৪০ মিনিটে সব ওলটপালট!

প্রকাশিত: ১৩ নভেম্বর ২০২০, ০৫:৪৪ পিএম
মরিয়ম চম্পা: সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার আনিসুল করিম শিপনের মৃত্যুর পরও স্বাভাবিক ছিল ওরা। ঘটনার পরপরই ঘটনাস্থলের ভিডিও ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এতে ৪০ মিনিটের মধ্যেই সব ওলটপালট হয়ে যায়। ৭ দিনের পুলিশি রিমান্ডে থাকা ১০ আসামি এমনই চাঞ্চল্যকর তথ্য জানিয়েছে তদন্ত কর্মকর্তাদের। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এএসপি আনিসুলকে হত্যার পরেও হত্যায় অংশ নেয়া রাজধানীর আদাবরে অবস্থিত মাইন্ড এইডের ১০ কর্মচারীসহ হাসপাতালের সকলেই ছিল স্বাভাবিক। তারা এই হত্যাকাণ্ডের ভিডিও ভাইরাল হওয়ার আগ পর্যন্ত নিশ্চিত ছিল এটাকে কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট বলে চালিয়ে দেবে। তারা প্রত্যেকেই হাসপাতালে যে যার স্বাভাবিক কাজকর্ম করছিলেন। সূত্র জানায়, জিজ্ঞাসাবাদে মারধরে অংশ নেয়া একাধিক আসামি জানায়, এই ঘটনায় এএসপি আনিসুলের মৃত্যু হবে সেটা তারা বুঝে উঠতে পারেনি। কারণ, মানসিক রোগীদের আমরা এভাবেই নিয়ন্ত্রণ করে থাকি। এটাই আমাদের সিস্টেম। এর আগেও একাধিক রোগীকে একই কৌশলে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। কিন্তু কারো মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি। কোনো রোগী প্রাথমিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লেও পরবর্তীতে সুস্থ হয়ে যেতেন। এটাই প্রথম এবং একমাত্র হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে মাইন্ড এইডে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমাদের আশ্বস্ত করেছিল এটা নিয়ে খুব বেশি বাড়াবাড়ি হবে না। কিন্তু মাত্র ৪০ মিনিটের ব্যবধানে পুলিশ সদস্যের মৃত্যুর ভিডিওটি নেট দুনিয়ায় ভাইরাল হয়ে যায়। পরবর্তীতে যখন আমরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, ইউটিউব এবং টেলিভিশনের মাধ্যমে ভিডিওটা প্রথম দেখি তখন এক ধরনের আতঙ্ক তৈরি হয়। তখন আমরা হাল ছেড়ে দেই। এসময় আমরা প্রত্যেকেই আলাদাভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঢাকার বাইরে আত্মগোপনে যাওয়ার পরিকল্পনা করি। এ সময় হাসপাতালের পরিচালনা পর্ষদ এবং ৭ জন মালিক সকলেই আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। এএসপি আনিসুলকে হত্যার ভিডিও হাসপাতালের কেউ একজন ভাইরাল করেছে বলে জানায় গ্রেপ্তারকৃতরা। সূত্র জানায়, হাসপাতাল ভবনের মালিক জাফর আহমেদ মারা যাওয়ার পর ২০১৯ সালে তার ছেলেদের কাছ থেকে ৭ ব্যক্তি মিলে ভবনটিকে ভাড়া নিয়ে মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্র এবং মানসিক হাসপাতাল হিসেবে কার্যক্রম চালু করেন। হাসপাতালটিতে কার কতোটুকু শেয়ার ছিল, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতি কেন নেয়া হয়নি, অনুমতি না নিয়েই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কাজ কেন শুরু করেছে, কার নির্দেশনায় এবং পরিচালনায় হাসপাতালটি মূলত চলছিল এবং লভ্যাংশের কে কতটুকু পেতেন এসব বিষয় খতিয়ে দেখছে পুলিশ। এ ছাড়া হাসপাতালে কি কি আছে এবং কোন ক্ষমতা ও আদেশ বলে তারা ডায়াগনস্টিক সেন্টার বা মাদক নিরাময় কেন্দ্র চালিয়েছে, হাসপাতালের ফায়ার সার্ভিস লাইসেন্স, সিটি করপোরেশন লাইসেন্স, ট্রেড লাইসেন্স আছে কিনা এসব বিষয়ে যেটার ঘাটতি আছে সেখানটাতেই ধরা হবে। ভবিষ্যতে এরকম অবৈধ হাসপাতাল যেন নতুন করে চালাতে না পারে সে বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এবং এ বিষয়ে তাদের প্রত্যেককে পৃথকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে চলে জানায় সূত্রটি। সূত্র আরো জানায়, হাসপাতালের মালিকদের পেছনে কোনো রাজনৈতিক প্রভাবের সংশ্লিষ্টতা এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। হাসপাতালের ৭ জন মালিকের মধ্যে তিনজন চিকিৎসক। ডা. নিয়াজ মোর্শেদ, ডা. ফাতেমা ময়না এবং আব্দুল্লাহ আল মামুন। প্রাথমিক পর্যায়ে তারা নিজেরা পরিকল্পনা করে যে একটি মানসিক চিকিৎসালয় বা হাসপাতাল চালু করবে। এবং এর লভ্যাংশ যে যতটুকু বিনিয়োগ করবে সে অনুযায়ী পাবে। অংশীদারদের কেউ ২০ লাখ, ১০ লাখ এবং পাঁচ লাখ, তিন লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছে। ভবনের মালিকের পক্ষ থেকে ম্যানেজার বকুল নামে এক ব্যক্তি দেড় লাখ টাকা মাসিক ভাড়ায় ভবনটি ভাড়া দেয় তাদের কাছে। হাসপাতালের মালিকদের অপর চারজনের একজন মো. রেদোয়ান সাব্বির আহসানউল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয়ে তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। তার ব্যক্তিগত আয়ের উৎস বলতে কিছুই নেই। তারপরেও হাসপাতালটিতে তার পাঁচ লাখ টাকার শেয়ার রয়েছে। কো-অর্ডিনেটর রেদোয়ান সাব্বির ডা. নিয়াজের ছোট ভাই। মাইন্ড এইড সাইকিয়াট্রি অ্যান্ড ডি-অ্যাডিকশন হাসপাতালের অংশীদার সাজ্জাদ আমিনের গাজীপুরে গার্মেন্টসের এক্সেসরিজের ব্যবসা আছে। এ ছাড়া সুইডেন প্রবাসী সাখাওয়াত হোসেন রিমন ও মার্কেটিং ম্যানেজার আরিফ মাহমুদ জয় তিতুমীর কলেজ থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। আনিসুলের বড় ভাই রেজাউল করিম বলেন, আনিসুল করিম শিপন দুই ভাই ও দুই বোনের মধ্যে সবার ছোট ছিলেন। বাবা ফাইজুদ্দিন আহমেদ বীর মুক্তিযোদ্ধা। গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার সম্মানিয়া ইউনিয়নের আড়াল গ্রামে তাদের বাড়ি। তবে তারা গাজীপুর সিটি করপোরেশনের বরুদা এলাকায় প্রায় ৪০ বছর যাবৎ বসবাস করছেন। কাজী আজিম উদ্দীন কলেজ থেকে এইচএসসি উত্তীর্ণ হয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাণ রসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের ৩৩তম ব্যাচে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। তিনি ৩১তম বিসিএসে পুলিশের চাকরিতে যোগ দেন। ২০১১ সালে আনিসুল করিম শিপন বিয়ে করেন শারমিন সুলতানাকে। তাদের একমাত্র ছেলে চার বছর বয়সী সাফরান। তিনি বলেন, আনিসুল খুব চাপা স্বভাবের ছিল। পেশাগত এবং ব্যক্তিগত কারণে মানসিকভাবে অনেক চাপ নিলেও তিনি কখনো কাউকে কিছু বলতেন না। গত কয়েকদিন ধরে তার কিছুটা মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। ও আমাদের খুব আদরের ছিল। কোনো সমস্যায় থাকলেও কাউকে কিছু বলতো না। কিছুটা মানসিক অবসাদের মধ্যে ছিল হয়তো। সোমবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে তাকে নিয়ে ঢাকার আদাবর এলাকার মাইন্ড এইড হাসপাতালে যায় তারা। আনিসুল করিমের বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা ফাইজুদ্দিন আহমেদও পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন। তার চার সন্তানের মধ্যে সবার ছোট ছিলেন আনিসুল। তিনি বলেন, গত বৃহস্পতিবার হঠাৎ করে আনিসুলকে চুপচাপ থাকতে দেখেন তার স্ত্রী বাবাকে ফোন করে বরিশালে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করলে আনিসুলের শ্বশুরকে নিয়ে বাবা বরিশাল যান। আনিসুলের সিনিয়র স্যাররা পরামর্শ দেন ঢাকায় চিকিৎসা নিলে এবং পরিবারের সঙ্গে থাকলে হয়তো ভালো লাগবে তার। পরবর্তীতে অফিস থেকে সে দশ দিনের ছুটি নেয়। গত ১৫ই সেপ্টেম্বর বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশে আসার পরই ট্রাফিক বিভাগের সহকারী কমিশনারের দায়িত্ব পান আনিসুল। আনিসুলের পারিবারিক সূত্র জানায়, এএসপি আনিসুল তার স্ত্রী ও সন্তানকে নিয়ে বরিশাল নগরীর বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে একটি ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকতেন। সহকর্মীরা তাকে সৎ ও দায়িত্বশীল কর্মকর্তা হিসেবে চিনতেন। আনিসুলের এমন মৃত্যুকে কোনোভাবে মানতে পারছেন না সহকর্মীরা। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আদাবর থানার পরিদর্শক মোহাম্মদ ফারুক মোল্লা বলেন, এটি প্রকৃতই একটি হত্যাকাণ্ড। শুধুমাত্র বাংলাদেশে নয়, ইন্টারনেটের সুবাদে ঘটনাটি আন্তর্জাতিকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে এবং ভাইরাল হয়েছে। এ ছাড়া হাসপাতালটিতে স্বাস্থ্য বিভাগ, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরসহ হাসপাতাল চালানোর মতো কোনো বৈধ কাগজপত্র, প্রশিক্ষিত জনবল ছিল কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সূত্র: মানবজমিন।

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: