নিঃসঙ্গতার রাজধানী ‘ব্রিটেন’

প্রকাশিত: ০৪ মার্চ ২০১৭, ০৬:০৩ পিএম

মো. মামুন উদ্দীন: ৭৮ বছরের বিধবা ক্যারোলিন। প্রতি মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৬টায় তার উত্তর লন্ডনের বাসার আরাম কেদারায় বসে থাকেন। কেবল একটি কল আসবে, এই আশায়। ঠিক একই সময় উইলমাও তাকে স্মরণ করেন, সব সময়। এ সময় তাদের মধ্যে নানা বিষয়ে আলাপ হয়। তাদের পরিবার, ফুটবল থেকে শুরু করে ইউক্রেন পরিস্থিতি সব। আলাপ চলে প্রায় এক ঘন্টা।

নিয়মিত আলাপচারিতার ধরন দেখে মনে হওয়া স্বাভাবিক উইলমা নিশ্চয়ই ক্যারোলিনার এক বৃদ্ধ প্রতিবেশী অথবা কাছের কোনো আত্মীয়। প্রকৃতপক্ষে তিনি এসবের কিছই নন। উইলমা একজন মহিলা। ক্যারোলিনার বাসা থেকে তার বাসার দূরত্ব ২০০ মাইলেরও বেশি। এমনকি তাদের মধ্যে কখনো দেখাই হয়নি।

এবার উইলমার প্রসঙ্গে আসা যাক। উইলমা ‘দি সিলভার লাইন’ নামে একটি দাতব্য সংগঠনের একজন স্বেচ্ছাসেবী। যারা খুব বেশি নিঃসঙ্গ এবং বৃদ্ধ সিলভার লাইন তাদের জন্য ২৪ ঘন্টা ফ্রি অনলাইন সেবার ব্যবস্থা করে থাকে। সংঘটনটির যারা সদস্য (ফ্রেন্ডস) তাদেরকে প্রতি সপ্তাহে এখান থেকে নিয়মমাফিক একবার স্মরণ (কল) করা হয়।

ক্যারোলিনার স্বামী দুই বছর আগে মারা যান। ক্যারোলিনা জানান, স্বামী মারা যাওয়ার পর থেকেই তিনি প্রচন্ড নিঃসঙ্গতায় ভুগছেন। তার পরিবারে আরও কয়েকজন সদস্য রয়েছে। তবে তারা সবাই দেশের অন্যান্য অঞ্চলে বাস করছেন। তাই গত এক বছর ধরে সাপ্তাহিক ওই ফোন কলটিই তার মানবীয় যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম।

এক সাক্ষাৎকারে ক্যারোলিনা বলেন, ‘এখন আমি খুব নিঃসঙ্গতা অনুভব করি। এ সময়ে আমি আমার স্বামীকে খুব বেশি মিস করছি।’ তিনি যখন এসব বলছিলেন তখন তার ভেতর থেকে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসল।’

এটাই ব্রিটেন। ইউরোপের সবচেয়ে নিঃসঙ্গ রাজধানী। সত্যিই তাই। জাতীয় পরিসংখ্যান দপ্তরের (Office for National Statistics) এক জরিপে দেখা যায়, ব্রিটেনের অধিবাসীদের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ের বন্ধুত্ব রয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্যান্য দেশের অধিবাসীদের মধ্যে তারা একজন অপরজন সম্পর্কে খুবই কম জানে।

দি সিলভার লাইন’র এক জরিপে দেখা যায়, ব্রিটেনের আড়াই মিলিয়ন মানুষ নিজেদেরকে একদম নিঃসঙ্গ, একা হিসেবে অ্যাখ্যা দেয়। দেশটির স্বাস্থ্য সচিব জার্মি হান্ট এ ধরনের অবস্থাকে তাদের ‘জাতীয় লজ্জা’ হিসেবে বর্ণনা করেন।

শিকাগো ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক জন ক্যাসিপো’র নেতৃত্বে একদল গবেষক প্রবীণদের উপর নিঃসঙ্গতার প্রভাব সংক্রান্ত একটি জরিপ চালান। ‌‘Rewarding Social Connections Promote Successful Ageing’- নামের প্রতিবেদনটিতে তারা উল্লেখ করেন, নিঃসঙ্গতার অনুভূতি হার্ট অ্যাটাক, বুদ্ধি বৈকল্য, হতাশা, নিদ্রাহীনতা, উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বাড়ায় এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস করে। যারা অন্যদের চেয়ে বেশি বিচ্ছিন্ন বোধ করেছে তাদের ১৪ শতাংশই স্বাভাবিক মৃত্যুর নির্দিষ্ট সময়ের আগেই মারা যান।

ব্রিটেনে প্রতি সপ্তাহেই গণমাধ্যমে কোন না কোন একটি মর্মান্তিক ঘটনার খবর উঠে আসে। এমন অনেক পুরুষ-মহিলা আছেন, যাদের অন্তর্ধানের বিষয়টি কারো নজরেই আসেনি। বছরের পর বছর অতিবাহিত হয়। এক সময় উদঘাটিত হয়, তারা তাদের বাসায় মরে পড়ে আছে। জেমস গ্রে একজন আইরিশ পেনশনভোগী ব্যক্তি। তিনি গত বছর সংবাদপত্রে একটি বিজ্ঞাপন দেন। বিজ্ঞাপনের বিষয়টি ছিল এরকম: গ্রে টানা ১০ বছর ধরে কারো সাথে বড়দিনের উৎসবটি পালন করতে পারছেন না। অর্থাৎ তিনি নিঃসঙ্গ। এজন্য তার এমন কাউকে দরকার যিনি এবারের বড়দিনটিতে তার সাথে কাটাবেন।

তবে যাদের বয়স পয়ষট্টি বা তার উর্ধ্বে শুধু তারাই যে বিশ্ব থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন ভাবেন তা নয়। বিচ্ছিন্নতাবোধ যে কারোরই হতে পারে। মানসিক স্বাস্থ্য ফাউন্ডেশন ২০১০ সালে তাদের ‘দি লোনলি সোসাইটি নামে তাদের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, যাদের বয়স ১৮ থেকে ৩৪ বছর তাদের ৬০ শতাংশই প্রায়ই একাকী বা নিঃসঙ্গতা অনুভব করেন বলে জানান।

‘Lonely: Learning to Live with Solitude’ গ্রন্থের রচয়িতা এমিলি হোয়াইট তার বয়সের ত্রিশের দশকের প্রথম দিকেই দীর্ঘস্থায়ী নিঃসঙ্গতা অনুভব করতে থাকেন বলে তার বইয়ে উল্লেখ করেন। নিঃসঙ্গতা কাটানোর জন্য তিনি দোকানে যেতেন। শুধু ক্যাশিয়ারের সাথে কয়েকটি বাক্য বিনিময় করা যাবে এজন্য। তবে কেউই তার সমস্যাটি শনাক্ত করতে পারেনি। হোয়াইট বলেন, আমার বস্তুবাদী ঐশ্বর্যের কোনো অভাব নেই। আমার একটি আকর্ষণীয় চাকরি আছে এবং আমি প্রচুর অর্থ আয়ও করি। এসব কারণে আমার জীবনটা শূন্য মনে না হওয়াটাই স্বাভাবিক। হোয়াইট আরো জানান, আমাদের এখানে একশ্রেণির মানুষ আছে যারা আমার মতো এবং আরো এক শ্রেণির মানুষ আছে, যারা হচ্ছেন প্রবীণ।

ব্রিটেনে বিবাহিতরাও এমনকি নিঃসঙ্গতা মুক্ত নন। গত বছর JAMA Internal Medicine-র এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্রিটেনের ৬২ দশমিক ৫ শতাংশ বিবাহিত নারী-পুরুষও নিঃসঙ্গতা অনুভব করেন। এর মানে বোঝা যায়, পরিবারও শুধু নিঃসঙ্গতা এড়ানোর নিশ্চয়তা দিতে পারছে না সেখানে। একাকীত্ব বা নিঃসঙ্গতা এক সময় পরিবারের সদস্যদেরও আগাছার মতোই গাপটে ধরে। অনুরূপভাবে ২৫ বছরের কম বয়সের যুবক-যুবতী যারা শ্রেণিকক্ষ কিংবা নাইটক্লাবে প্রতিনিয়তই সঙ্গী পরিবেষ্টিত হয়ে থাকেন তারাও নিঃসঙ্গতার বেদনায় আবিষ্ট থাকেন।

দাতব্য সংঘটন ডব্লিউআরভিএস ইউরোপীয় ইউনিয়ন ভুক্ত দেশগুলোর মানুষদের জীবন সম্পর্কে জানার জন্য প্রতিবছর ‘European Social Survey’ নামে একটি গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে। এ গবেষণায় সকল বয়সের মানুষদের সমসংখ্যক একই রকম প্রশ্ন করা হয়। এখান থেকে গবেষকরা পূর্ব ইউরোপীয় চারটি দেশ অর্থাৎ ব্রিটেন, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস এবং সুইডেনের প্রবীণদের জীবনমান মূল্যায়ন করার জন্য তাদের প্রদত্ত উত্তরসমূহ তুলনা করেন।

পূর্ববর্তী সপ্তাহে তারা কতবার নিঃসঙ্গতা অনুভব করেছেন যা তারা আগে কখনও করেননি প্রথমে সে বিষয়টি তাদের র‌্যাংকিং করতে বলা হয়। একই সময়ে তারা কতবার সামাজিকে কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ করেছেন এবং শারীরিক কর্মকান্ডে নিজেদের কেমন প্রবৃত্ত করেছেন সেসব বিষয়েও র‌্যাংকিং করতে বলা হয়। উল্লিখিত তিনটি প্রশ্নের উত্তরেই দেখা যায়, ব্রিটেনের র‌্যাংকিং সবার নিচে অর্থাৎ চার নম্বরে।

চার নম্বর প্রশ্নে সব বয়সের মানুষের কাছে জানতে চাওয়া হয় কত বছর বয়স থেকে একজন মানুষকে বৃদ্ধ বলা যাবে। এ প্রশ্নে বিটেনের মানুষদের গড় উত্তর ছিল ৬১ বছর ৯ মাস, যেখানে নেদারল্যান্ডের মানুষদের উত্তর ছিল ৭০ বছর ৪ মাস।

ডব্লিউআরভিএস’র প্রধান নির্বাহী ডেভিড ম্যাককালাপ বলেন, গবেষণাটি এ সময়ের ব্রিটেনে প্রবীণদের আশংকাজনক বৃদ্ধির অপ্রিয় সত্যটিকে প্রকাশ করেছে। এটাকে তিনি একটি ওয়েক আপ কল অর্থাৎ জেগে উঠার সংকেত হিসেবে বর্ণনা করেন।-সূত্র: ইনডিপেন্ডেন্ট (লন্ডন), দি টেলিগ্রাফ (লন্ডন)

লেখক: বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও কলাম লেখক
ইমেল: [email protected]

(খোলা কলামে প্রকাশিত লেখা একান্তই লেখকের ব্যক্তিগত অভিমত, এর কোন দায়ভার কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করবে না।)

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: