ঢাকায় যেভাবে ছিনতাই হয় গাড়ি

প্রকাশিত: ২২ জুন ২০১৯, ০৬:৫৩ এএম
সিএনজি চালিত অটোরিকশা ও ভাড়ায় চালিত গাড়ির জন্য ঢাকার সড়কগুলো অনিরাপদ হয়ে উঠেছে। ঢাকার বিভিন্ন সড়কে এখন অনেকটা বেপরোয়া গাড়ি ছিনতাইকারী চক্র। প্রতিদিনই ঢাকায় এখন ১৫ থেকে ২০টি গাড়ি ছিনতাই হচ্ছে। ছিনতাইকারীরা প্রকাশ্য দিবালোকে চালকের কাছ থেকে বিভিন্ন কৌশলে গাড়ি ছিনতাই করে নিয়ে যাচ্ছে। পরে মালিকের সঙ্গে যোগাযোগ করে আদায় করছে মোটা অংকের টাকা। তাদের কৌশলের কাছে হার মেনে অনেক চালক নিহত হচ্ছেন। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা অনেক সময় ছিনতাইকারী চক্রের সদস্যদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় নিয়ে আসেন। কিন্তু চক্রের মুলহোতারা থাকেন অধরা। হোতারাই পরে আইনজীবীদের মাধ্যমে জামিনে মুক্ত করে ফের একই কাজে লাগিয়ে দেন চক্রের সদস্যদের। এ কারণে এখন আতঙ্কে আছেন ভাড়ায় চালিত গাড়ির মালিক ও চালকরা। বিভিন্ন সময় আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে আটক হওয়া গাড়ি ছিনতাইকারী চক্রের সদস্যরা গাড়ি ছিনতাইয়ের বর্ণনা দিয়েছেন। এসব বর্ণনা থেকে জানাগেছে, ছিনতাইকারীরা সাধারণত চারটি ধাপে তাদের কাজ করে। মাঠ পর্যায়ে যারা ছিনতাই করে তারামূলত চালকদের কাছ থেকে বিভিন্ন কৌশল যেমন কখনও নির্জন স্থানে নিয়ে মারধর করে আবার কখনও চালককে চেতনানাশক কিছু খাইয়ে অচেতন করে গাড়ি নিয়ে তাদের নির্ধারিত গ্যারেজে রেখে দেয়। এর উপরে যারা থাকেন তাদেরকে বলা হয় মধ্যস্থকারী। তারা ছিনতাই করা গাড়ি থেকে কাগজপত্র সংগ্রহ করে গাড়ির মালিকের সঙ্গে যোগাযোগ করে মধ্যস্থতা করে। মধ্যস্থতাকারীর উপরে আরো দুটি ধাপে কাজ হয়। একটি ধাপে চুরি হওয়া গাড়িগুলোকে ঢাকাসহ আশেপাশের এলাকায় হেফাজতে রাখে। তারা মূলত বিভিন্ন গ্যারেজ মালিক। আর সবার উপরে থাকে ছিনতাইকারীদের সর্দার। সর্দাররা মূলত আয়ের টাকা ভাগবাটোয়ারা, এলাকা নিয়ন্ত্রণ, গ্যারেজ ভাড়া, চক্রে নতুন সদস্য নিয়োগ, জামিনে মুক্ত করা, প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা ও দায়িত্ব বন্টণের কাজ করে থাকে। র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন গত সোমবার ঢাকার দারুসসালাম, ডেমরা ও দক্ষিণখান এলাকায় বিশেষ অভিযান চালিয়ে গাড়ি ছিনতাই চক্রের ছয় সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে। গ্রেপ্তারকৃতরা হলো, মো. হারুন অর রশিদ (২৮), মো. রুহুল আমিন (৩৬), মো.জামাল হোসেন (৬০), মো. সোহেল খাঁ (৪০), ওয়ালী উল্লাহ (২১) ও মো.রশিদ খান (৪৫)। র‌্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে এই ছয় ছিনতাইকারীর কাছে গাড়ির নানা তথ্য উঠে এসেছে। র‌্যাব-৪ অধিনায়ক চৌধুরী মঞ্জুরুল কবির এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, গাড়ি ছিনতাইকারী চক্রের কয়েকজন সদস্য যাত্রী সেজে রাস্তার পাশে দাড়িয়ে থাকে। তারপর তাদের সুবিধামত স্থানের কথা বলে একটি গাড়ি ভাড়া করে রওয়ানা দেয়। যাওয়ার সময় নির্জন কোন স্থানে গিয়ে চালককে মারধর শুরু করে। চালককে বেধড়ক মারধর দিয়ে তাকে রাস্তার পাশে ফেলে দিয়ে সিএনজি নিয়ে তাদের নির্ধারিত গ্যারেজে রেখে দেয়। এছাড়া আরেকটি চক্র আছে যারা শহরের বিভিন্ন চা ও শরবতের দোকানে দাড়িয়ে থাকে। ভাড়ায় চালিত কোন গাড়ির চালক যখন পিপাসা মেটাতে শরবত অথবা চায়ের দোকানে যায় তারা এদেরকে টার্গেট করে। এসব দোকানের মালিকের সঙ্গেও তাদের একটা যোগসাজোশ থাকে। কৌশলে তারা চা বা শরবতের সঙ্গে চেতনানাশক ওষুধ খাইয়ে দেয়। পরে ছিনতাইকারী চক্রের অন্য সদস্যরা এসে ওই চালককে ভাড়া করে নিয়ে যায়। কিছুদুর যাওয়ার পর যখন চালক অজ্ঞান হয়ে যায় তখন চালককে রাস্তার পাশে ফেলে সিএনজি ও তার পাশে থাকা মোবাইল, টাকা ও গাড়ির কাগজপত্র নিয়ে যায়। পরবর্তীতে কাগজপত্র দেখে সিএনজির মালিকের সঙ্গে যোগাযোগ করে টাকার বিনিময়ে সিএনজি ফিরিয়ে দেয়। র‌্যাব আরও জানিয়েছে, এসব চক্রের বাইরে কিছু কিছু গাড়ির চালকরা গাড়ি ছিনতাইকারীদের সঙ্গে যোগসাজোশ করে ছিনতাই করে। অসুসস্থতার ভান করে ওই চালক হাসপাতালে ভর্তি হয়ে মালিককে ফোনে জানায় ছিনতাইকারীরা সিএনজি নিয়ে গেছে। পরবর্তীতে চক্রের অন্য সদস্যরা মালিকের কাছে ফোন দিয়ে বলে তাদের কাছে সিএনজি আছে। টাকা দিয়ে যেন সিএনজি নিয়ে যায়। র‌্যাব-৪ অধিনায়ক মঞ্জুরুল কবির আরও জানিয়েছেন, ঢাকার সড়কগুলোতে সিএনজি অটো রিকশা এখন নিরাপদ নয়। ছিনতাইকারী চক্র দীর্ঘদিন ধরে গাড়ি ছিনতাই করে আসছে। একটি গাড়ি ছিনতাই করে তারা মালিকের কাছ থেকে সর্বনিম্ন ৬৫ হাজার টাকা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ এক অথবা দেড় লাখ টাকা আদায় করে। চাহিদামত টাকা পরিশোধ করা হলে নির্জন কোন স্থানে সিএনজি রেখে মালিককে ঠিকানা জানিয়ে দেয়। তবে টাকা নেয়া ও সিএনজি বুঝিয়ে দেয়ার জন্য ছিনতাইকারীরা নানা কৌশল অবলম্বন করে। গোয়েন্দারা বলছেন, গাড়ি ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িত এমন ২০ থেকে ২৫ টি চক্রের মূলহোতাদের তারা খোঁজছেন। বিভিন্ন সময় চালক ও মালিকদের অভিযোগে তারা অভিযান চালিয়ে অনেক গাড়ি ছিনতাইকারীদের তারা গ্রেপ্তার করছেন। কিন্তু তারা একেবারেই চক্রের মাঠ পর্যায়ে কাজ করেন। তাদের উপরে আরও অনেক ধাপে লোক থাকে। তাই মূলহোতাদের আটক করা সম্ভব হচ্ছে না। এছাড়া ভুক্তভোগী চালক ও মালিকরা থানায় অভিযোগ করছেন না। যদি তারা থানায় অভিযোগ করতেন তবে তদন্ত করে চক্রের হোতাদের শনাক্ত করা যেত। মাঠ পর্যায়ে যাদেরকে গ্রেপ্তার করা হয় তারা নিজেরাই জানেনা তাদের মূলহোতা কে। গাড়ি ছিনতাই চক্র ও গাড়ি চোর নিয়ে কাজ করেন ঢাকার এমন গোয়েন্দারা বলেছেন, তারা একটি তালিকা ধরে কাজ করছেন। বেশ কিছু চক্র ও চক্রের হোতাদের তারা নজরদারিতে রেখেছেন। যারা দীর্ঘদিন ধরে গাড়ি ছিনতাই করছেন। গাড়ি ছিনতাই করে তারা তাদের অর্থনৈতিক অবস্থান পরিবর্তন করেছে। গোয়েন্দাদের কাছ থেকে ঢাকা শহরের বেশ কিছু গাড়ি ছিনতাইকারী চক্রের মুলহোতাদের নাম পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে, মজিবুর, আকতার মোল্লা, কানা শহীদ, মাসুম, গিয়াস, লোকমান, শাহীন, ফারুক, স্বপন, আসলাম, সবুজ, জনি, হোসেন, আবুল, মিন্টু, শিপন, ইয়াকুব, শাহাজাহান, আলমগীর, সেন্টু, লাল মিয়া, কামাল, ফেরদৌস, আলী, আলম, ফরিদ, রনি, জাহিদ, ইদ্রিস, মামুন, রিয়াজ, আজমত, মোস্তফা, রফিক, লিংকন, মুন্না, সালাম, হাশেম, মনোয়ার, রইছ, নুর হোসেন, জলিল, হাফিজ, রহমত, কাশেম অন্যতম। তারা প্রত্যেকেই এক একটি চক্রের সর্দার হিসাবেই পরিচিত। এসব চক্র ছাড়াও আরো নামে বেনামে আরো একাধিক হোতা রয়েছে। প্রতি সর্দারের অধীনে ২০ থেকে ২৫ জন করে সদস্য থাকে। তাদের প্রত্যেকের আলাদা আলাদা কাজ থাকে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা সংস্থা (ডিবি) বলছে, গাড়ি ছিনতাইকারী খুব ভোরে তাদের মিশনে বের হয়। প্রতিটি চক্রের মাঠ পর্যায়ে ৫/৭ জন সদস্য কাজ করে। সর্দাররা সুবিধাজনক বিভিন্ন এলাকায় আগে থেকেই গ্যারেজ ভাড়া করে রাখেন। ধরা পড়ার ভয়ে তারা একাধিক এলাকায় গ্যারেজ ভাড়া করেন। শুধু ঢাকার ভেতরে নয় গাজীপুর, নরসিংদি, নারায়নগঞ্জ এলাকায় গ্যারেজ ভাড়া করেন সর্দাররা। চুরি করা গাড়ি সরাসরি এসব গ্যারেজে নেয়া হয়। কিছু কিছু গ্যারেজের মালিকের সঙ্গে সর্দারদের চুক্তি থাকে। মধ্যস্থতাকারীরা সিএনজিতে থাকা কাগজপত্র থেকে তথ্য নিয়ে মালিকের সঙ্গে যোগাযোগ করে। এক্ষেত্রে মালিককে থানা পুলিশের ঝামেলা যাতে না করে সেজন্য সতর্ক করে দেয়। আর গাড়ীর কন্ডিশন বুঝে মালিকের কাছে টাকার পরিমান বলা হয়। এরপর শুরু হয় দর কষাকষি। বিকাশে অথবা রকেটে টাকা পাওয়ার পর ফিরিয়ে দেয়া হয় গাড়ি। আবার অনেক সময় এসব গাড়ির নম্বর প্লেট পরিবর্তন করে ভুয়া নম্বর প্লেট ও কাগজপত্র তৈরি করে বিক্রি করে দেয়া হয় মফস্বল এলাকায়। চুরি করা গাড়ি মালিকের কাছে ফিরিয়ে দিয়ে অথবা বিক্রি করে যে আয় হয় তার ভাগ সবাইকে দেয়া হয়। এছাড়া ওই টাকা থেকে একটি অংশ সর্দাররা রেখে দেন। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে যদি কোন চোর ধরা পড়ে তবে সেই টাকা দিয়ে তাদের জামিনের ব্যবস্থা করা হয়। ডিবি আরো বলছে, গাড়ি ছিনতাইকারীদের সঙ্গে অনেক সময় নকল চাবি থাকে। কিছু কিছু চাবি দিয়ে একাধিক গাড়ির লক খোলা যায়। ফলে কোন না কোন চাবি দিয়ে তারা লক খুলতে সক্ষম হন। বিশেষ করে মোটরসাইকেল, প্রাইভেট কার, মাইক্রো চুরির ক্ষেত্রে তারা এসব নকল চাবি ব্যবহার করে। এক্ষেত্রে তারা আগে থেকেই গাড়ি টার্গেট করে রাখে। ভুক্তভোগী সিএনজি মালিক খিলগাঁর আনোয়ার হোসেন বলেন, আমার তিনটি সিএনজি কয়েক বছর ধরে ঢাকায় চলাচল করে। তিনটি সিএনজির মধ্যে দুটি সিএনজি চারবার ছিনতাইকারীর কবলে পড়েছে। এই চারে বারে আমার প্রায় দুই লাখ টাকা দিতে হয়েছে। ভেবেছিলাম থানায় অভিযোগ করব। কিন্তু বাড়তি ঝামেলা দেখে আর অভিযোগ করি নাই। ছিনতাইকারীরা মোবাইল ফোনে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল পরে তাদের কথামত স্থানে টাকা রেখেছি। সিএনজি ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য তারা বেশ কয়েকটি স্থানের ঠিকানা দিয়েছিল। পরে উত্তরার একটি স্থান থেকে সিএনজি উদ্ধার করে এনেছি। আরেক ভুক্তভোগী মুগদা এলাকার শাহীন বেপারী বলেন, ছিনতাইকারী যোগাযোগ করে বলে থানা পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করলে সিএনজির পার্টস আলাদা আলাদা করে বিক্রি করে দেবে। আর তাদের কথামত কাজ করলে অক্ষত অবস্থায় সিএনজি পাওয়া যাবে। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, ঢাকায় নম্বর প্লেটসহ সিএনজির দাম বেড়ে যাওয়ায় ছিনতাইকারীরা সিএনজি ছিনতাই করে। মালিকরাও মনে করেন কিছু টাকা খরচ করে যদি সিএনজি ফিরে পাওয়া যায়। এছাড়া কিছু কিছু মালিক ডিজিটাল নম্বর প্লেট ব্যবহার করছেন না। তাই এ সুযোগটাও ছিনতাইকারীরা নিচ্ছে। সূত্র: মানবজমিন

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: