ঢাবির ‘রাজু ভাস্কর্য’ হাজারো দাবি আদায়ের প্রাণকেন্দ্রের অপর নাম

ন্যায়ের সঙ্গে আপোস না, নিজেদের অধিকার কিংবা দাবি আদায়ে একটি ভাস্কর্যের পাদদেশ নির্ভরতার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ যেখানে দাঁড়িয়ে নিজের অধিকারের কথা বলে, ন্যায্য দাবির কথা বলে, কেউবা অনশনেও বসে তাঁদের দাবি আদায়ের আগ মুহুর্তে।
বলছিলাম দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সন্ত্রাস রাজু ভাস্কর্যের কথা। আন্দোলন সংগ্রামের সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যেমনটা জড়িত, তেমনি এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে ১৯৯৭ পরবর্তী একটি নতুন নাম যুক্ত হয়েছে সন্ত্রাস রাজু ভাস্কর্য। ১৯৯৭ এর শেষভাগে তৈরি হওয়ার পর এ ভাস্কর্য যেম প্রতি নিপিড়ীত মানুষের কথা বলার এক আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়েছে।
আজকের এ সন্ত্রাস রাজু ভাস্কর্যের পেছনে রয়েছে একটি লম্বা গল্প। যার একটি বড় অংশ জুড়ে রয়েছে তৎকালীন বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় নেতা মঈন হোসেন রাজুর নাম। জানা যায়, ১৯৬৮ সালের ২৯ শে জুলাই মঈন হোসেন রাজুর জন্ম। জন্ম বরিশালে হলেও বেড়ে ওঠেন চট্টগ্রাম ও ঢাকায়। ১৯৮৭ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মইন হোসেন রাজু ছিলন তৎকালীন ছাত্র ইউনিয়নের নেতা। রাজুর নিয়মানুবর্তিতা ছিল চোখে পড়ার মতো। ক্লাস-পড়া-সংগঠনের কাজ সব কিছুতেই সে ছিল কর্তব্যনিষ্ঠ। সবার চেয়ে শান্ত রাজু ছিলেন বেশ দৃঢ় মনোবলের।
রাজধানীর শ্যামলীতে, যেখানে তার মা, বড়ভাই ও বোন থাকতেন। এই পরিবারের স্নেহধন্য জেদি ছেলে রাজুকে তাই পরিবারের টানে ও মায়ের অনুরোধে নিয়মিত বাসায় যেতে হতো। রাজু বাসায় যেত ঠিক, কিন্তু আবার ফিরেও আসত। বাসার চেয়ে ক্যাম্পাসে শহীদুল্লাহ হলের ১২২ নম্বর রুমে। রাজুর মন জুড়ে ছিল ক্যাম্পাস, বন্ধু-বান্ধব, সংগঠন, ছাত্রদের দাবি-দাওয়া-আন্দোলন। কিন্তু এ ক্যাম্পাস দাবি-দাওয়াই যেন তাঁর জীবনে কাল হয়ে দাঁড়ায়; উৎসর্গ করতে হয় জীবন।
সালটি ১৯৯২, দেশে স্বৈরতন্ত্রের অবসানের পর কেবল এক বছর অতিবাহিত হয়েছে। এরই মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে শুরু হয়ে গেছে তথাকথিত গণতান্ত্রিক দলগুলোর ক্ষমতা প্রদর্শন ও দখলদারিত্বের রাজনীতি। ১৯৯২ সালের ১৩ই মার্চ সকালে ছাত্রদল কর্মী, মতান্তরে ছাত্রশিবির কর্মীকে পেটাই করার মধ্য দিয়ে ক্যাম্পাস উত্তেজিত হয়ে ওঠে। এ ঘটনায় পুলিশের সাথে সাধারণ ছাত্রদের সংঘর্ষ বেঁধে যায়। দুপুরে সংঘর্ষ চলাকালীন কনুইয়ে ব্যথা অনুভব করলে চলে যান শহিদুল্লাহ হলের হলের ১২২ নাম্বার রুমে। সেদিন পড়ন্ত বিকেলে ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলের অস্ত্রধারীরা টিএসসিতে বন্দুকযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়, সঙ্গে পুলিশও জড়িয়ে পড়ে। পুরোপুরি বিশৃঙ্খলার চিত্র দেখা যায় পুরো ক্যাম্পাস জুড়ে।
এর প্রতিবাদে রাজুর নেতৃত্বে ‘গণতান্ত্রিক ছাত্রঐক্য ভুক্ত’ বাম ছাত্রসংগঠনের কর্মীরা প্রতিবাদ মিছিল বের করে। মিছিলটি টিএসসির সড়কদ্বীপ প্রদক্ষিণ করার সময় ডাসের সামনে ‘অস্ত্র শিক্ষা একসাথে চলবে না’, ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ছাত্রসমাজ এক হও’ এ স্লোগানে হাকিম চত্বরের দিকে এগোতে থাকলে একঝাঁক বুলেট মিছিল লক্ষ্য করে ছুটে আসে। এর একটি গুলি কপালে লাগে মিছিলের সামনে থাকা রাজুর। স্লোগান মুখে নিয়েই সে লুটিয়ে পড়ে টিএসসির স্বোপার্জিত স্বাধীনতা ভাস্কর্যের সামনে সড়ক দ্বীপের পাশের রাস্তায়।
১৯৯২ সালের ১৩ই মার্চের রাজুর আত্মত্যাগ স্মরণে এবং সন্ত্রাসবিরোধী চেতনা ধরে রাখার প্রত্যয়ে সন্ত্রাসবিরোধী রাজু স্মারক ভাস্কর্য নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়।
নানামুখী বাধা-বিপত্তির চড়াই-উৎরাই পেড়িয়ে অবশেষে ভাস্কর শ্যামল চৌধুরীর নকশায় ভাস্কর্যটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়। এতে সহযোগী হিসেবে কাজ করেন গোপাল পাল। আর্থিকভাবে সহায়তা প্রদান করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষক আতাউদ্দিন খান (আতা খান) ও মুন্সিগঞ্জ-বিক্রমপুর সমিতির সভাপতি লায়ন নজরুল ইসলাম খান বাদল। নির্মাণ কাজ শেষে ১৯৯৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ১৭ তারিখে ভাস্কর্যটি উদ্বোধন করেন তৎকালীন উপাচার্য এ. কে. আজাদ চৌধুরী।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণকেন্দ্র টিএসসি’র মোড়ে ভাস্কর্যটি নির্মিত এ ভাস্কর্য ১৬ ফুট দীর্ঘ, ১৪ ফুট প্রশস্ত এবং ১০ ফুট উঁচু। এই ভাস্কর্যে ৮ জনের অবয়ব ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। যাদের প্রতিকৃতি ব্যবহার করা হয়েছে তারা হলেন মুনীম হোসেন রানা, শাহানা আক্তার শিলু, সাঈদ হাসান তুহিন, আবদুল্লাহ মাহমুদ খান, তাসফির সিদ্দিক, হাসান হাফিজুর রহমান সোহেল, উৎপল চন্দ্র রায় ও গোলাম কিবরিয়া রনি।
মঈন হোসেন রাজু নেই, নেই তার দরাজ কণ্ঠ কিন্তু হাজারো প্রতিবাদী নিপিড়ীত কণ্ঠের ধ্বনি ধ্বনিত হওয়ার মাধ্যমে মুখরিত থাকবে সন্ত্রাস রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশ, হাজারো প্রতিবাদীর ভিড়ে এভাবেই আজীবন বেঁচে থাকবে রাজু।
বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এডিটর ইন চিফ: আমিরুল ইসলাম আসাদ
বাড়ি#৩৫/১০, রোড#১১, শেখেরটেক, ঢাকা ১২০৭
ই-মেইলঃ [email protected]
ফোনঃ (০২) ৫৮১৫৭৭৪৪
নিউজ রুমঃ ০৯৬৭৮৬৭৭১৯১
মফস্বল ডেস্কঃ ০১৫৫২৫৯২৫০২
বার্তা প্রধানঃ ০৯৬৭৮৬৭৭১৯০
মার্কেটিং ও সেলসঃ ০৯৬১১১২০৬১২
ইমেইলঃ [email protected]

পাঠকের মন্তব্য: