যশোরে ১ বছরে চাঞ্চল্যকর ১০ খুন

প্রকাশিত: ০১ জানুয়ারি ২০২২, ১২:২৬ পিএম

বিদায়ী ২০২১ সালে যশোরে চাঞ্চল্যকর ১০ খুন হয়, এর মধ্যে ৭ টির রহস্য উন্মোচন হলেও ৩টি খুনের ঘটনায় আসামি সনাক্ত হলেও তাদের অনেকে রাজনৈতিক সেল্টারে রয়েছে। বিদায়ী বছরে কলেজ ছাত্র, স্কুল ছাত্র, ইজিবাইক চালক, দোকানী ও রাজনৈতিক খুন মিলিয়ে যশোর সদর উপজেলা এলাকায় চাঞ্চল্যকর ১০টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এসব হত্যাকান্ডর ৭ টির তদন্ত কার্যক্রম ছিল আশাব্যঞ্জক। মামলাগুলোর মধ্যে বেশির ভাগের অগ্রগতি হয়েছে। রহস্য উন্মোচিত করতে পেরেছে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা। আসামি আটকও হয়েছে। এদিকে ৩টি মামলার আটক না হওয়ায় ভূক্তভোগী পরিবারের লোকজন এ ব্যাপারে সরকারের উচ্চ মহলের হস্তক্ষেপ দ্রুত কামনা করেছেন।

গত ১৯ ডিসেম্বর দুপুরে যশোরের শংকরপুর কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালে চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা সাব্বির হোসেন নামে এক চা দোকানীকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে। এদিন তিনি তার চায়ের দোকানে কাজ করছিলেন। এসময় তারই পরিচিত এলাকার আকাশ, স্বাধীনসহ ৩ জন তাকে একটি বিশেষ দ্রব্যের প্রলোভন দিয়ে ডেকে নিয়ে যায়। তারা ৪ জন যখন ওই হাজীর গোডাউনে অবস্থান করছিল, তখন এলাকার অতি পরিচিত, বিভিন্ন মামলার আসামি ৪/৫ জন এসে বাক-বিতন্ডা বাধায়। পরে এলোপাতাড়ি কোপানো শুরু করে। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে সাব্বির। এ হত্যাকান্ডের সব আসামিই চিহ্নিত। তারা আটক এড়িয়ে চলছে।

১৭ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় শহরতলীর বকচর হুঁশতলা কবরস্থানপাড়ার মৃত লিটু সরদারের ছেলে রাকিব সরদারকে কুপিয়ে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। বকচর মোড়ে একটি ভাঙাড়ির দোকানে কাজ করা রাকিব এদিন সন্ধ্যায় মাঠপাড়ার শহিদুল ইসলামের চটপটির দোকানে চটপটি খেতে যান। সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে রাকিব বন্ধুদের সাথে চটপটি খাচ্ছিলেন। এ সময় একদল অজ্ঞাত দুর্বৃত্ত তাকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে হত্যা করে। এ ঘটনায় ওই এলাকার চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে মামলা হয়। মামলাটি র‌্যাব ৬ যশোর ক্যাম্প ছায়া তদন্ত শুরু করে বেশিরভাগ আসামিকেই আটক করে।

গত ১৭ নভেম্বর রাত সাড়ে ১০ টায় কবরস্থান এলাকার নারায়ন চন্দ্র ঘোষের চায়ের দোকানে বসে থাকা অবস্থায় এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয় আব্দুল হামিদের ছেলে সাবেক সৈনিক ও তাঁতীলীগ নেতা কাঁকনকে। ঘটনার ব্যাপারে পরিবারের পক্ষে বলা হয়, একদল অজ্ঞাত পরিচয়ের সন্ত্রাসীরা তাকে এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাত করে হত্যা করে। এ ঘটনায় আসামি অজ্ঞাত করে মামলা হয়। তবে এ ঘটনায় কাউকে আটক বা শনাক্ত করতে পারেনি আইন প্রয়োগকারী সংস্থা।

যশোরের সুলতানপুরের ইজিবাইক চালক আব্দুল্লাহ খুনের দ্বায় স্বীকার করেছে আটককৃতরা। আটককৃতদের মধ্যে আরিফ হোসেন বুকে ও গলায় ছুরিকাঘাত করে। হাসিবুর রহমান টেনে হিঁচড়ে মাঠে নিয়ে গলা কেটে হত্যা নিশ্চিত করে। ১১ নভেম্বর থানা পুলিশ ও আদালতকে এই তথ্য দিয়ে জবানবন্দি দিয়েছে অভিযুক্ত ওই দুই ঘাতক। এছাড়া হত্যা শেষে ছিনতাইকৃত ইজিবাইকটি মিশন সদস্য আব্দুল্লাহর কাছে হস্তান্তর করে। ১০ নভেম্বর অজ্ঞাত আসামি করে মামলার পর আটক অভিযানে পাকড়াও হয় ওই তিন জন। তাদের ওই মামলায় চালান দেয়া হয়।

গত ৯ নভেম্বর রাতে শহরতলী সুলতানপুরের মুজাদ্দুজ্জামানের ছেলে কলেজ ছাত্র ও ইজিবাইক আব্দুল্লাহকে কুপিয়ে ও গলা কেটে হত্যা করা হয়। ইজিবাইকটি ছিনতাইয়ের জন্যই ছিল ওই খুন। ওইদিন গভীর রাত থেকে পুলিশ তদন্ত ও আটক অভিযান শুরু করে। তাৎক্ষনিক অভিযান ও তদন্তে রেবিয়ে আসে হত্যা রহস্য, আটক হয় ৩ জন। এরা হচ্ছে শহরতলী শেখহাটি তরফ নওয়াপাড়া গ্রামের আব্দুল গনির ছেলে হাসিবুর রহমান হাসিব (১৯), পূর্ব বারান্দীপাড়ার ফারুক হোসেনের ছেলে আরিফ হোসেন (১৯) ও শেখহাটির সাঈদ আলী মোড়লের ছেলে সায়েদ আলী মোড়লের ছেলে আব্দুল্লাহ (১৮)। পুলিশের কাছে তারা হত্যাকান্ডের বর্ণনা দেয়াসহ দ্বায় স্বীকার করে।

যশোরের শহরতলী বোলপুরের আব্দুল মালেকের ছেলে সিএনজি চালক রাশেদ আহমেদকে (২৮) কুপিয়ে হত্যা করা হয়। চাঁদাবাজি ও মাদক কারবারে বাধা দেয়ায় একই গ্রামের সুদখোর খোকনের ছেলে আলোচিত মাদক কারবারী মনিরুল ইসলাম ও তার সহযোগিরা এই হত্যাকান্ড ঘটায়। এ ঘটনায় নিহতের বোন রিক্তা বেগম থানায় এজাহার দিলে পুলিশ প্রধান আসামি মনিরুলের বাবাকে আটক করতে সক্ষম হয়। আর মনিরুল আটক এড়িয়ে চলছে। আত্মগোপনে থেকে নানা হুমকি দিচ্ছে বাদী ও ভুক্তভোগী পরিবারকে।

গত ২২ জুলাই রাত সাড়ে ৯ টা থেকে রাত সাড়ে ১০ টার মধ্যে যশোর শহরের শংকরপুর ছোটনের মোড় এলাকায় মেম্বার নুরুন্নবীর গলিতে শাওনকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে হত্যা করে এলাকার কয়েক চিহ্নিত দুর্বৃত্ত। ২৩ জুলাই রাত সাড়ে ১০ টায় বাবা আব্দুল হালিম শেখ ৮ জনকে আসামি করে কোতোয়ালি থানায় হত্যা মামলা করেন। যার নাম্বার ৪৩। পুলিশ শাওন শেখ ওরফে টুনি (২৫) হত্যাকান্ডের ঘটনার রহস্য উদঘাটনসহ জড়িত ৩ জনকে আটক করে।

গত ৯ এপ্রিল যশোরের বসুন্দিয়া মীরপাড়ার সৈয়দ সরোয়ার হোসেন (৪৮) খুন হন তারই ছেলে নয়ন হেসেনের (২৫) হাতে। ওই দিন রাতে সৈয়দ সরোয়ার হোসেন দোকান বন্ধ করে বাড়ি ফেরেন। এরপর তার সাথে স্ত্রী হাসিনা বেগমের একটি মেয়েলি ঘটনা নিয়ে গোলযোগ হয়। সরোয়ার হোসেন উত্তপ্ত কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে হাসিনাকে বেদম মারপিট করে। এ সময় তাদের ছেলে নয়ন হোসেন ঘুমিয়ে ছিল। হাসিনা বেগম ঘুম থেকে ডেকে ছেলেকে মারপিটের বিষয়টি জানালে বাকবিতন্ডায় লিপ্ত হয়ে পিটিয়ে হত্যা করে।

গত ২১ মার্চ সন্ধ্যায় স্থানীয় চিহ্নিত একটি মাদক ব্যবসায়ী চক্র যশোরের এনায়েতপুরে হাফিজুর রহমানের ছেলে নবম শ্রেণির ছাত্র রাকিবুল ইসলাম রাকিবকে (১৬) খুন করে। পূর্ব শত্রুতা ও অধিপত্য দ্বন্দ্বে এ খুন হয়। হাশিমপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্র রাকিবুল ইসলামকে গেম খেলা সংক্রান্ত ঘটনায় তারই অতি পরিচিত সোহান এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যায়। একদিন পরে ২২ মার্চ  সোহানকে আটক করে পুলিশ।

গেল বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি সকাল সাড়ে ১১ টায় যশোরের পুরাতনকসবা চুয়াডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন এমএম কলেজের পুরাতন ছাত্রাবাসের বিপরীতে কাজীপাড়ার মৃত শেখ মোহাম্মদ আলীর ছেলে কোরবান আলী পচাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। চাঁদাবাজি সংক্রান্ত দ্বন্দ্বের জেরধরে এ হত্যাকান্ড ঘটে। এ ঘটনায় খোলাডাঙ্গার সিরাজুল ইসলাম চুন্টুর ছেলে হত্যাকান্ড ঘটনার নায়ক রোকন হাসান রনিকে (২৮) বগুড়া থেকে আটক করে যশোর জেলা গোয়েন্দা শাখা। একই সাথে খুনে ব্যবহৃত ধারালো অস্ত্রটিও উদ্ধার হয়। এরপর পুলিশ ১টি পালসার মোটরসাইকেলসহ খোলাডাঙ্গার জন বিশ্বাসের ছেলে রিচার্ড বিশ্বাসকে (৩৪) আটক করে। রিচার্ড বিশ্বাস আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করে। ঘটনায় জড়িত অন্যান্য আসামি পলাতক থাকে।

গেল বছরের ৯ মার্চ রাতে যশোরের খোলাডাঙ্গায় এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাতে খুন হন সুতীঘাটা কামালপুরের বাচ্চু গাজী (৩৫)। খুন হওয়ার ঘটনায় চাঞ্চল্যকর তথ্য পায় পুলিশ। যাত্রী সেজে রিকসা ভাড়ায় নিয়ে চালককে হত্যা চেষ্টার সময় উল্টো নিজের ছুিরতেই খুন হয় বাচ্চু।ছিনতাইকারী বাচ্চুর ছুরি কেড়ে নিয়ে তাকে হত্যা করে রিকসা চালক। আটকের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে এ তথ্য জানিয়েছেন রিকসা চালক মোবারককাটির আলমগীর হোসেন। ওই ঘটনায় আরো কয়েকজন আটক হয়। ১০ মার্চ সকাল সাড়ে ১১ টায় খোলাডাঙ্গা এলাকার আশরাফ আলীর ধানক্ষেত থেকে লাশ উদ্ধার ও ঘটনাস্থল থেকে দুই জোড়া স্যান্ডেল ও একটি চাকু উদ্ধারের ক্লু নিয়ে পুলিশ এগোয়। মামলাটির চার্জশিট হয়েছে।

মামলাগুলোর ব্যাপারে যশোর কোতোয়ালি থানার অফিসার ইনচার্জ তাজুল ইসলাম জানান, মামলগুলো যত্নসহকারে তদন্ত হয়েছে এবং হচ্ছে। অধিকাংশ হত্যাকান্ডের রহস্যউন্মোচন ও সব আসামি আটক করে চালান দেয়া হয়েছে। কয়েকটি হত্যা মামলার আসামিরা আত্মগোপনে আছে। সোর্স লাগিয়ে আটকের চেষ্টা চলছে। আর অনেক মামলার আসামি অজ্ঞাত। ওই মামলাগুলো তদন্তে সময় লাগবে। সেসব ব্যাপারে গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানো হচ্ছে। থানা পুলিশ ছাড়াও চাঞ্চল্যকর মামলাগুলো র‌্যাব ৬ যশোর ক্যাম্পের সদস্যরা, ডিবি, সিআইডি, পিবিআই সহযোগিতা করেছে। চাঞ্চল্যকর হত্যাকান্ডে জড়িত পলাতকদের আটকের জেরালো তৎপরতা চলমান রয়েছে।

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: