বস্তায় আনা হয়েছিল চার লাশ

প্রকাশিত: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৬, ০৬:৪৩ এএম

শামীমুল হক:

বস্তায় ভরে ইছাবিলে আনা হয়েছিল চার শিশুর লাশ। এরপর বালির ঢিবিতে চাপা দেয়া হয় লাশগুলো। হত্যাকারীরা মনে করেছিল এ লাশ আর মিলবে না। বালির নিচে চাপা পড়ে যাবে। কিন্তু তাদের সে আশা গুড়েবালি করে দিয়েছে শিয়াল। রাতে শিয়াল বালি খুঁড়ে লাশ টেনে একটু উপরে তোলে। এরপরই গ্রামবাসীর নজরে আসে লাশগুলো। নিখোঁজের পাঁচ দিন পর লাশের সন্ধান পাওয়া যায়।

শুক্রবার নিখোঁজ হয় সুন্দ্রাটিকি গ্রামের শিশু জাকারিয়া শুভ, মনির, ইসমাইল ও তাজেল। বুধবার লাশ পাওয়া যায়। এরপর একে একে এর সঙ্গে জড়িত আবদুল আলী বাগাল, তার পুত্র রুবেল, জুয়েল, ভাতিজা ছায়েদসহ ৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। ইতিমধ্যে রুবেল, জুয়েল, আরজু ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে আদালতে। তারা জবানবন্দিতে নিজেদের দায় স্বীকার করেছে। তবে রুবেল ও জুয়েল হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ৬ জন জড়িত বললেও আরজু তার জবানবন্দিতে ৮-৯ জন ছিল বলে জানিয়েছে। ওদিকে গতকাল ৪ শিশু হত্যাকাণ্ডের মূলহোতা আবদুল আলী বাগালকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। ১০ দিনের রিমাণ্ড শেষে আদালতে হাজির করা হলে বিচারক তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। অপরদিকে আরজুর দেয়া জবানবন্দি অনুযায়ী শুক্রবার মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির ওসি মোকতাদির হোসেন ইছাবিলে যান। তার সঙ্গে যান বাহুবল মডেল থানার ওসি মো. মোশাররফ হোসেন পিপিএম। তারা হত্যাকাণ্ডের আলামত হিসেবে ইছাবিলের পাশের ছড়া থেকে ৪টি বস্তা উদ্ধার করেন। এ সময় গ্রামের লোকজন ইছাবিলে জড়ো হন। এর আগে পুলিশ বাচ্চু মিয়ার সিএনজি অটোরিকশা, কোদাল, শাবল এবং একটি রক্তমাখা পাঞ্জাবি উদ্ধার করে। ওদিকে বৃহস্পতিবার র‌্যাবের ক্রসফায়ারে নিহত বাচ্চু মিয়ার লাশ দাফন করা হয়। কিন্তু তার লাশ গ্রামে গেলে গ্রামবাসী ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। তারা লাশ সুন্দ্রাটিকি গ্রামে দাফন করতে দেয়া হবে না বলে সাফ জানিয়ে দেন। আর পরিবারের ইচ্ছা গত বছর মারা যাওয়া পিতা আবদুল বারিকের কবরের পাশে বাচ্চুকে দাফন করার। এ নিয়ে উত্তেজনা দেখা দিলে সেখানে ছুটে যান বাহুবল উপজেলা চেয়ারম্যান মো. আবদুল হাই, বাহুবল উপজেলা নির্বাহী অফিসার সাইফুল ইসলাম ও ওসি মোশাররফ হোসেন পিপিএম। তারা গ্রামবাসীকে শান্ত করে পঞ্চায়েত নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন।

দীর্ঘ আলোচনা শেষে সিদ্ধান্ত হয় গ্রাম পঞ্চায়েতের ৬টি কবরস্থানের কোথাও তাকে দাফন করা হবে না। পরে বাচ্চুর বাড়ির পাশে ছড়ারপাড়ে তার নিজের জমিতে তাকে দাফন করা হয়। এ সময় বাহুবল থানার বিপুল সংখ্যক পুলিশ গ্রামে অবস্থান নেয়। এর আগে হবিগঞ্জ সদর হাসপাতালে বাচ্চু মিয়ার ময়নাতদন্ত শেষে পুলিশ তার মা আয়েশা খাতুনের কাছে লাশ হস্তান্তর করেন। তিনি স্বজনদের সঙ্গে নিয়ে লাশ বাড়িতে নিয়ে আসেন। সুন্দ্রাটিকি গ্রামের লোকজন মারা গেলে সাধারণত গ্রামের ৬টি পঞ্চায়েতি কবরস্থানে দাফন করা হয়। প্রায় এক বছর আগে বাচ্চু মিয়ার পিতা আব্দুল বারিককেও ওই গ্রামের মাদরাসা সংলগ্ন কামারগাঁও কবরস্থানে দাফন করা হয়। সে সূত্রে পরিবারের সদস্যরা ওই স্থানে নিহত বাচ্চু মিয়াকে দাফনের উদ্যোগ নিলে গ্রামবাসী বাদ সাধেন। এরপর প্রশাসন ও বাচ্চুর মা আয়েশা খাতুনের অনুরোধে লাশ দাফনে অনুমতি দেয়া হয়। গ্রামবাসী জানান, লাশ উদ্ধারের পর থেকে বাচ্চু মিয়া তার সিএনজি অটোরিকশায় শিশুদের অপহরণ করেছে বলে ছড়িয়ে পড়ে। আর এ থেকেই বাচ্চু মিয়ার ওপর মানুষের ক্ষোভ ও ঘৃণা জন্ম নিয়েছিল। এ ক্ষোভ ও ঘৃণা থেকেই পঞ্চায়েতের কবরস্থানগুলোতে তার লাশ দাফনে বাধা দেয়া হয়। গত ১২ই ফেব্রুয়ারি গ্রামের মাঠে খেলা দেখতে গিয়ে নিখোঁজ হয় সুন্দ্রাটিকি গ্রামের আবদাল মিয়া তালুকদারের ছেলে মনির মিয়া (৭), ওয়াহিদ মিয়ার ছেলে জাকারিয়া আহমেদ শুভ (৮), আব্দুল আজিজের ছেলে তাজেল মিয়া (১০) ও আব্দুল কাদিরের ছেলে ইসমাইল হোসেন (১০)। পাঁচ দিন পর ১৭ই ফেব্রুয়ারি গ্রামের ইছাবিলে বালির গর্ত থেকে তাদের মাটিচাপা লাশ উদ্ধার করা হয়। পুলিশ লাশ উদ্ধারের দিনই কথিত পঞ্চায়েত নেতা আব্দুল আলী বাগাল, তার ছেলে জুয়েল মিয়া ও রুবেল মিয়া ও আব্দুল আলী বাগালের সেকেন্ড ইন কমান্ড হাবিবুর রহমান আরজুকে গ্রেপ্তার করে। তাদের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী, ক্রসফায়ারে নিহত বাচ্চু মিয়ার সিএনজি অটোরিকশায় ওই চার শিশুকে অপহরণ করা হয়। তারপর তাদের হত্যা করা হয়। কিন্তু তাদের জবানবন্দি নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। রুবেল ও জুয়েল বলেছে, অপহরণের পর বাচ্চু মিয়ার গাড়ির গ্যারেজে তাদের হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু সরেজমিন বাচ্চু মিয়ার বাড়িতে গিয়ে কোনো গ্যারেজের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। তদন্ত সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, শিশুদের আবদুল আলী বাগালের বাগানে নিয়ে হত্যা করা হতে পারে। পরে সেখান থেকে রাতের আঁধারে বস্তায় ভরে লাশ ইছাবিলে বালুর ঢিবিতে চাপা দেয়া হয়। প্রতিবাদে উত্তাল বাহুবল: বৃহস্পতিবার বাহুবলের ১০১টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা মাঠে নেমেছিল তাদের সহপাঠীদের হত্যার প্রতিবাদ জানাতে। তারা বাহুবলের রজপথে মানববন্ধন করে এর প্রতিবাদ জানিয়েছে। হত্যাকারীদের ফাঁসি দাবি করেছে। শুধু তাই নয়, বাহুবলের সব শ্রেণি পেশার মানুষ নেমে এসেছে রাজপথে। সবার এক কথা, চার শিশুর খুনিদের ফাঁসি চাই। গত শনিবার সকাল সাড়ে ১০টায় উপজেলার মিরপুর বাজারে সানশাইন প্রি-ক্যাডেট এন্ড হাইস্কুল, দুপুর ১২টায় ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের বাহুবল উপজেলা সদরে বাহুবল অনার্স কলেজ, বেলা ২টায় ইসলামপুর- গোলগাঁও সড়কে ফয়জাবাদ উচ্চবিদ্যালয় মানববন্ধন এবং বেলা ৩টায় বাহুবল বাজারে সচেতন নাগরিক সমাজ প্রতিবাদ সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিল করে। এসব মানববন্ধন, প্রতিবাদ সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিলে ছাত্রছাত্রী, অভিভাবকসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ অংশ নেয়। বিকাল ৫টায় উপজেলা সদরে তৌহিদী জনতার ব্যানারে অনুষ্ঠিত সমাবেশে যোগ দেন বাহুবলের বিভিন্ন গ্রামের লোকজন। এ সমাবেশে বক্তব্য রাখেন সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুল কাদির চৌধুরী, বিশিষ্ট আলেম মাওলানা আব্দুল খালিক, মাওলানা আব্দুল্লাহ, বাজার কমিটির সভাপতি এমএ জলিল তালুকদার, মাওলানা আতাউর রহমান, ক্বারি হোসাইন আহমেদ প্রমুখ। বক্তারা শিশু হত্যার প্রতিবাদ ও খুনিদের ফাঁসির দাবির পাশাপাশি পুলিশের গাফিলতির বিচার দাবি করেন। রিমান্ড শেষে কারাগারে বাগাল স্টাফ রিপোর্টার, হবিগঞ্জ থেকে জানান, বেলা পৌনে ২টায় বাগালকে আদালতে নেয়া হয়। পরে আদালতের নির্দেশে তাকে কারাগারে প্রেরণ করা হয়। এর আগে ১৮ই ফেব্রুয়ারি তাকে ও তার ছেলে জুয়েল মিয়াকে ১০ দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়। জুয়েল মিয়া ইতিমধ্যে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। উক্ত মামলায় এখন র‌্যাবের হাতে আটক সাহেদ আলী রিমান্ডে রয়েছেন। আর কারাগারে রয়েছেন আবদুল আলীসহ মোট ছয়জন। পুলিশের দাবি, আবদুল আলী এ ঘটনার মূল হোতা। ১০ দিন রিমান্ডে নিলেও তিনি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেননি। তবে তার দুই ছেলে জুয়েল ও রুবেল এবং তার অন্যতম সহযোগী হাবিবুর রহমান আরজু আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির ওসি মোক্তাদির হোসেন জানান, আবদুল আলী বাগাল রিমান্ডে ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার কথা স্বীকার করেনি। তবে অন্যদের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী সে-ই ঘটনার মূল নায়ক। তার বিরুদ্ধে আরও ৫ দিনের রিমান্ড প্রার্থনা করা হবে।

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: