে দফায় দফায় তাকে টাকা দেয়া হয়। মা তার অন্য সন্তানদের টাকা দিয়েছিলেন। সমপ্রতি ছেলের চাপে মা ভারত ভ্রমণে যাওয়া ছোট মেয়ে মিনির কাছে ব্যাংকের চেক রয়েছে বলে জানিয়েছিলেন। মাকে খুন করার কিছুক্ষণ আগে বৃদ্ধা মা ও বাসার দারোয়ান রাকিব (২২) এক সঙ্গে রাতের খাবার খান। এরপর দারোয়ান নিচে নামে। তারপর ছেলে বন্ধুকে নিয়ে বাসায় উঠে। এরপরই ঘটে মাতৃহত্যার ওই হৃদয়বিদারক ঘটনা। ঘটনার পরদিন বাবু বাদী হয়ে মামলা দায়ের করলেও গত ২৩শে নভেম্বর জাহিদ গ্রেপ্তার ও আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়ার পরই অন্যদিকে মোড় নেয় মামলা। বাদী নিজেই খুন করার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ায় মামলাটি পরিচালনায় আইনি জটিলতা সৃষ্টি হয়। পরে ওই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই ফারুকুজ্জামান মামলাটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়ে দেন। তারপর গত ২৫শে নভেম্বর তিনি নিজে বাদী হয়ে একই থানায় ওই তিনজনকে আসামি করে অপর একটি হত্যামামলা করেন। এতে প্রধান আসামি করা হয়েছে বাবুকে। দ্বিতীয় আসামি শওকত আলী এবং তৃতীয় জাহিদ।

আদালতে স্বীকারোক্তি দেয়ার পর থেকে জাহিদ কেরানীগঞ্জে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রয়েছে। গত দু’দিন ধরে রিমান্ডে রয়েছে প্রথম ও দ্বিতীয় আসামি বাবু ও শওকত। বাবুর ছোট বেলার বন্ধু শওকতও মিরপুর এলাকার বাসিন্দা। তার পিতার নাম মৃত কাওসার আলী। আর বাবুর সমন্ধি চুয়াডাঙ্গা জেলার জীবননগর থানার দেহাটি গ্রামের মৃত আবুল কাশেমের ছেলে।

পল্লবী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. দাদন ফকির বলেন, স্ত্রীর চিকিৎসার খরচ ও ঋণের টাকার জন্য অপর দুই সহযোগী নিয়ে নিজের বৃদ্ধা মাকে খুন করলো বাবু। তার সমন্ধি তা আদালতে স্বীকার করেছে। ঘটনার রহস্যও পুরোপুরি উদঘাটন হয়েছে।-মানবজমিন।

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: