অবসান হোক ‘ভ্রান্ত নিউক্লিয়ার আতঙ্ক’

প্রকাশিত: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬, ০৯:৪৩ পিএম

রাশিয়া: একটি দেশ কতটা উন্নতির শিখরে আরোহণ করবে তা অনেকাংশেই নির্ভর করে সে দেশের পাওয়ার সেক্টরের উপর। দেশের পাওয়ার সেক্টর যতটা এগিয়ে, সে দেশ সার্বিক উন্নয়নে ঠিক ততটাই উন্নত। পাওয়ার সেক্টরের উন্নয়ন ব্যতিরেকে কোন দেশের এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন শুধু স্বপ্নই থেকে যাবে তা কখনোই বাস্তবে রূপ লাভ করবে না।

সমগ্র পৃথিবী আজ যেন এই সেক্টরের উন্নয়নের প্রতিযোগিতায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। তাহলে আমাদের সোনার বাংলা কেন পিছিয়ে থাকবে? তাই আমরাও আজ নেমে পড়েছি প্রতিযোগিতায় কিন্তু নির্মম হলেও সত্যি আমাদের অবস্থান সেখানে অনেক পিছনে। যেখানে সমগ্র পৃথিবী আজ আলোয় আলোকিত সেখানে বাংলাদেশের প্রায় ৪০ ভাগ মানুষ বিদ্যুতের আলো থেকেই বঞ্চিত, বাকী প্রায় ৬০ ভাগ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধা পেয়ে থাকে।

বাংলার গ্রামের রাতের আকাশে তাকালে ফুটে উঠে ভিন্ন রূপ সেখানে প্রায় ৬০ ভাগ মানুষই বিদ্যুৎ বঞ্চিত। বাংলাদেশে প্রতি বছর একজন মানুষের বিদ্যুৎ চাহিদা মাত্র ৩২১ KWH যেখানে একজন মার্কিন নাগরিকের চাহিদা ১৫,১৮২ KWH। বাংলাদেশের যোগান মাত্র ২৭৯ KWH সেখানে মার্কিনীদের যোগান চাহিদার চেয়েও বেশি।

আমাদের বিদ্যুৎ সমস্যা নিরসনের সর্বোৎকৃষ্ট উপায় হচ্ছে নিউক্লিয়ার, যার উৎপাদন খরচ সকল জ্বালানির মধ্যে ন্যূনতম। যেখানে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ খরচ পেট্রোলিয়াম কর্তৃক প্রায় ১৭.২৫ টাকা, প্রাকৃতিক গ্যাস কর্তৃক প্রায় ৩.৬০ টাকা, কয়লা কর্তৃক প্রায় ৩.১০ টাকা, সেখানে নিউক্লিয়ার ফিশন কর্তৃক খরচ মাত্র প্রায় ১.৮২ টাকা। আমাদের মত সল্প আয়ের দেশের ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছানোর জন্য নিউক্লিয়ারই একমাত্র সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা। রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রাঞ্চ, চীন, আরমেনিয়া, ফিনল্যান্ড, বুলগেরিয়া এবং পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ও পাকিস্তানসহ বিশ্বের ৩১ টি দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে নিউক্লিয়ার ফিশনের মাধ্যমে, যা তাদের পাওয়ার সেক্টরকে করেছে উন্নত থেকে উন্নততর এবং বিশ্ব প্রতিযোগিতায় এগিয়ে রেখেছে কয়েক ধাপ।

সেদিক দিয়ে আমরা পিছিয়ে থাকলেও আজ আমরা বাংলার আকাশ আলোকিত করতে সংকল্পবদ্ধ।তাই এ স্বপ্ন পুরনে বাংলাদেশ বেঁছে নিয়েছে পারমাণবিক শক্তিকে কিন্তু এই পারমাণবিক নিয়ে আমাদের মাঝে প্রচলিত আছে নানারকম ভ্রান্ত ধারণা, সেটা ধীরে ধীরে রূপ নিয়েছে আতঙ্কে।চলুন জেনে নিই ভ্রান্ত ধারণাগুলো, বিদায় জানাই আতঙ্ককে আর গড়ে তুলি সপ্নের পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে।

ভ্রান্ত ধারণা ১ : দেশের সর্বাধিক বিকিরণ আসে নিউক্লিয়ার পাওয়ার থেকে।

উত্তর : কথাটি পুরোপুরি মিথ্যা। যুক্তরাষ্ট্রকে মানদণ্ড ধরলে বছরে ০.০০৫% রেডিয়েশন আসে নিউক্লিয়ার থেকে যেখানে কয়লা থেকে আসে এর ১০০ গুন এবং বিমান উড্ডয়ন থেকে আসে এর ২০০ গুন বেশি। ঘটনাটা আসলে বছরে একটা আপেল খাওয়ার মত।

ভ্রান্ত ধারণা ২ : নিউক্লিয়ার রিয়াকটর পারমাণবিক বোমার মত বিস্ফোরিত হয়।

উত্তর : কথাটি শুনতে আসলে উটপাখি আকাশে উড়ে এরকম শোনায়। রিয়াকটরে সংগঠিত হয় নিয়ন্ত্রিত ফিশন বিক্রিয়া আর বোমাতে সংগঠিত হয় অনিয়ন্ত্রিত ফিশন। বোমাতে বিশেষ উপকরণ ব্যবহার করা হয় যা রিয়াকটরে অনুপস্থিত। রিয়াকটরের পক্ষে বোমার মত বিস্ফোরিত হওয়া এক অসম্ভব ব্যপার।

ভ্রান্ত ধারণা ৩ : নিউক্লিয়ার এনার্জি পরিবেশের জন্য ক্ষতিকারক।

উত্তর : নিউক্লিয়ার প্ল্যান্ট থেকে কোন গ্রিনহাউস বা সিএফসি গ্যাস নির্গত হয় না। প্ল্যান্ট থেকে যে ধূয়া বের হতে দেখা যায় সেটা জলীয়বাষ্প ছাড়া আর কিছুই না। বাতাস এবং সোলার এনার্জির মতই নিউক্লিয়ার পরিবেশ বান্ধব। বাসায় একটা ফ্রিজ ব্যবহারের চেয়েও পরিবেশের জন্য নিউক্লিয়ার অনেক কম ক্ষতিকর।

ভ্রান্ত ধারণা ৪ : নিউক্লিয়ার এনার্জি নিরাপদ নয়।

উত্তর : অনান্য সেক্টরের সাথে তুলনা করলে নিউক্লিয়ার দুর্ঘটনার সংখ্যা খুবই কম। ৩১ টি দেশের মধ্যে দুটি দেশে দুর্ঘটনা ঘটেছে। সেখানকার রিয়াকটরগুলো ছিল 2nd generation এর, নিরাপত্তা ব্যবস্থার অনেক ঘাটতি ছিল, অনেক সীমাবদ্ধতা ছিল কিন্তু আধুনিক প্রযুক্তির 3rd generation + রিয়াকটর সে সব সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে নিরাপত্তাকে নিয়ে গেছে সর্বোচ্চ পর্যায়ে। ইউ এস এর এক গবেষণায় বের হয়েছে বর্তমানে নিউক্লিয়ার প্ল্যান্টে কাজ করা সাধারণ অফিসে কাজ করার চেয়েও বেশি নিরাপদ।

ভ্রান্ত ধারণা ৫ : নিউক্লিয়ার বর্জ্যের কোন সমাধান নেই।

উত্তর : একটি নিউক্লিয়ার প্ল্যান্ট ৫০ বছর ব্যবহারের পর যে পরিমান বর্জ্য নির্গত করে তা হল, একটি ফুটবল মাঠকে ১০ গজের কম গর্ত করে সেখানে বর্জ্য রাখলেও তা ভর্তি হবে না। এর মধ্যে ৯৬ ভাগ বর্জ্য পুনর্ব্যবহৃত করা যায় এবং বাকি ৪ ভাগ IAEA প্রণীত বিশেষ উপায়ে সংরক্ষণ করা হয়। আমাদের দেশের জন্য এ কাজটি করবে রাশিয়ার ROSATOM, সেক্ষেত্রে আমাদের এ বিষয় নিয়ে কোনরকম দুশ্চিন্তার কারণ নেই।

ভ্রান্ত ধারণা ৬ : নিউক্লিয়ার বর্জ্য ১০,০০০ বছর পর্যন্ত সক্রিয়।

উত্তর : প্ল্যান্টে ব্যবহৃত জ্বালানির ৯৬ ভাগ পুনর্ব্যবহার করা যায় , ৩ ভাগের বেশি বর্জ্য ৩০০ বছরেরও কম সক্রিয় এবং বাকি ১ ভাগেরও কম ১০,০০০ বছর সক্রিয়। এ বর্জ্য গুলোকে IAEA প্রণীত বিশেষ উপায়ে সংরক্ষণ করা হয়। এই ১ ভাগ বিকিরণ প্রকৃতি থেকে নির্গত বিকিরণের চেয়েও কম ক্ষতিকর।

প্রশ্ন ৭ : আমাদের দেশ কি চেরনোবিল বা ফুকুশিমা হতে পারে ?

উত্তর : না। নিউক্লিয়ার দুর্ঘটনা নির্ভর করে রিয়াকটরের ধরণের উপর। ফুকুশিমাতে ব্যবহার করা হয়েছিল BWR এবং চেরনোবিলে RBMK রিয়াকটর। যেগুলো ছিল 2nd generation রিয়াকটর, সেখানে নিরাপত্তা ব্যবস্থার অনেক ঘাটতি ছিল। ফুকুশিমার BWR রিয়াকটর যে মাত্রার ভূমিকম্প সহনশীল ছিল, দুর্ভাগ্যবশত তার চেয়ে বেশি মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ায় এই দুর্ঘটনা ঘটে। কিন্তু বিশ্বের অত্যাধুনিক প্রযুক্তির পঞ্চম স্তর নিরাপত্তা বিশিষ্ট 3rd generation + ( VVER-1200 ) রিয়াকটরের ভূমিকম্প সহনশীল ক্ষমতা অনেক বেশি। এ রিয়াকটরের নিরাপত্তা ব্যবস্থার উপর মুগ্ধ হয়ে ফিনল্যান্ড , তুরস্ক , বেলারুশ, আর্জেন্টিনা, মিশর , জর্ডান , ভারত (নির্মাণ কাজ প্রায় শেষ ) , ভিয়েতনাম ও বাংলাদেশ সহ আরও কয়েকটি দেশ সর্বাধুনিক প্রযুক্তির নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত নেয়।

VVER-1200 এর বিশেষ কয়েকটি বৈশিষ্ট্য :

১। পঞ্চম স্তরের নিরাপত্তা বিশিষ্ট রিয়াকটর।

২। ক্ষেপণাস্ত্র ঢাল সমৃদ্ধ একটি সংবরণশীল রিয়াকটর।

৩। যেকোনো ধরণের বিমান দুর্ঘটনা প্রতিহত করতে সক্ষম।

৪। রিকটার স্কেলে ৯-১০ মাত্রার ভূমিকম্প সহনশীল, যেখানে রূপপুরে সর্বোচ্চ নির্ধারিত হয়েছে ৫-৭ মাত্রার ভূমিকম্প।

৫। যে কোন ধরণের বিপর্যয় ঘটলেও বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বাইরে বিকিরণ পৌঁছাবে না।

প্রশ্ন ৮ : আমাদের দেশে কি দক্ষ জনবল আছে?

উত্তর : বর্তমানে তৈরিকৃত অবস্থায়। পরমানু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য ROSATOM নিজেই তৈরি করে দিচ্ছে দক্ষজনবল। তারা একপর্যায়ে ভাষাশিক্ষা সহ ৬.৫ বছর মেয়াদী স্পেশালিষ্ট প্রোগ্রামে “নিউক্লিয়ার স্পেশালিষ্ট”, ভাষা শিক্ষা সহ ৩ বছর মেয়াদী মাস্টার্স এবং ভাষাশিক্ষা সহ ৪ বছর মেয়াদী পিএইচডি প্রোগ্রামে দক্ষ জনবল গড়ে তুলছে। এর মধ্যে নিউক্লিয়ার স্পেশালিষ্টদের ২.৫ বছর VVER পাওয়ার প্ল্যান্টে ইন্টারনির মাধ্যমে ব্যবহারিকভাবে কার্যত দক্ষ জনবলে পরিণত করবে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের VVER-1200 মডেলের জন্য। প্রথম ১০ বছর ROSATOM নিজেই প্ল্যান্ট দেখাশুনা করবে এবং এই সময়ের মধ্যে আরও গড়ে তুলবে পর্যাপ্ত ভবিষ্যৎ দক্ষ জনবল। ১০ বছর পর বাংলাদেশ প্ল্যান্ট চালানোর দক্ষতা অর্জন করলে রাশিয়া বাংলাদেশকে হস্তান্তর করবে।

প্রশ্ন : কেন ROSATOM কে বেঁছে নেয়া হল?

উত্তর : রাশিয়ার ROSATOM ই হল পৃথিবীর একমাত্র কোম্পানি যে, তারা পাওয়ার প্ল্যান্ট নির্মাণ থেকে শুরু করে তার মেয়াদকাল চালানো পর্যন্ত আপাদমস্তক সহায়তা করে থাকে। উন্নয়নশীল দেশদের অর্থনৈতিক ঋণের মাধ্যমেও সহায়তা করে থাকে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্ল্যান্ট বাবদ খরচের ৯০ ভাগ সরবরাহ করবে ROSATOM, বাকী ১০ ভাগ বাংলাদেশ। দক্ষ জনবল তৈরি থেকে শুরু করে , ইউরেনিয়াম সরবরাহ ও বর্জ্য নিরসন পর্যন্ত সমস্ত কাজে ROSATOM সহায়তা করে থাকে। ROSATOM কে বেঁছে না নিলে হয়ত বাংলাদেশের মত স্বল্প আয়ের দেশের জন্য স্বপ্নের নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট হয়ত সপ্নই থেকে যেত অথবা পিছিয়ে যেত আরও কয়েক যুগ। বাংলাদেশের জন্য ROSATOM কে বেঁছে নেয়া একটি প্রত্যুৎপন্নমতিতার উদাহরণই বটে।

চলুন আমরা সবাই ভ্রান্ত নিউক্লিয়ার আতঙ্ক থেকে বেরিয়ে এসে সত্যিটাকে উন্মোচন করি। বাংলাদেশের পাশে থেকে গড়ে তুলি স্বপ্নের রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। সত্যি হোক আমাদের স্বপ্ন, দেশ এগিয়ে যাক আরও কয়েক ধাপ। রাতের অন্ধকার দূর করে আলোকিত হোক বাংলার আকাশ। আলোকিত হোক বাংলার প্রতিটি অঙ্গন।

লেখক: সাইদ,
ছাত্র নিউক্লিয়ার স্পেশালিষ্ট।
জাতীয় পরমাণু গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয়, “মেফি”।
[email protected]

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: