নতুন চিন্তায় নজরুল
নজরুল সব সময়ই প্রাসঙ্গিক ছিলেন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে দ্রোহে, তারুণ্যের উচ্ছাসে, সঙ্গীতের অনুরণে, কবিতার ছন্দে কিংবা শক্তিশালী কথা সাহিত্য দিয়ে তিনি অর্জন করেছেন- কালোত্তীর্ণ মহিমা। জন্মের ১২০ বছর পরেও বিভিন্ন দিক থেকে নজরুলের তাৎপর্য অপরিসীম। এ লেখায় নতুন সময়ের প্রেক্ষিতে তাঁকে পর্যালোচনা করা হয়েছে কিছুটা ব্যতিক্রমীভাবে।
১. তাঁর উত্থানের সময়টা ঔপনিবেশিক আমলে। চাইলেই আপোষ করে, আরাম-আয়েশে জীবনটা পার করতে পারতেন। যে মেধা ছিল, তাতে করে বাংলা শিল্প-সাহিত্যে তাঁর পরাক্রম কেউই রোধ করতে পারত না। মেঘ, বৃষ্টি, নারী, নদী, প্রেম-বিরহ নিয়েই আবদ্ধ থাকতে পারতেন। কিন্তু তিনি হাঁটলেন সবচেয়ে কঠিন পথে। সর্বশক্তি নিয়ে সাম্রাজ্যবাদকেই আগে নাড়া দিলেন। লক্ষ্য করুন, ঝাঁকড়া-চুলের ঐ তরুণ ছেলেটার কিন্তু কোনো ব্যাকআপ ছিল না। আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক স্ট্যাবলিশমেন্টও ছিল না। ছিল কেবল দুর্দান্ত সাহস আর পৃথিবী বিরল প্রতিভা।
২. দরিদ্র মুসলিম পরিবার থেকে উঠে আসা ছেলেটা নিজ ধর্মের বলয়েই থাকতে পারত। নিখিল ভারতের সাম্প্রদায়িক বিভাজন নিয়ে তাঁর মাথা না ঘামালেও চলত। কিন্তু কী বিশাল হৃদয় তাঁর! তিনি বুঝলেন হিন্দু-মুসলিম বিভক্তি, বৃটিশ রাজ্যের শক্তিই বৃদ্ধি করে যাবে। তাই লিখতে হল ‘আনন্দময়ীর আগমনে’। রচনা করতে হল অজস্র ভজন-কীর্তন-শ্যামা সঙ্গীত। বেদ-পুরাণ-উপনিষদ-রামায়ণ-মহাভারত থেকে বের করে আনতে হল ধর্মীয় শিক্ষার উপাদান। নিজের বিদ্রোহকে অনুবাদ করতে হল সনাতন ধর্মের আলোকে। নিজে মুসলিম হয়েও আপন করে নিতে হল হিন্দু ধর্মের শিক্ষা ও মূল্যবোধকে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা অনেকেই বলেছেন; কিন্তু নজরুলের চেয়ে আন্তরিক ও উৎকৃষ্ট উদাহরণ পাওয়া বড় দুষ্কর।
৩. শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে মুসলমানরা তখন জড়োসড়ো। ইসলাম নিয়ে লিখলে ট্যাগ হবার ভয়তো আছেই, সেই সাথে আছে বিভিন্ন দিক থেকে আক্রান্ত হওয়ার শঙ্কা। তরুণ ছেলেটা সেসব মানল কোথায়? সব রীতি-রেওয়াজ আর শঙ্কা উড়িয়ে, লিখতে থাকল উমর ফারুক, খালেদ, মহররম আরও কত কিছু। এর আগে বাংলায় ইসলামী সঙ্গীত বলে তেমন কিছু ছিল না। ইতিহাসটা তিনিই রচনা করলেন। আব্বাস উদ্দিনের কণ্ঠে ধ্বণিত হল ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে।’ পরে হামদ-নাত হয়ে সেই ধারাটা আরো বিকশিত ও পল্লবিত হল। একবার ভাবুন, সেদিন ঐ যুবকের সাহসটা যদি ঠিকরে না বেরোত; তবে বাংলা ভাষায় হয়তো ইসলামী গানের জন্ম নাও হতে পারত। মোল্লাতন্ত্রের আক্রমণ ও ফতোয়া তাঁর পিছু ছাড়েনি। কিন্তু নজরুল তো নজরুলই। খালি গলায়, আমতা আমতা করে ইসলামী গান তিনি করলেন না; বরং তাকে পুরোপুরিভাবেই সঙ্গীত করে তুললেন। রাগ-রাগিণী ছেঁচে সুর দিলেন। বাদ্য-যন্ত্র ব্যবহার করলেন সব উপেক্ষা করে। একবার ভাবুন, সঙ্গীত পরিচালক ও পুরোদস্তুর একজন মিউজিসিয়ান তাঁর গানে ইসলামের কথা বলছেন। সে যুগের আলোকে সেটা কতোটা কঠিন ছিল, তা ভাবতেও সাহস লাগে।
৪. তিনি ব্যক্তি জীবনে কয়টা প্রেম করেছেন, আমি সে আলোচনায় আগ্রহী নই। দিনে কয়টা পান খেতেন, ধর্মীয় রীতি-রেওয়াজ কতটুকু মানতেন; সেটাও আমার কনসার্ন নয়। তাঁর হেয়ার স্টাইল বা মুখের দাঁড়ি না থাকাটাও, সঙ্গত কারণে আমার মাথা ব্যথার বিষয় নয়। আমি আলোকপাত করতে চাই—তাঁর সৃষ্টিকর্ম ও উদ্দেশ্যের উপর। একই সাথে তাঁর উদার চিন্তা ও মানবতাবাদী কর্মকাণ্ডের উপর। সেকালে যে কয়টা বিষাক্ত সাপকে তিনি পেয়েছেন, সবকটাকেই আঘাত করেছেন সাহিত্য, শিল্প, চিন্তা ও ব্যক্তিত্বের প্রতাপে। সাম্রাজ্যবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, কুসংস্কার ও রক্ষণশীলতা নামক চার-চারটা অ্যানাকোন্ডার সাথে তাঁকে লড়তে হয়েছে। সমাজ-সভ্যতা ও ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে তাঁর সেই লড়াইটাই আমার মূল কনসার্ন।
৫. যে লোক জেলে যেতে ভয় পায় না, অনশন করাকে ডাল-ভাত টাইপ কিছু মনে করে, ফাঁসি বা যাবজ্জীবনকে কেয়ার করে না- তাঁকে আর যাই হোক, লোক দেখানো বিপ্লবী বলে ভাবা যায় না। নিজের উদ্দেশ্য ও চিন্তার উপর তিনি যেভাবে অবিচল থেকেছেন, সেটা এই উপমহাদেশে এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। আর সমালোচনা? সেটাকে যেভাবে ইগনোর করে গেছেন, তা করতে গেলে কলিজার দৈর্ঘ-প্রস্থ হিমালয়সমান হওয়া বাঞ্চণীয়। বুদ্ধদেব বসু বলতেন, ‘নজরুল প্রতিভাবান বালক।’ আর শনিবারের চিঠি তাঁকে কী বলত, সেটা উৎসাহী পাঠকরা নিশ্চয়ই জানেন। কলামের পর কলাম, বক্তৃতার পর বক্তৃতা তাঁর বিরুদ্ধে গেছে। তাঁর গান, গল্প, কবিতাকে অনেকেই তাচ্ছিল্য করে উড়িয়ে দিয়েছেন। নজরুল ঘুরেও তাকাননি সেসবের দিকে। অবাক হয়ে ভাবি, কী বিস্ময়কর আত্মশক্তি ও সাহস ছিল লোকটার! কী বলব তাঁকে, কিংবদন্তী? নাহ অনেক কম হয়ে যায়। তাঁর গান গেয়েও তো কতো জন কিংবদন্তি হল। তাঁর সুর, তাঁর কবিতা ফলো করেও তো কতো লিজেন্ডের জন্ম হল। তাহলে তিনি কে? আসলে যে ঠিক কী বলা যায়, তা আমিও ভেবে পাই না।
৬. চাইলেই মানুষটা ব্রিটিশদের তোয়াজ করতে পারতেন। অঢেল অর্থ-বিত্ত হাসিল করতে পারতেন। সাহিত্যে নোবেল পাওয়ার জন্য চেষ্টা-তদবির করতে পারতেন। কলকাতা-ঢাকায় অনেকগুলো বাড়ি বা সে আমলের সেরা সেরা গাড়িগুলো কিনতে পারতেন। যে মেধা ছিল, সেটা বিক্রি করে প্রকাশনী আর প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা আদায় করতে পারতেন। কিন্তু না। যাকে সবাই ক্যারিয়ার বলে জানে, সেটাকে একপ্রকার ছুঁড়ে ফেলে নজরুল বরং বিপজ্জনক-অনিশ্চিত পথটাই বেছে নিলেন। অর্থ কষ্টেই জীবনটা কাটল। জগৎ-সংসারে মানুষ ও সমাজের প্রেমহীনতায় পুড়তে-পুড়তে, শেষে বাকরুদ্ধই হয়ে গেলেন। হয়তো সেটাই অনিবার্য ছিল। পরিণত বয়সের গোড়াতেই স্তব্ধ হয়ে গেলেন। যে মানবতার জন্য আজীবন লড়লেন, সেই মানবতার দোসররাই শেষতক তাঁকে ও তাঁর পরিবারকে চিকিৎসার নামে যে যন্ত্রণা উপহার দিয়েছে- তাও এক ইতিহাস। তাঁর সময়ের সবচেয়ে দ্রোহী, সবচেয়ে পরাক্রমী মানুষটার এমন এক পরিণতি হল, যা বিবেককে প্রশ্নবিদ্ধ করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর, ঢাকায় এলেন। তখন সেই ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকা বৃদ্ধ মানুষটার ভিডিওগুলো দেখলে, আজো অশ্রু সংবরণ করা কঠিন হয়ে যায়। মহাবিদ্রোহী, মহাবিপ্লবী, মহাকবি, মহাসঙ্গীতকার আর সর্বার্থে মহানায়কের সেই নিষ্পাপ চাহনি যে কী বলতে চায়- তার মর্মার্থ বোঝা বড় কঠিন। শুধু জানি, তাঁকে মুছে ফেলা সম্ভব নয়। তাঁকে উপেক্ষা করতে গেলে আরও অনিবার্য হয়ে ওঠেন। অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে লড়বার জন্য অজস্র তরুণের বুকে জেগে থাকেন ধূমকেতূর মতন। যত সময় যায়, ইতিহাস তাঁকে ততোই প্রাসঙ্গিক করে তোলে। শেষ কথা হল- বর্তমান ও ভবিষ্যতে যারা সমাজ নিয়ে কাজ করবেন, যারা দিন বদলের স্বপ্ন রোপন করবেন, যারা অন্যায়-অবিচার-জুলুমের বিরুদ্ধে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির পথে অগ্রসর হবেন; ‘কাজী নজরুল ইসলাম’- অবশ্যই তাদের মেন্টর হয়ে থাকবেন।
লেখক: আরেফিন আল ইমরান, সঙ্গীত পরিচালক
বিডি২৪লাইভ/টিএএফ
বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এডিটর ইন চিফ: আমিরুল ইসলাম আসাদ
বাড়ি#৩৫/১০, রোড#১১, শেখেরটেক, ঢাকা ১২০৭
ই-মেইলঃ [email protected]
ফোনঃ (০২) ৫৮১৫৭৭৪৪
নিউজ রুমঃ ০৯৬৭৮৬৭৭১৯১
মফস্বল ডেস্কঃ ০১৫৫২৫৯২৫০২
বার্তা প্রধানঃ ০৯৬৭৮৬৭৭১৯০
মার্কেটিং ও সেলসঃ ০৯৬১১১২০৬১২
ইমেইলঃ [email protected]
পাঠকের মন্তব্য: