‘আমি সেই নেতার নখ ভক্ত’

প্রকাশিত: ২৯ আগষ্ট ২০২০, ০২:২৩ পিএম
একজন ফুটবলার হিসেবে মেসি গ্রেটদের কাতারে- একথা জানতে ও মানতে আপনাকে ফুটবল বিশেষজ্ঞ বা বিশ্লেষক হতে হবে না। ইনিয়েস্তা-জাভি সময়ে দীর্ঘ ক্লাব ক্যারিয়ারে সকল ট্রফি-ই বাক্স বন্দি করেছে এই আর্জেন্টাইন। কিন্তু একজন দলনেতা মেসিকে ফুটবলার মেসির সামনে দাঁড় করালে আপনি হয়তো দেখবেন ভীতু এবং চাপের মধ্যে নিজেকে অতল গহ্বরে হারিয়ে ফেলা একজন পরাজিত সাধারণ খেলোয়াড়কে। বার্সা থেকে ইনিয়েস্তার বিয়োগের দিন থেকেই মূলত দলনেতার আর্মব্যান্ডটি মেসির বাহুতে উঠে। তারপর থেকেই একজন দলনেতা হিসেবে বরাবর নিজেকে প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে মেসি। অধিনায়কের চাপ হয়তো ৩৩ বছর বয়সী মেসির খেলার মাঝেও প্রভাব ফেলেছে বারবার। কাতালোনিয়ায় যখন হারের বৃত্ত ভেদ করার চেষ্টা চলছে, তখনই হঠাৎ-ই বিশ্বে ট্রেন্ডিং 'বার্সা ছাড়ছেন মেসি'। গত ৭ বছরের যেটি নিয়মিত ঘটনা, সেখানে এবার যেন একটু বাড়াবাড়ি। বাড়াবাড়ি ঠিক না, এবার মেসি স্বয়ং জানিয়ে দিয়েছেন 'আর থাকছি না'। ঘটনা শেষ পর্যন্ত সত্যি হলে একজন ফুটবল সমর্থক হিসেবে আমার জন্য ব্যাপারটি পীড়াদায়কই বটে। মেসি চলে যাচ্ছেন তার থেকে বেশি পীড়াদায়ক ক্লাবের অন্ধকার সময়ে যখন মেসির মতো খেলোয়াড়দের হাতে টর্চ থাকার কথা, তখন তিনি টর্চ ফেলে উল্টো পথে হাঁটছেন। সব ছেড়ে নতুন সূচনার চিন্তা করছেন। যা এতদিন জাভি-ইনিয়েস্তা সামাল দিয়ে এসেছেন। সেখানে পুরোপুরি ব্যর্থ ক্লাবটির সর্বকালের সেরা ফুটবলার! আমি একজন রোনালদো'র নখ ভক্ত। 'নখ ভক্ত' দ্বারা তার প্রতিটি জিনিসের প্রতি আমার অন্ধ ভালোবাসাটা হয়তো বুঝাতে চেয়েছি। মেসির নাম আসলে সেখানে রোনালদো আসবে না, সেটা যেন ফুটবলের প্রতি অবিচার। সুযোগটা যে তাদের অন্ধ ভক্তদের বানানো এমনটা মনে করার কারণ নেই। এই দুই ফুটবলারই সে সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। ব্যক্তিগত অর্জনে মেসি রোনালদো সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে তা নিয়ে কোনো সন্দেহ না থাকলেও একজন দলনেতা মেসি রোনালদোর থেকে কয়েক লক্ষ যোজন পিছিয়ে। রোনালদো রিয়ালে যোগ দেয়ার পর বার্সার সাথে খেলায় রিয়াল একবার ৫ গোল খেয়েছিল, খেলায় ৫ গোল খাওয়ার পরও শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত রোনালদোর ডেডিকেশান এবং ক্ষীপ্রতা এক বিন্দু কমেছিল বলে আমার চোখে পড়েনি। লা ডেসিমা স্বপ্নে বিভোর রিয়াল যখন বায়ার্নের সাথে বিদায় নিল, পরের বছর পুরো দল নিয়ে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিলেন রোনালদো। তবুও হলো না, এবার বাঁধা ডর্টমুন্ড। এসময় পুরনো ক্লাব ম্যানইউতে ফেরার অসংখ্য প্রস্তাব পাওয়া রোনালদো থেকে গেছেন, দলকে নিয়ে জেতার ছক এঁটেছেন। পরের বছর ধরা দেয় স্বপ্নের ট্রফি। ইউরোর ফাইনালে ভাঙা পা নিয়ে মাঠ থেকে উঠে যাবার পর ক্যাপ্টেন হিসেবে সাইড লাইনে দাঁড়িয়ে তার উত্তেজনাটাও আমার দেখা। কিভাবে নিজের হাত কামড় দিয়ে নিজেই ছুটিয়ে ফেলছিলেন তাও আমার দেখা। ফাইনালের আগে কোয়ার্টার ফাইনালে পেনাল্টি শুট আউটে যখন জাও মোতিনিয়ো ভয়ে কাঁপছে, পেনাল্টি নিতেও অপারগতা প্রকাশ করে জাপ। তখনই আত্মবিশ্বাস জাগানো রোনালদোর কথাগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল। পরিণামে সেই পেনাল্টিতে গোল পায় জাও। ইউরো জিতে কিংবদন্তীর আসনটি পাঁকাপোক্ত করা ক্যাপ্টেন রোনালদোর ড্রেসিং রুমের কথাগুলো এখনও গায়ে কাটা তোলে। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো'কে ম্যানইউ'র টাইম থেকেই পছন্দ হবার একটাই কারণ, সে মাঠে কাঁদে, সে জেতার জন্য লড়াই করে, সে শুধু একা খেলেনা, দলের খারাপ সময়ে দর্শকদের খেলার মাঝে নিয়ে আসে। দু'হাত তুলে পুরো স্টেডিয়ামে কিংবা সান্তিয়াগো বার্নাব্যূতে গণজাগরণ সৃষ্টি করে। জেতার জন্য তার ক্ষিদাটা সে মাঠেই দেখায়। হয়তো মেসি সেটা উপরে কিংবা মাঠে দেখান না। তাই বলে তার জয়ের ক্ষিদা নাই এমনটা নয়। কিন্তু টিম স্পিরিট জোগানোর ক্ষেত্রে মেসির চেয়ে রোনালদো এভারেস্ট চূড়ার সমান উচ্চতায় এগিয়ে। গত পাঁচ বছরে চ্যাম্পিয়নস লীগে মেসির নীরব ভুমিকা অন্তত তাই বলে। এবারই বায়ার্নের সাথে প্রথমার্ধেই ৪ গোল খাওয়ার পর টানেলে একা বসে দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া মেসিকে দেখে খারাপ লাগে। না মেসির জন্য নয়। ক্লাবটির জন্য। তাদের একজন অধিনায়ক প্রয়োজন ছিল সেদিন। একজন রামোস, যে দলের জন্য মাঠে খুন করতেও পারবে বলে আমার বিশ্বাস। অন্যদিকে, ২০১৬ সালে রোনালদোরা যখন উলভসবার্গের সাথে ২-০ গোলে পিছিয়ে। তখনই রোনালদো নিজ কাঁদে দায়িত্ব তুলে নেন। পরের লেগে একাই ৩ গোল করে দলকে শুধু পরের রাউন্ডেই তুলেন নি ওই ম্যাচে প্রতি গোলের পর রোনালদোর একেকটা উচ্ছ্বাস আপনাকে চিৎকার করে বলতে বাধ্য করবে, 'রোনালদো তুমিই সেরা, তুমি একজন জাত লিডার'। এমন অসংখ্য ঘটনা আছে যেখানে মাঠে রোনালদোর প্রভাব নিয়ে লিখতে গেলে হয়তো আরও কয়েকশ শব্দের প্রয়োজন। কিন্তু সেটি আমাকে মেসির বিষয়টি থেকে আরও দূরে নিয়ে যাবে। ক্যাসিয়াস, পুয়োল, রোনালদো, রামোসরা শুধু খেলোয়াড় না। তারা দলের অধিপতি। ক্যাপ্টেন্সি ব্যাপারটিকে তারা অন্য এক উচ্চতায় নিয়ে গেছে। রোনালদো যখন ম্যানইউ ছাড়েন, তখন তরুণ রোনালদোর দল টানা ৩ টি ঘরোয়া লীগ জিতেছে, যেদিন রিয়াল ছাড়েন, সেদিন রিয়ালের খাঁচায় টানা ৩ টি চ্যাম্পিয়নস লিগ বন্দি। ইতালির জুভেন্টাসে গিয়ে যে নিজের দলনেতা চরিত্রে দাগ পড়েছে এমনটি নয়। এখনও ৩৫ বছর বয়সী রোনালদো একাই ডিয়াগো সিমিয়নীকে লজ্জা দিয়ে নিজ দলকে পরের ধাপে নিয়ে যায় একজন সত্যিকারের নেতার মতোই। আমার রাইভাল ক্লাবের দুঃসময়ে মেসির ক্লাব ছেড়ে যাওয়ার যে তাড়না তার হয়তো যুক্তি মেসির কাছে থাকবে। তার কাছে তিনি হয়তো সঠিক। কিন্তু মেসিদের মতো খেলোয়াড়ের এভাবে চলে যাওয়া ফুটবলের সৌন্দর্য নষ্ট করে। মেসিদের চরিত্রে দাগ ফেলে। একদিন আমিও বুড়ো হবো আমারও চামড়া জড়িয়ে আসবে। এখনকার মতো তখনও চোখে থাকবে চশমা তবে কাঁচের ক্ষমতা হয়তো আরও বেড়ে যাবে। সেদিনও মাঠে ফুটবল হবে। সবুজ গালিচায় সেদিনও কেউ বুলিয়ে যাবেন পায়ের জাদুর স্পর্শ। সেদিনও মুগ্ধ হবো আমি। কিন্তু ভুলতে থাকা মস্তিষ্কে সেদিনও থেকে যাবে অনেক আগে দেখা এক সিনেমার কথা, যে গল্পের নায়ক শুধুই রোনালদো। গডফাদারের একটি ডায়লগও হয়তো মনে পড়বে, “Great men are not born great, they grow great” আমি তখনও চিৎকার করে বলবো, ‘ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো ছিল একজনই! আমি সেই নেতার নখ ভক্ত'

(খোলা কলামে প্রকাশিত সব লেখা একান্তই লেখকের নিজস্ব মতামত। এর সাথে পত্রিকার কোন সম্পর্ক নেই)

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: