বিলীনের পথে পটুয়াখালীর শেষ জমিদারের স্মৃতিচিহ্ন

প্রকাশিত: ৩০ মে ২০২২, ০৭:৩০ পিএম

সংস্কারের অভাবে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থেকে একেবারেই নিশ্চিহ্নের পথে পটুয়াখালী শহরের প্রানকেন্দ্রে অবস্থিত পটুয়াখালীর শেষ জমিদার রাজেশ্বর রায় চৌধুরীর কাছারিবাড়ি। অস্তিত্ব সংকটে রয়েছে ইতিহাসের কাল সাক্ষী এই কাছারি বাড়িটি। বেশ কয়েক বছর আগে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ কর্তৃক এই ভবনটি সংরক্ষণের উদ্যোগ নিলেও পরবর্তীতে তাদের আর কোনো কার্যক্রম পরিলক্ষিত হয়নি। ইতিহাসের সাক্ষী জমিদারি আমলের এই কাছারিবাড়ি অবিলম্বে সংরক্ষণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া না হলে অস্তিত্ব সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে যাবে অচিরেই।

জানা যায়, জমিদারীর কার্যক্রম পরিচালনার প্রয়োজনে শহরের নতুন বাজার এলাকায় ২৫০ বছর পূর্বে এই কাছারি বাড়িটি নির্মাণ করা হয়। ২৫০ বছরের প্রাচীন ইতিহাস ঐতিহ্য বিজড়িত এই কাছারিবাড়িটি বেশ কয়েক বছর ধরে অবেহেলায় নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে শহরের বুকে। জেনো কথা বলার কেউ নেই। বছরের পর বছর জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে থেকে এখন ভূতের বাড়ির মতো রূপ নিয়েছে পটুয়াখালীর শেষ দাপুটে জমিদার রাজেশ্বর রায়ের এই কাছারি বাড়ি।

পটুয়াখালীর শেষ জমিদার রাজেশ্বর রায় চৌধুরীর শেষ স্মৃতিচিহ্ন বিজড়িত জমিদারী আমলের এই ভবন এই অঞ্চলের নানা ইতিহাসের কাল সাক্ষী। সংস্কারের অভাবে দিনে দিনে মাটির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে আমাদের পূর্ব ইতিহাস। বর্তমান প্রজন্মের কাছে অজানাই থেকে যাচ্ছে ইতিহাসের প্রতিটি পৃষ্ঠা।
জমিদারদের স্থাপিত মন্দির পাষানময়ী কালীবাড়ি স্থানীয়দের দান-অনুদানে সংস্কার করে সেখানে নিয়মিত পূজা-অর্চনা চলে আসছে।

এই প্রাচীন কাছারি বাড়ির ইতিহাস ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার জন্য স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগ নেয়া আবশ্যক বলে মনে করেন পটুয়াখালী প্রেসক্লাব ও জেলা সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক মুজাহিদুল ইসলাম প্রিন্স। তিনি বলেন, জমিদারী আমলের এই স্থাপনা যদি এখনো সংস্কারের মধ্য দিয়ে সংরক্ষণ করা না হয় তবে ইতিহাসের কাল সাক্ষী এই কাছারি বাড়ি অচিরেই বিলীন হয়ে যাবে। অতিদ্রুত জমিদার রাজেশ্বর রায়ের এই কাছারি বাড়িটির সংস্কার করা জরুরী।

বিলুপ্তির পথে হলেও এখনও এই প্রাচীন স্থাপনায় ইতিহাসপিপাসু বহু মানুষের পদচারনা লক্ষ্য করা যায়। বিশেষ করে লক্ষ্য করা যায় স্কুল-কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের। বহু শিক্ষার্থী ঘুরতে আসেন জমিদার রাজেশ্বর রায়ের এই কাছারি বাড়িতে। জানতে চায় এর ইতিহাস। তবে বড় পরিতাপের বিষয় সবাইকেই ফিরে যেতে হতাশ হয়ে।

সিরাজ উদ্দীন আহমেদের লেখা ‘বরিশালের ইতিহাস’ ও ইয়াকুব আলী সিকদারের প্রবন্ধ ‘পটুয়াখালীর অতীত ও বর্তমান’ থেকে পাওয়া তথ্য ও আরও বেশ কিছু তথ্য অনুযায়ী, ১৮১৭ সালে বরিশালকে পৃথক করে দেওয়ানী শাসন প্রসারের জন্য স্থাপন করা হয় চারটি মুন্সেফী চৌকি। বাউফল চৌকি স্থানান্তর করা হয় লাউকাঠীতে। ১৮৭১ সালে পটুয়াখালীকে উন্নীত করা হয় মহকুমায়। জমিদার হৃদয় শংকরের পুত্র কালিকা প্রসাদ রায়ের নামানুসারে লাউকাঠীর দক্ষিণ পাড়ের গ্রামের নামকরণ করা হয় কালিকাপুর। এখানে গড়ে ওঠে পটুয়াখালী শহর। কলসকাঠির জমিদার বরদা কান্ত রায় চৌধুরীর ছেলে বিশ্বেশ্বর রায় চৌধুরী ১২৯৬ বঙ্গাব্দে পটুয়াখালী মহকুমার অধীন কালিকাপুর কিসমতের বন্দ্যোপাধ্যায় মুদাফা তালুকটি কিনে নেন।

এই অঞ্চলের সর্বশেষ জমিদাররা ছিলেন বিশ্বেশ্বর রায় চৌধুরীর চার ছেল। তার মধ্যে রাজেশ্বর রায় চৌধুরী পটুয়াখালীর জমিদারী পরিচালনা করেন। প্রবল দাপটের সঙ্গে পটুয়াখালীর শেষ জমিদারি পরিচালনা করেন জমিদার রাজেশ্বর রায় চৌধুরী। পটুয়াখালীতে নির্মাণ করা হয় কাছারি বাড়ি, এখানে তাদের জমিদারীর হাউলিও ছিল। হাউলির কয়েক গজ সম্মুখে পাষাণময়ী কালীবাড়ি। তার পিতা বিশ্বেশ্বর রায় চৌধুরী বাংলা ১৩১১ সালের (১৯০৪ইং) ৩০ চৈত্র চতুর্দশী অমাবশ্যা তিথিতে এই পাষাণময়ী কালীবাড়ি প্রতিষ্ঠা করেন। জমিদারী প্রথার অবসানের পর তাঁরা ভারতে চলে যান। তাদের ফেলে যাওয়া সম্পত্তি গণ্য করা হয় পরিত্যক্ত ও অনাবাসী সম্পত্তি হিসেবে। কিছু সম্পত্তি আবার ১ নম্বর সরকারি খাস খতিয়ানেও দেখানো হয়। পাকিস্তান আমলে জমিদার রাজেশ্বর রায় চৌধুরীর পরিত্যক্ত এই কাছারি বাড়িতে স্থাপিত হয় সদর তহশিল অফিস।

বাংলাদেশ স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে সেটি ব্যবহৃত হয় সদর উপজেলা ভূমি অফিস হিসেবে। সংস্কারের অভাবে সর্বশেষ জমিদার রাজেশ্বর রায় চৌধুরীর কাছারিবাড়ি ভবনটি জরাজীর্ণ হয়ে পড়লে তা ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়। প্রায় দেড় দশক আগে এই কাছারি বাড়ি ভবনের বারান্দার প্রধান দুটি পিলারের গায়ে লাল রঙে লেখা হয় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ কর্তৃক সংরক্ষিত। পিলারের আস্তর খসে পড়ায় সেই লেখা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।

পরবর্তীতে ৭/৮ বছর পূর্বে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এই কাছারি বাড়িকে ঐতিহাসিক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন উল্লেখ করে একটি বিজ্ঞপ্তি ও সাইনবোর্ড টানানো হয়। তারপরে ভবনের একটি অংশ ভেঙে পড়ে, অবশিষ্ট অংশও যেকোনো সময়ে ভেঙে পড়তে পারে এই আশংকায় সেখানে ২০১৫ সালের জুলাই মাসে একটি সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি টানিয়ে দেয়া হয়। এরপর থেকে পুরোপুরি পরিত্যক্ত এই ভবনটি সংরক্ষণের অদ্য অব্দি কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

জরাজীর্ণ এই ভবনটি ধ্বসে পড়ছে প্রতিনিয়ত। হারিয়ে যেতে বসেছে জেলার জমিদারি আমলের আড়াই শতাব্দীকালের স্মৃতিচিহ্ন। এখনো সংরক্ষণের কোন উদ্যোগ না নিলে হয়তো কালে কালে এই কাছারি বাড়ির মতোই হারিয়ে যাবে পটুয়াখালীর শেষ জমিদারীর ইতিহাস।

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: