‘সোনাপুর’ দিয়েই পাচার হচ্ছে সোনা

প্রকাশিত: ১৪ জুন ২০২১, ০৭:৫৯ এএম
বেনাপোল ভারতের সীমান্তবর্তী বাংলাদেশের একটি পৌরশহর। বেনাপোলে বাংলাদেশের প্রধান এবং সবচেয়ে বড় স্থলবন্দর অবস্থিত। সীমান্তবর্তী হওয়াতে যশোরের বেনাপোল সীমান্ত দিয়েই ভারতে পাচারের জন্য স্বর্ণ চোরাচালানিদের প্রধান রুট হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে সাদীপুর সীমান্ত। এই পথ দিয়ে দিনে ও রাতে বাংলাদেশ থেকে পার হচ্ছে কোটি কোটি টাকার স্বর্ণ এবং ভারত থেকে আসছে অস্ত্র, ফেনসিডিল, গাঁজা, ওষুধ, মাছের পোনা, মোবাইল ফোন, কসমেটিকস, কেমিক্যাল। আর এই ঘাট চালানোর নেপথ্যে রয়েছে সীমান্তের প্রভাবশালী একটি মহল। প্রশাসনের আড়ালে অবৈধভাবে তারা ঘাট চালিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। বেনাপোল চেকপোস্ট ইমিগ্রেশন হাউসের পেছন থেকে শুরু করে রঘুনাথপুর সীমান্ত পর্যন্ত পাঁচ কিলোমিটার সীমান্তজুড়ে দিনে ও রাতে চলে স্বর্ণ পাচারের মহোৎসব। জানা যায়, বেনাপোল চেকপোস্ট থেকে রঘুনাথপুর সীমান্ত পর্যন্ত চোরাচালানের রুট হিসেবে ছয়টি ঘাট ব্যবহার করা হয়। ঘাটগুলো- জয়ন্তীপুর পোতার পোস্ট, ডাক্তারবাড়ি, লেবুতলা পোস্ট, নাপিতবাড়ি জলঘাট, ইঁদুরবাড়ি পোস্ট, আমবাগান মাঠ পোস্ট। সাদীপুর সীমান্তের ওপারে ভারতের কাঁটাতারের বেড়া অরক্ষিতসহ সাদীপুর জয়ন্তীপুর পোতার পোস্ট স্থলপথ এতটাই নিকটে যে দুই থেকে তিন মিনিটে সাদীপুর থেকে ভারতের জয়ন্তীপুর চলে যাওয়া যায়। যার ফলে সীমান্তের দুই পাশে সক্রিয় চোরাচালান চক্রের হোতারা সহজে স্বর্ণ পাচার করতে সক্ষম হচ্ছে। সাদীপুর দুই দেশের সীমান্ত ঘেঁষে এমনভাবে মানুষের বসবাস যে শনাক্ত করাই কঠিন, কোনটা বাংলাদেশ আর কোনটা ভারত। ওপারে মিজান মোল্লা ও ইসরাইল সর্দারের বাড়ি, সীমান্তের পাশে স্বর্ণ ও মাদক চোরাচালানের একটি সক্রিয় চক্র আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে ক্রিকেট বলের মতো টান মেরেও পার করছে স্বর্ণ। স্থানীয় বাসিন্দাদের তথ্য মতে জানা যায়, সাদীপুর সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ করে একটি সক্রিয় মহল। সেখানে গ্রামের ৩০ থেকে ৪০ জন যুবক দিয়ে বিভিন্ন পন্থায় এই রুট ব্যবহার করা হচ্ছে। বিগত সময়ে সীমান্তের এই সাদীপুর গ্রামকে ‘সোনাপুর’ বলে আখ্যায়িত করা হতো। বর্তমানে সেটা আবারও পুরনো রূপ ধারণ করেছে। এদিকে স্বর্ণপাচারের জন্য বিভিন্ন পেশার মানুষ এ ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছে। বাড়তি আয়ের জন্য সীমান্তবর্তী গ্রামের যুবক, বৃদ্ধ ও নারীরা এ পেশায় নেমেছেন। গত ১৭ মে সাদীপুর সীমান্ত দিয়ে পাচারের জন্য স্বর্ণ বহন করা অবস্থায় বিজিবির হাতে ১০টি বারসহ আটক হয় সুমন মিয়া। তার ভাষ্য মতে, যশোর থেকে সীমান্ত পর্যন্ত একেকটি স্বর্ণের বারের জন্য মিলত ৫৫০ টাকা। গত ৯ মার্চ ৪টি স্বর্ণের বারসহ সীমান্তের আব্দুল জলিল, ১৪ মার্চ ১০টি স্বর্ণের বারসহ আব্দুল ওহাব, ১৫টি স্বর্ণের বারসহ রানা হামিদ, ৫৭টি স্বর্ণের বারসহ বানেছা খাতুন, ৪৯টি স্বর্ণের বারসহ আব্দুল মমিন, ৪৯টি স্বর্ণের বারসহ শামিম হোসেন সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনী সদস্যদের হাতে আটক হয়। তারা বলছেন, আমরা বাহক মাত্র। কিছু টাকার বিনিময়ে এসব স্বর্ণ একটি নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে দেওয়াই আমাদের কাজ। কিন্তু তাদের কাছে স্বর্ণের বারগুলো কারা দিয়েছে, তা জানাতে নারাজ পাচারকারীরা। এদিকে একের পর এক স্বর্ণের বার আটক হলেও মূল হোতারা থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। আটককৃতরা পুলিশের রিমান্ডে ভারতীয় কোনো নাগরিকের নাম বলছে। পরে প্রকৃত সোনার মালিকরা এসব আসামিকে আদালত থেকে জামিন করিয়ে নেয়। জামিনে বের হয়ে তারা আবারও এই ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন। সাদীপুরের বাসিন্দা দুলাল আহম্মেদ জানান, সাদীপুর সীমান্ত দিয়ে দেদার স্বর্ণ পার হওয়ার কারণে এখন আর মাঠে কাজ করার মতো শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। বেশি আয় এবং কষ্ট লাঘব হওয়ায় তরুণরা ঝুঁকে পড়ছে স্বর্ণ বহনের কাজে। এ ছাড়া সাদীপুর সীমান্ত দিয়ে মাদকসহ অবৈধভাবে চড়া মূল্যে লোক পারাপার হচ্ছে। বেনাপোল পোর্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মামুন খান বলেন, বেনাপোলের বিভিন্ন সীমান্তে পাচারকারীদের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। স্বর্ণপাচার বর্তমানে বেড়ে গেছে। গডফাদাররা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকায় পাচারকারীরা আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে আসে। আমরা মাদকবিরোধী অভিযান ও মাদক উদ্ধার অভিযান অব্যাহত রেখেছি। মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে গডফাদার যে-ই জড়িত থাক না কেন, তাদের সঙ্গে কোনো আপস নেই। মাদক ব্যবসায়ীদের পক্ষে যে সুপারিশ করবে তাকেও ছাড় দেওয়া হবে না। যশোর-৪৯ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল মো. সেলিম রেজা বলেন, দেশের অভ্যন্তরে মাদকসহ যাতে কোনো ধরনের অবৈধ পণ্য দেশে প্রবেশ করতে না পারে এবং স্বর্ণসহ অন্যান্য পণ্য ভারতে প্রবেশ করতে না পারে তার জন্য বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সদস্যরা সর্বদা সতর্ক রয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতি কভিড-১৯-এর মধ্যেও ৪৯ বিজিবি ব্যাটালিয়ন গত ২০২০ সালে ১৩ জন আসামিসহ ৪১.৭২২ কেজি স্বর্ণ, ও ২০২১ সালের মে মাস পর্যন্ত পাঁচজন আসামিসহ ৭.৩০৩ কেজি আটক করেছে। যার মূল্য ৩২ কোটি ৯০ লাখ ৬২ হাজার ৩৪০ টাকা।

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: