অনলাইনে মুমূর্ষু নুসরাতের বক্তব্য পাই আমার চিকিৎসক স্ত্রীর মাধ্যমে

প্রকাশিত: ৩০ মে ২০১৯, ০৫:৩৯ পিএম

ফেনীর সোনাগাজী মাদরাসা ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছিল মাদরাসাটির অধ্যক্ষ এস এম সিরাজ উদ দৌলার হাতে। এ ঘটনার প্রতিবাদ করতে গেলে থানার ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন তার সঙ্গে আপত্তিকর আচরণ করে। পরে তার পরিবার সিরাজের বিরুদ্ধে মামলা করলে ঘাতক অধ্যক্ষকে গ্রেফতার করা হয়। ওই ঘটনায় মাদরাসার নিয়ন্ত্রণকারী সিরাজের সহযোগী ও অনুসারীরা এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। শেষে তারা সিরাজের নির্দেশে নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যা করে। আর ঘটনাটিকে আত্মহত্যা বলে চালানোর জন্য প্রচারণাও চালায়। এমন পরিস্থিতিতে নুসরাত হত্যা মামলার তদন্তভার নিয়ে পুরো রহস্য উদ্ঘাটন করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। 

বুধবার (২৯ মে) ফেনীর আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিন করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন। নুসরাত হত্যা মামলার তদন্ত করতে পিবিআই মাত্র ৫০ দিনে প্রভাবশালী সব আসামিকে গ্রেপ্তার করে।

জানা গেছে,  দেশব্যাপী আলোচিত এ হত্যা মামলার তদন্তে নেমে খুন এবং তা ধামাচাপা দেওয়ার তথ্য পেয়ে সংকল্পবদ্ধভাবে দলগত তদন্তে নেমেছিল পিবিআই। উন্নত প্রযুক্তি ও ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে সন্দেহভাজন আসামিদের গ্রেপ্তারের মাধ্যমে আদ্যোপান্ত বের করা হয়েছে। মৃত্যুর আগে মুমূর্ষু নুসরাতের হাসপাতালে দেওয়া বক্তব্যকে বিশ্বাস করেই তারা প্রথম পদক্ষেপ নেয়। সেখানেই তারা সফল হয়।

এ বিষয়ে পিবিআই প্রধান, পুলিশের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) বনজ কুমার মজুমদার বলেন, ‘নুসরাতই আমাদের ফেবার করেছে। ওর প্রতিবাদী কণ্ঠের সূত্র ধরেই আমরা এগিয়েছি। ও-ই ছিল সঠিক।’ তিনি বলেন, ‘আমরা সংকল্পবদ্ধ, নুসরাতের মতো নিপীড়নের প্রতিবাদকারীর পাশে আমরা সব সময়ই থাকি। দলগত তদন্তে এমন অপরাধীরা কখনোই রেহাই পাবে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘ঘটনার সময় আমি দেশে ছিলাম না। সংবাদপত্রে ঘটনাটি দেখে ৮ এপ্রিল ছায়াতদন্তের নির্দেশ দিই। ৯ তারিখে কিছুটা খটকা লাগে। মুমূর্ষু নুসরাতের একটি বক্তব্য সামনে আসে। আমার স্ত্রী একজন সচেতন চিকিৎসক। তার মাধ্যমে আমিও অনলাইনে সেটি দেখি। আমি দ্রুত দুজন নারী অফিসারকে হাসপাতালে নুসরাতের কাছে পাঠাই। তাঁরা চেষ্টা করলেন বাড়তি কিছু পাওয়া যায় কি না। কিন্তু পেলাম না। এরই মধ্যে ১০ মে আমরাই তদন্তের নির্দেশনা পেয়ে গেলাম। আইজি স্যার আমাকে ফোন করে বললেন, ‘মামলা বুঝে নিয়ে নেমে পরো। তোমরা পারবে।’ স্বাভাবিকভাবে মামলাটির তদন্ত এগিয়ে নিতে চেয়েছিলাম। তবে ১০ এপ্রিল বিকেল থেকেই চাপ অনুভব করলাম। পরিচিত অনেকেই খবর জানতে চাইছে। আপনারা (সাংবাদিক) জানতে চাইছেন।’

তদন্তটি দলগত হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘১০ এপ্রিলই সবাইকে নিয়ে মিটিং করলাম। সবাই সংকল্পবদ্ধ হলাম। একসঙ্গে নেমে পড়ল ফেনী, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, ঢাকা মেট্রোপলিটন, নরসিংদীসহ কয়েকটি ইউনিট। প্রথমে দ্বিধা নিয়ে শুরু করি। আসলে কী পারব জানি না। আমরা দেখলাম সংকল্পবদ্ধ হয়ে যখন দলগত তদন্ত করা যায় তখন সাফল্য আসে। অপরাধীদের কৌশলের গোড়ায় পৌঁছা যায়। সবাই মনপ্রাণ দিয়ে কাজ করেছে। আমাদের বয়সের সবার ঘরেই হয়তো একজন নুসরাত আছে। আমরা আন্তরিকভাবে কাজটি করেছি।’

তদন্তে কখন আলোর মুখ দেখলেন কিভাবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন দিক তদন্তের পাশাপাশি সন্দেহভাজন আসামিদের ধরতে মাঠে নেমে পড়ি। আমাদের চৌকস অফিসাররা কৌশলে বিভিন্ন স্থানে একযোগে অভিযান চালিয়েছেন। এমনও হয়েছে একজনকে ধরতে তিনজন তিন স্থানে অভিযান চালাচ্ছেন। আমি জানি। তাঁরা কেউ জানেন না। আমরা সৌভাগ্যক্রমে নূর উদ্দিনকে ধরে ফেলি। এর কিছু সময় পরই পাই শাহাদাত হোসেন শামীমকেও।’

তদন্তে প্রকৃত ঘটনা জানতে পেরে চৌকস এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা নুসরাতকে নির্মমভাবে হত্যার কথা শুনে অনেক কষ্ট পেয়েছি। আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই, এমনভাবে তদন্ত করব যেন এই মামলার কোনো আসামি ছাড় না পায়। চারজন পরিদর্শক, তিনজন অ্যাডিশনাল এসপি, একজন এসপি নিরলস পরিশ্রম করে দ্রুত সময়ের মধ্যে ৮০৮ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন তৈরি করেন। এখানকার প্রতিটি অক্ষরের সঙ্গে আমাদের শ্রম, ভালোবাসা আর বিজ্ঞ আদালতের কাছে সর্বোচ্চ শাস্তির আবেদন আছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘আপনাদের (সাংবাদিক) কাছেও কৃতজ্ঞতা। আপনারা সঠিক তথ্য তুলে ধরে আমাদের কাজে সহায়তা করেছেন।’

এদিকে সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রুহুল আমিন, পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাকসুদ আলমসহ কয়েকজন প্রভাবশালীকে গ্রেপ্তারের পর তাঁদের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন দিয়েছে পিবিআই। এতে চাপ অনুভব করেছেন কি না জানতে চাইলে পিবিআই প্রধান বলেন, ‘কোনো চাপই অনুভব করিনি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন—যে-ই জড়িত থাকুক, তাকে আইনের আওতায় আনতে হবে। আমরা সেভাবেই এগিয়েছি। নুসরাতের হত্যাকে ধামাচাপা দিয়ে আত্মহত্যা বলে চালাতে তারা সব ধরনের অপচেষ্টাই করেছে।’

সর্বোচ্চ সাজার প্রত্যাশার ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘এটি একটি দৃষ্টান্ত যে সব আসামিই আদালতে উপস্থিত থেকে নিজ চোখে তাদের বিচার দেখবে। আমরা এটা চেয়েছিলাম। সব আসামিকে গ্রেপ্তার করে আদালতে সোপর্দ করেছি। আবেদন করেছি, যেন তাদের সবার সর্বোচ্চ সাজা হয়।’

 তদন্ত ও সাফল্যের প্রসঙ্গ তুলে বিশেষ ইউনিট পিবিআইয়ের ডিআইজি বনজ কুমার বলেন, ‘২০১২ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর প্রতিষ্ঠা লাভ করে পুলিশের বিশেষ এ ইউনিট। ২০১৫ সালের ১০ জুন থেকে মামলা তদন্তে নামে সংস্থাটি। তবে পরের বছরের ৫ জানুয়ারি থেকে আটঘাট বেঁধে মাঠে নামি আমরা। ২০১৬ সাল থেকে এ বছরের এপ্রিল পর্যন্ত প্রায় ৪৫ হাজার মামলার তদন্তভার দেওয়া হয় পিবিআইকে। সারা দেশের ৪৫টি ইউনিট এখন পুরনো মামলার রহস্য খুঁজে বের করছে। অত্যাধুনিক ফরেনসিক ল্যাবরেটরিতে ফিঙ্গারপ্রিন্টের প্রযুক্তিও যুক্ত করা হয়েছে। মাত্র এক মাস ২০ দিনে নুসরাত হত্যা মামলা শেষ করা আমাদের কাজকে আরো বেগবান করবে।’এর মধ্যে ৪২ হাজারের বেশি মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দিয়েছে সংস্থাটি। আলোচিত মামলার পাশাপাশি ক্লুলেস রহস্যজনক ঘটনারই বেশির ভাগ রহস্য উদ্ঘাটন করেছে পিবিআই। 

বিডি২৪লাইভ/এসএএস

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: