আইনের সঠিক প্রয়োগ না থাকায় বাড়ছে ধর্ষণ

প্রকাশিত: ২৩ জানুয়ারি ২০২১, ০৮:০০ পিএম
২০২০ সাল করোনা মহামারির মধ্যেই পুরো বছর জুড়ে আলোচনায় ছিলো ধর্ষণ ও নির্যাতনের ঘটনা। ধর্ষণ থামাতে সরকার আইনের সর্বোচ্চ শাস্তি বাড়িয়ে মৃত্যুদণ্ডের বিধান করলেও দেশের বেসরকারি সংগঠনগুলোর পরিসংখ্যান অনুযায়ী এই অপরাধ বেড়ে যাওয়ার তথ্যই উঠে এসেছে। ২০২০ সালের শুরুতেই রাজধানীর কুর্মিটোলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী ধর্ষণের শিকার হন। এই ঘটনায় ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উত্তাল হয়ে ওঠে। এরপর সিলের এমসি কলেজে স্বামীকে বেধে রেখে ছাত্রাবাসে পালাক্রমে ধর্ষণ করেন সাইফুর রহমানের নেতৃত্বে কয়েকজন ছাত্রলীগকর্মী। এই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই নোয়াখালীতে এক গৃহবধূকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়। বিভিন্ন স্থানে ধর্ষণের ঘটনায় গণআন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার নারী ও শিশু নির্যাতন আইন, ২০০০ এর কয়েকটি ধারা সংশোধন করে। এর মধ্যে অন্যতম হলো— ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড অথবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। আগের আইনে ধর্ষণের শাস্তি ছিল যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। বিশ্লেষকরা মনে করেন শুধু আইন বাড়িয়ে ধর্ষণ কমানো সম্ভব নয়। অপরাধ করে মানুষ যে ভাবে পার পেয়ে যাচ্ছে। যারা অপরাধ করছে তাদেরকে শাস্তির আওতায় আনতে পারছি না, শাস্তি দৃশ্যমান করতে পারছি না, অপরাধীর মনের মধ্যে ভীতি সঞ্চার করতে পারছি না, আইনের শাসন পুরোপুরি প্রতিষ্ঠা করতে পারছি না। আইন থাকলেও এর সঠিক প্রয়োগ হচ্ছে না। এজন্য তারা অপরাধে জড়িয়ে পরছে। নারী ও শিশুদের অধিকার নিয়ে কাজ করে এমন কয়েকটি বেসরকারি সংগঠনের তথ্য মতে আইন বাড়লেও কমেনি ধর্ষণ নির্যাতনের ঘটনা। এমনকি দেখা যায় করোনার মধ্যে আরও বৃদ্ধি পেয়েছে ধর্ষণ নির্যাতনের ঘটনা। তারা মনে করেন ধর্ষণ-নির্যাতনের কারণ হিসেবে ক্ষমতা প্রদর্শনের নেতিবাচক মানসিকতা ও রাজনৈতিক প্রভাব দায়ী। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের নভেম্বর পর্যন্ত দেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১৫৪৬ জন নারী। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৫১ জনকে, আত্মহত্যা করেছেন ১৪ জন। এছাড়া ৯৭৪ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ এ বছর নভেম্বর পর্যন্ত দেশে ১২৪৭টি নারী ও কন্যাশিশু ধর্ষণের তথ্য পেয়েছে। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন-এমজেএফ সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে জানায়, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ৬২৬ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ১৩ থেকে ১৮ বছর বয়সী শিশুরাই ধর্ষণের শিকার হয়েছে বেশি। এরপর ৭ থেকে ১২ বছর বয়সী শিশু রয়েছে। এ বিষয়ে কথা হয় বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খানের সাথে। তিনি বলেন, শাস্তি অনেক বড় হলেই যে, অপরাধ বন্ধ হয়ে যাবে এটা কিন্তু ঠিক না। একে বারে তৃণমূল পর্যন্ত স্কুল কলেজ ইউনিভার্সিটিতে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে যে, নৈতিকতার মূল্যবোধ কি? কাকে কিভাবে সম্মান করতে হবে, বাড়িতে কিভাবে চলতে হবে। একই সঙ্গে শাস্তি কি কি আছে কোন কোন ধারায়। এটাও কিছুটা হলেও বইয়ের মধ্যে লিপিবদ্ধ করতে হবে। তাহলে মানুষ সেই জায়গা থেকে ভয় পাবে। কিন্তু মানুষ তো জানেই না! আপনি সাংবাদিক, আমি আইনজীবী বা যারা সচেতন আমরা জানি শাস্তি আছে। এছাড়া কোন ঘটনা ঘটলে কিছু কিছু মানুষ জানে এটার শাস্তি আছে। তৃণমূল পর্যায়ে কিছুটা জানে কিন্তু তারা গুরুত্ব দেয় না। তিনি আরও বলেন, আরেকটা বিষয় সামাজিক যে ধারণা, কিছু একটা করলে পার হওয়া যায়। টাকা দিয়ে পার হওয়া যায়। প্রভাবশালীদের কারণে পার পাওয়া যায়। রাজনৈতিক কারণে পার পাওয়া যায়। মামলার দীর্ঘসূত্রিতা সবকিছু মিলে নারীদের অনুকূলে না। শুধু নারীদের কথাই বলবো না যারা রেপ করে নাই, তারাও তো ক্ষতির শিকার হয়। তারাও তো তাদের অনুকূলে না। সেজন্য মামলার দীর্ঘসূত্রতা, সচেতনতা বৃদ্ধি এবং নৈতিকতা মূল্যবোধের জন্য সকল মন্ত্রণালয় বসে একটা সাবজেক্ট তৈরি করে সেটাকে বাধ্যতামূলক করা উচিত। এটা পাস না করে কেউ প্রোমোশন পাবে না। সে মূল্যবোধটা তখন ফিরে আসবে। সেটা ইংলিশ বাংলা সকল মিডিয়াতে একটা বিষয় থাকতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞান অনুষদের সহযোগী অধ্যাপক ড. আফরোজা হোসেন বিডি২৪লাইভকে বলেন, আমি বাবা-মা হিসেবে আমার সন্তানকে কি শিখাতে চাই এবং কোথায় আমার সন্তান যাবে এই যে ভাবনাগুলো তো বাবা-মায়ের মধ্যে নাই। এখন ভোগের দুনিয়ায় তো তাই সবাই শুধু ভোগ করতে চায়, তো যে যেভাবে পারে ভোগ করে। তিনি বলেন, মানুষের ভেতরে সংযম মৃত ব্যয়োতা মূল্যবোধগুলো কমে যাওয়ার কারণে বাস্তবে যা চাই তাই পেতে হবে। যেমন করে হোক আমি এটা পেতে চাই, এই যে ভোগবাদী মানসিকতা আমরা বলি এটা বেড়েছে। সম্পদ যত বাড়ছে মানুষের এই চাহিদাগুলো তত বাড়ছে। এটা সহনীয় মাত্রায় আনতে হলে খুব কঠোরভাবে আইনের প্রয়োগ চাই। আইনের প্রয়োগ থাকলে অনেক মানুষ এসব করতে সাহস পাবে না। মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বিডি২৪লাইভকে বলেন, অপরাধ বৃদ্ধি পাওয়ার পিছনে অনেক কারণ রয়েছে। এই করোনার মধ্যে স্কুল কলেজ বন্ধ থাকায় কিশোররা ঘরে বসে থাকতে থাকতে ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছে। যারা দুষ্টু প্রকৃতির তারা বাইরে যাচ্ছে আড্ডা দিচ্ছে। তখন তারা অপরাধ মূলক আচরণ বা অপরাধ মূলক কর্মকাণ্ড নিয়ে আলোচনা করছে। তাদের ওপরে বাবা-মায়ের নিয়ন্ত্রণ থাকছে না। ভালো জগতটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষক ও বাবা-মা তাদের সময় দিচ্ছে না এজন্য অপরাধ প্রবণতা বেড়েছে। আরেকটা কারণ হচ্ছে অনেক পরিবারের বাবা-মায়ের চাকরি চলে গেছে। তাদের আয় কমে গেছে, অনেকে বাধ্য হয়ে গ্রামে চলে গেছে। সন্তানদের কোথাও রেখে গেছে এজন্য অপরাধ প্রবণতা বেড়েছে। তিনি বলেন, অপরাধ করে মানুষ যে ভাবে পার পেয়ে যাচ্ছে। যারা অপরাধ করছে তাদেরকে শাস্তির আওতায় আনতে পারছি না, শাস্তি দৃশ্যমান করতে পারছি না, অপরাধীর মনের মধ্যে ভীতি সঞ্চার করতে পারছি না, আইনের শাসন পুরোপুরি প্রতিষ্ঠা করতে পারছি না। তার ফলশ্রুতিতে ওরাও মনে করছে অপরাধ করে পার পেয়ে যেতে পারবো, কিছুই হবে না। সেই কারণে তাদের ভয়ভীতি থাকছে না, আইনের প্রতি শ্রদ্ধাও থাকছে না এজন্য তারা অপরাধে জড়িয়ে পরছে। সন্তানের প্রতি বাবা-মায়ের আরও বেশি খেয়াল রাখতে হবে।  

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: