‘ঈদত সকাল থাকি না খ্যায়া আছি দুপরে কি খামো জানিনা’

প্রকাশিত: ০১ আগষ্ট ২০২০, ১১:৩৫ পিএম
মোঃ মাসুদ রানা, কুড়িগ্রাম থেকে: আজ পবিত্র ঈদুল আযহা। ঈদের খুশিতে যখন সবাই ব্যস্ত বাহারী ভোজ বিলাসের আয়োজনে। যখন বাড়িতে বাড়িতে নানা প্রকার খাবার খেয়ে দিন অতিবাহিত করছেন মানুষজন। বাড়িতে বাড়িতে চলছে গবাদি পশু কোরবানীর ধুমধাম। তখন সেই ঈদের দিনটিতে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত না খেয়ে দিন কাটাচ্ছে মা অবিনাম (৮০) ও মেয়ে ময়না (৫৫)। তারা দুজনই বিধবা। মা অবিনাম পেশায় একজন ভিক্ষুক ও মেয়ে ময়না পেশায় একজন দিনমজুর। তাদের বাড়ী কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার পাঁচগাছী ইউনিয়নের নওয়াবস পাড়া গ্রামের গড়ের নামক এলাকায়। শনিবার (১ আগষ্ট) দুপুর ২টায় সরেজমিনে গিয়ে জেলা সদরের পাঁচগাছি ইউনিয়নের নওয়াবস পাড়ার নদীরক্ষা বাঁধে আশ্রয় নেয়া বানভাসী অবিনাম ও ময়না সহ অনেকেই না খেয়ে দিন অতিবাহিতের এমন চিত্র দেখা যায়। জানা যায়, অবিনাম ও ময়না মা মেয়ে সম্পর্ক। মা অবিনাম ও মেয়ে ময়না দুজনই বিধবা। সংসারে তাদের আর কেউ নেই। তাদের নেই কোন আবাদী জমি। অবিনাম ভিক্ষা করেন। মেয়ে ময়না পেশায় একজন দিনমজুর। এক দিকে করোনার কারনে মায়ের ভিক্ষা ও মেয়ের দিনমজুরের কাজ বন্ধ। অন্যদিকে এক মাসেরও বেশী সময় ধরে বাড়ি ঘর বন্যার পানিতে তলিয়ে থাকায় কর্মহীন হয়ে পড়া মা মেয়ে আশ্রয় নিয়েছেন নদী রক্ষা বাঁধে। খেয়ে না খেয়ে, অনাহারে, অর্ধাহারে দিন কাটছে তাদের। আজ ঈদের দিনে যখন বিভিন্ন এলাকার মানুষজন বাহারী খাবারের আয়োজনে ব্যস্ত। তখন মা অবিনাম ও ময়না সকাল থেকে না খেয়ে আছেন। দুপুরে কি খাবে জানা নেই তাদের। তাদের মত নদী রক্ষা বাঁধে আশ্রয় নেয়া অনেকেরই একই পরিস্থিতি বলে জানা যায়। অবিনাম জানান, "বাড়িত এক মাসের বেশী সময় ধরি পানি। ঘর তলে গেইছিলো বানের পানিত। এই গড়ের পাড়ত আসি আছি। আইজ ঈদের দিন সকাল থাকি না খ্যায়া আছি দুপরে কি খামো জানি না। কোন ঈদত হামাক কাইয়ো এক টুকরা গোশত দেয় না। হামরা গরীব মানুষ। হামার খোঁজ কাইয়ো নেয় না"! অবিনামের মেয়ে ময়না জানান, এক মাসের ও বেশী সময় ধরে বাড়িতে পানি। গড়ে আশ্রয় নিয়েছি। সকাল থেকে না খেয়ে আছি। দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে কি খাব জানিনা। দীর্ঘ বন্যায় নামে মাত্র ৮-১০ কেজি চাউল পেয়েছি আবু মেম্বারের কাছ থেকে। তা দিয়ে কয় দিন খাবো। বন্যার এ কয়দিনে ৮-১০ কেজি চাউল সেটাও শেষ হয়ে আছে মাত্র আর তিন পোয়া। সেটা রান্না করলে আর খাওয়ার কিছুই থাকবেনা। এই তিন পোয়া চাউল রান্না করলে কি দিয়ে খাব। কোন তরকারী তো নেই। দিন মজুরের কাজ করে খাই। এক দিকে করোনার কারনে তিন-চার মাস কাজ বন্ধ ছিলো। তার মধ্যে দুই মাস ধরে বানের পানির কারনে অন্যের জমিতে দিন মজুরের কাজ বন্ধ। আমাদের মত গরীব মানুষদের খোঁজ খবর কেউ নেয় না। একই এলাকার সিরাজুল ও সালমা জানান, পানি না থাকলে জমিতে কাজ করেন ময়না। দিনমজুরের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। কিন্তু করোনা ও বন্যার কারনে সেটাও বন্ধ। একই নদী রক্ষা বাঁধে আশ্রয় নেয়া জামিলা জানান, সকালে পানতা ভাত খেয়েছি। দুপুরে কিছুই খাইনি। স্বামী পঙ্গু। আমার দুই ছেলে বিয়ে করে আলাদা হয়েছে। ঐ এলাকার বাঁধে আশ্রয় নেয়া তাহমিনা ও আমেনা জানান, আমরা এই বন্যায় এক কেজি চাউল ও পাইনি। ত্রানের জন্য চেয়ারম্যান মেম্বারের নিকট অনেক গিয়েছি। কোন প্রকার সহযোগীতা পাইনি। স্থানীয় ইবরাহিম ও কচিনা জানান, এলাকায় সবাই অভাবী। আমাদের কেউই কোন বছর কোরবানীর মাংস দেয় না। আমরা সামর্থ্য হলে কিনে খাই। না হলে খাই না। আজ ঈদের দিন আমাদের কারোর বাড়িতে এক টুকরো গোশত নেই। অনেকেই না খেয়ে আছি। কুড়িগ্রাম সদরের পাঁচগাছী ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান মোঃ দেলওয়ার হোসেন জানান, কি করবো বলেন। একজন দুইজন হলে ব্যবস্থা নেয়া যায়। এরকম অসংখ্য বন্যার্ত মানুষ চুলা জ্বালাতে না পেরে না খেয়ে আছে। প্রথমে সাড়ে ৭শ লোককে ত্রান দিলাম। পরে দিলাম সাড়ে ৩শ লোককে। যা দেওয়ার তা তো দিয়েছি। আমার আর কিছুই করার নেই। এ বিষয়ে জানতে পাঁচগাছী ইউনিয়নের ০১নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মোঃ আবু বকরের সাথে মুঠো ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে যোগাযোগ সম্ভব হয়নি। উল্লেখ্য যে, কুড়িগ্রামে নদ-নদীর পানি কমে গিয়ে জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও দুর্ভোগে রয়েছে বন্যা কবলিতরা। ব্রহ্মপুত্র ও ধরলার পানি এখনও বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় অনেক ঘর-বাড়ি থেকে পানি নেমে যায়নি। আবার অনেকে পানি নেমে যাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্থ ঘর-বাড়িতে ফিরতে শুরু করলেও দুর্ভোগে পড়েছেন তারাও। বন্যা কবলিত এলাকার মানুষজন আক্রান্ত হচ্ছে ডায়রিয়া, চর্মরোগসহ নানা পানি বাহিত রোগে। বন্যা কবলিত এলাকায় সরকারী-বেসরকারী ত্রাণ তৎপরতা অব্যাহত থাকলেও তা সবার ভাগ্যে জুটছে না। এদিকে দীর্ঘ মেয়াদী বন্যায় খাদ্য ও অর্থ সংকটে মলিন হয়ে গেছে চরাঞ্চলের বন্যা দুর্গত মানুষের ঈদের আনন্দ। একবেলা খেয়ে না খেয়ে দিন পাড় করা এসব মানুষের ভাগ্যে এবার জুটবে না কোরবানীর মাংসও। কুড়িগ্রাম সদরের পাঁচগাছী ইউনিয়নের নওয়াবস গ্রামের গড়ের পাড় নামক এলাকায় আশ্রয় নেয়া বানভাসী মা ও মেয়ে অবিনাম ও ময়নার মতো অনেকে আজ ঈদের দিনে না খেয়ে দিনাতিপাত করছেন। অনেকের ভাগ্য জোটেনি কোন প্রকার ত্রান সহায়তা। ঈদের দিনেও এসব পরিবারে নেই কোন ভালো খাবারের আয়োজন। কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক মো: রেজাউল করিম জানান, জেলার বন্যা কবলিতদের জন্য সরকারীভাবে ত্রাণ সহায়তা অব্যাহত রয়েছে। ঈদের আগে জেলার ৪ লাখ ২৮ হাজার ৫শ ২৫ পরিবারকে ১০ কেজি করে ভিজিএফ’র চাল দেয়া হয়েছে। প্রয়োজন অনুযায়ী আরো খাদ্য সহায়তা দেয়া হবে।

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: