গরম পানিতে চুবিয়ে রেখে মিথ্যা স্বীকারোক্তি আদায়

প্রকাশিত: ০৫ ডিসেম্বর ২০১৬, ০৪:১০ পিএম

ঢাকা: বিনা বিচারে বন্দি চার আসামির সঙ্গে কথা বলে তাদের গ্রেফতারের পর নির্যাতনের ভয়ংকর বর্ণনা উঠে এসেছে। এদের মধ্যে আটক চাঁন মিয়াকে গরম পানিতে চুবিয়ে খুনের সঙ্গে জড়িত থাকার স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়।

শ্যামপুর থানার ওসি শংকর বাবু রিমান্ডে এনে তাকে যেভাবে নির্যাতন করেন, সেই বিভীষিকা ১৭ বছর ধরে তাড়িয়ে বেড়ায় চাঁন মিয়াকে। নির্যাতনের ক্ষত এখনও বয়ে বেড়াচ্ছেন শরীরে।

সদ্য বিয়ে করা স্ত্রীর কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় মকবুল হোসেনকে। ঢাকার উত্তরায় রং মিস্ত্রির কাজ করতেন তিনি। কেন কী কারণে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করেছে জানতে পারেননি এখনও। জেলে যাওয়ার পর খবর পেলেন স্ত্রী অন্যত্র বিয়ে করে চলে গেছেন।

গ্রেফতার হওয়ার পর এক এক করে তিন ভাইকে হারান কুমিল্লার বিল্লাল হোসেন ওরফে ইসমাইল। সেন্টু কামাল কিংবা বিল্লাল হোসেনেরও রয়েছে কারা নির্যাতনের দুঃসহ স্মৃতি।

রোববার হাইকোর্টে তাদের হাজির করা হলে যুগান্তরের সঙ্গে আলাপচারিতায় নিজ জবানীতে তুলে ধরেন দুঃসহ বন্দি জীবনের নানা কাহিনী। তাদের চোখে মুখে এখনও আতংক। কারামুক্তির পর কী করবেন, কোথায় যাবেন বলতে পারছেন না কেউ।

মকবুল হোসেন (৩৮) বলেন, ‘গ্রামের বাড়ি মাদারীপুরের বাদুড়পুর গ্রামে। বাবা ছিল দিনমজুর। মা এ-বাড়ি ও-বাড়ি কাম করত। আমি ঢাকার উত্তরা এলাকায় রংমিস্ত্রির কাজ করতাম। মাত্র আয়-ইনকাম শুরু করছি। বিয়াও করছিলাম বছরখানেক হয়। এক রাইতে হঠাৎ দরজায় ঠক ঠক আওয়াজ। দরজা খুইলা দেহি পুলিশ! কিছুই বুইঝা উঠতে পারলাম না। আমার বউ হাউমাউ কইরা জড়াইয়া ধরল। কইল, আমার স্বামী কিচ্ছু করে নাই। ওরে নিয়েন না। কোনো কথা শুনল না। আমারে পুলিশ টেম্পোতে তুইলা নিল। কই থ্যিকা কই নিল বুঝলাম না।'

তিনি বলেন, ' চাইর দিন পর কোর্টে তুলল আমারে মার্ডার কেইসের আসামি হিসেবে। আমার মা-বাপ নাই। কোনো উকিলও ধরতে পারি নাই। কাশিমপুর জেলে যাওনের মাসখানেক পর হুনলাম আমার স্ত্রী অন্য জায়গায় বিয়া কইরা চইলা গেছে। এহন কই থাহে জানি না। দুই ভাই, দুই বোন কে কোথায় আছে জানি না সেইটাও।’ জেল থেকে ছাড়া পেলে কোথায় যাবেন- জানতে চাইলে মকবুল দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, ‘কই আর যামু! এহনো কিছু চিন্তা করি নাই। আমার তো দুনিয়াত কেউ নাই!’

বিল্লাল হোসেন (৩০) ওরফে ইসমাইল বলেন, ‘কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় আগের বাড়ি। তেজগাঁও এলাকায় চাকরি করতাম। কিছু টাকা জোগাড়র কইরা এক সময় কারওয়ান বাজার এলাকায় কাঁচামাল বেচা-বিক্রি শুরু করি। ২০০২ সালের ঘটনা। কথা নাই, বার্তা নাই পুলিশ আমারে ধইরা লইয়া গেল। আমরা ৫ ভাইবোন। আমি চার নম্বর। অন্য ভাইয়েরা কেউ আমার এ খবর লয় নাই। জেলে যাওয়ার পর হুনলাম তিন ভাই মইরা গেছে। আমার খবর নেওয়ার কেউ নেয় নাই এহোন। মার্ডার কেইসের আসামি হিসেবে পচতেছি কাশিমপুর জেলে।’ জেল থেকে বেরিয়ে কী করবেন, কোথায় যাবেন- জানতে চাইলে বিল্লাল হোসেন ইসমাইল বলেন, ‘আল্লায় যেইখানে নেয়!’

সেন্টু কামাল (৪৫) বলেন, ‘১৯৯৩ সাল থেকে আমি জেলে আছি। বাড়ি নোয়াখালীর চাটখিল। বাবা দুই বিয়া করছে। মা নেই। বর্তমানে আমার কেউ বাঁচি আছে কিনা জানি না।’ পুলিশি নির্যাতন এবং জেলখানার বিভীষিকার বর্ণনা দিতে গিয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন তিনি। আলাপচারিতায় তার মানসিক ভারসাম্যহীনতারও বহিঃপ্রকাশ ঘটে। কথাবার্তা বলতে থাকেন এলোমেলো। থানা-পুলিশ নিয়েও গালাগাল করতে থাকেন।

চান মিয়া বলেন, ‘১৯৯৯ সাল থেকে আমি জেলে। বাবার ভিটা বরিশালের কোনো এক উপজেলায়। আমার জন্ম ঢাকার জুরাইনে। ভাড়া বাসায় ফ্যামিলির লগে থাকতাম। মৌসুমি ফল ও শাকসবজি বিক্রির ব্যবসা ছিল। একদিন বিকালে শ্যামপুরের একটি পার্ক থেকে ৫৪ ধারায় ধইরা লইয়া যায় পুলিশ। পরে একটি হত্যা মামলায় আসামি করে। চারদিন পর আদালতে হাজির করে রিমান্ডে নেয়।

তিনি বলেন, শ্যামপুর থানার তৎকালীন ওসি শংকর বাবু রিমান্ডে এনে অমানুষিক নির্যাতন করে। আমারে গরমপানিতে চুবাইয়া রাখে। পিটাইয়া হাত-পা লুলা কইরা দেয়। আমি খুন করছি- এ কথা আমারে শিখাইয়া দেয়। কোর্টে এ কথা না কইলে আমারে আরও মামলায় আসামি করনের ভয় দেখায়। পরে আদালতে ১৬৪ ধারায় আমি খুনের কথা স্বীকার করতে বাধ্য হইছি।’ চান মিয়া জানান, শ্যামপুর থানার ওসির নির্যাতনের ভয় এখনও তাকে তাড়া করে বেড়ায়। এখনও তার বুকে রয়েছে সেই নির্যাতনের ক্ষত। তিনি গায়ের জামা সরিয়ে ক্ষতটি দেখান।

এক প্রশ্নের জবাবে চান মিয়া বলেন, ‘এই দ্যাশে বিচার নাই! যাদের ট্যাহা আছে জেলের ভিতর তাদের সব আছে। আমার ট্যাহা নাই তাই জেলখানা আমার লাইগা দোজখখানা। একটা রাইতও আমি শান্তিতে ঘুমাইতে পারি না। টাকা না দিলে খাওনও পাওয়া যায় না। আমরা চাইর ভাই-বোন থাকলেও আমার খবর কেউ নেয় নাই। বাপ-মা বাঁইচা আছে কিনা কইতে পারুম না। আত্মীয়-স্বজনও কেউ একদিন দেখতে যায় নাই।’

ছাড়া পেলে কোথায় যাবেন জানতে চাইলে চান মিয়া বলেন, ‘বরিশালের কোন থানায় কোন গ্রামে আমার বাড়ি মনে নাই। জুরাইনে যে বাড়িতে আগে ভাড়া থাকতাম ওইখানেও আমার পরিবারের কেউ এতদিন থাকার কথা না। কই যামু জানি না।’

এদিকে বিনা বিচারে আটক চার ব্যক্তির আইনজীবী আইনুন নাহার সিদ্দিকা বলেন, আমরা শুধু আইনগত সহায়তা দিয়ে যাব। তাদের কারামুক্তি এবং মামলা নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে যেখানে যতটা আইনগত সহায়তা দেয়া প্রয়োজন আমরা সেটা দেব। মুক্তি পেয়ে তারা কোথায় যাবে, কার কাছে যাবে, কী করবে এটি তাদের ব্যাপার। হাইকোর্টের আদেশ কারাগারে না পৌঁছানো পর্যন্ত তারা কাশিমপুর কারাগারেই থাকবে।-যুগান্তর।

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: