পঞ্চগড়ের করতোয়ায় নৌকাডুবি: আরও ১৮ জনের লাশ উদ্ধার

প্রকাশিত: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১০:৩৬ পিএম

পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার করতোয়া নদীর নৌকাডুবি দূর্ঘটনায় এখনো শেষ হয়নি স্বজনদের আহাজারী। মাড়েয়া বামন হাট ইউনিয়নে এখন শুধু শোকের ছায়া। শোক কাটাতে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বাড়িতে বাড়িতে আয়োজন করা হচ্ছে বিশেষ প্রার্থনা। এখন পর্যন্ত ১৮ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়।

উদ্ধারকৃতরা হলেন- শৈলবালা (৫১), সনেকা রানী (৫৫), হরিকিশোর (৪৫), শিল্টু বর্মন (৩২), মহেন চন্দ্র (৩০), ভূমিকা রায় পূজা (১৫), আখি রানী, (১৫),সুমি রানী (৩৮), পলাশ চন্দ্র (১৫), ধৃতি রানী (১০), সজিব রায় (১০), পুতুল রানী (১৫), কবিতা রানী(৯), রত্না রানী (৪০) মালিন্দ্র নাথ বর্মন (৫৬), মণিভূষণ বর্মণ (৪৬), মুনিকা রানী (৩৬), দোলা রানী (৫)।

মঙ্গলবার শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত দিনাজপুর জেলায় আরও চারজন লাশের সন্ধান পাওয়ার খবর পাওয়া গেছে তবে। কন্ট্রোল রুম এখনও নিশ্চিত করেনি। তৃতীয় দিনে ভোর সাড়ে পাঁচটায় শুরু হয় উদ্ধার অভিযান। ফায়ার সার্ভিসের চারটি ইউনিটের ২৫ জন সদস্য উদ্ধার কাজে অংশ নিয়েছেন। সারাদিনই উদ্ধার তৎপরতায় চারজন ডুবরি পানির নিচে লাশ খোঁজার চেস্টা করেন। তবে আজকেও স্থানীয়রা ডুবরি দলের সাথে নদীতে নেমে উদ্ধার কাজে অংশ নেয় স্থানীয় মুসলিমরা।

ফায়ার সার্ভিসের দিনাজপুর জেলার সহকারী পরিচালক মঞ্জিল হক জানান আজ নদীতে পানি অনেকটা কমে যাওয়ায় উদ্ধার অভিযান অনেকটা সহজ হয়ে যায়। তবে করতোয়া নদীর বিভিন্ন জায়গায় তারা উদ্ধার তৎপরতা চালিয়েছেন। তিনি বলেন আমরা চেয়েছিলাম আজকের মধ্যে যাতে ডুবে থাকা সকল মরদেহ পানি থেকে তোলা যায়। আমরা সেই চেস্টা করেছি।

সরেজমিনে দেখা গেছে তৃতীয় দিনে স্বজনদের আউলিয়া ঘাট এবং মাড়েয়া বামন হাট ইউনিয়ন পরিষদের ছুটাছুটি ছিল আজও। স্থানীয় এবং উৎসুক জনতার পাড়ে আজকে গতদিনগুলোর তুলনায় কম ছিল। খোজ নিয়ে জানা গেছে ঘাটের মালিক ইজারাদার আত্মগোপনে রয়েছেন।

প্রশাসন বলছে আর ৬৫ জন নিখোঁজদের মধ্যে আর মাত্র চারজন নিখোঁজ রয়েছে তবে স্থানীয়দের অভিযোগ এখনো আরও ১০ থেকে ১ি৫ জন নিখোঁজ রয়েছে। উদ্ধারকৃত ৬৮ জনকে সনাক্ত করা হয়েছে তারপর স্বজনদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। তবে সৎকারের জন্য কুড়ি হাজার টাকা দেওয়ার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত সকল নিহত পরিবারকে সংগত কারনে কয়েকজনকে দেওয়া হয়নি।

এদিকে প্রথম দিনে জেলা প্রশাসনের গঠিত তদন্ত কমিটি গঠন হওয়ার পর তিন দিনের মধ্যে তদন্ত রিপোর্ট দাখিল করার কথা থাকলেও মঙ্গলবার রাত নয়টা পর্যন্ত তাদের রিপোর্ট দাখিল করেন নি। তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) ও ভারপ্রাপ্ত অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট দীপঙ্কর রায় জানান আজ রাতেই তদন্ত রিপোর্ট দাখিল করা হবে। আগামিকাল জেলা প্রশাসক মো. জহুরুল ইসলাম তদন্ত রিপোর্ট নিয়ে ব্রিফিং করার কথা রয়েছে।

এদিকে তৃতীয় দিনে মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাত‘টার দিকে উদ্ধার অভিযান স্থগিত ঘোষনা করা হয়। আগামিকাল সকালে আবারও উদ্ধার অভিযান শুরু হবে। সেই সাথে পার্শবর্তি জেলার করতোয়া নদী সংশ্লিস্ট উপজেলাগুলোতে উপজেলা প্রশাসন আগামিকালও উদ্ধার তৎপরতা চালাবেন বলে জানা গেছে। ৬৮ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এরমধ্যে নারী ৩০ পুরুষ ১৭ ও শিশু ২১ জন। সোমবার সন্ধ্যার পর উদ্ধার কাজ স্থগিত করার পর মঙ্গলবার ভোর থেকে শুরু করা হয় উদ্ধার অভিযান। এরআগে করতোয়ার বিভিন্নস্থানে ভেসে উঠে লাশের পর লাশ। জলে ডুবা এসব লাশ ফুলে যায় এবং অর্ধগলিত হওয়ায় লাশের দূর্গন্ধ হয়েছে।

একটার পর একটা অর্ধগলিত লাশ ইউনিয়ন পরিষদে আসায় কিছুটা দূর্গন্ধযুক্ত এলাকায় পরিনত হয় মাড়েয়া বামনহাট ইউনিয়ন পরিষদ। এরপরও নাকে কাপড় বেধে এলাকাবাসীর সহযোগিতায় একের পর এক লাশ উদ্ধারের পর তা মাড়েয়া বামনহাট ইউনিয়ন পরিষদ চত্বরে নিয়ে আসছেন ফায়ার সার্ভিস সদস্যরা। পচন ধরা লাশের গন্ধ উপেক্ষা করে প্রিয়জনকে শনাক্ত করতে পরিবারের সদস্যরাও ছুটে আসছেন। এরপর শনাক্ত হতেই আঁতকে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেও বুকে পাথর আর মুখে কাপড় চেপে মৃত স্বজনের লাশ নিয়ে যাচ্ছেন বাড়িতে। সেখানে পরিবারের সদস্যদের একপলক দেখার সুযোগ দিয়ে লাশ নিয়ে ছুটছেন স্থানীয় শ্মশানঘাটে। করতোয়ার আউলিয়া ঘাট থেকে মাড়েয়া ও পাশর্^বর্তী এলাকার শ্মশানঘাটগুলোতে শুধু লাশ আর লাশ। এ যেন হৃদয় বিদারক দৃশ্য। স্থানীয় প্রবীণদের মতে, পঞ্চগড়ের ইতিহাসে এমন ভয়াবহ দুর্ঘটনা আগে কখনও ঘটেনি। হাঁটুজলের নদী হিসাবে পরিচিত করতোয়ার জলে ডুবে একসংগে ৬৮ জনের প্রাণহানীর ঘটনার পর চির চেনা করতোয়া যেন অচেনা হয়ে পড়েছে। স্বজন হারানোর বুক ফাঁটা আর্তনাদ যেন থামছেই না। এতোগুলো প্রানহানীর জন্য কর্তৃপক্ষের অব্যবস্থাপনা ও ঘাট ইজারাদারের অবহেলাকে দায়ী করছেন মৃতদের স্বজনসহ এলাকাবাসী। মাড়েয়ার বটতলী, শালডাঙ্গাসহ আশপাশের বিভিন্ন ফুটকীবাড়ি শ্মশানঘাটে গিয়ে দেখা গেছে, নৌকাডুবির ঘটনায় উদ্ধার হওয়া লাশ সৎকার করা হয়েছে। আবার কোন পরিবার তাদের প্রিয়জনের লাশ পোড়ানোর জন্য চিতায় নিচ্ছেন। আগুনে প্রিয়জনের লাশ পোড়ালেও স্বজনদের শোক পোড়াবেন কীভাবে, সে প্রশ্ন স্বজন হারানো পরিবারের চোখে-মুখে।

মাড়েয়া বামনহাট ইউনিয়ন পরিষদ চত্বরে রাখা লাশের শনাক্ত করতে আসেন মাড়েয়ার গড়দিঘীর পুন্য (৫৫) কলেজ পড়–য়া ছেলে পলাশের (১৭) ছবি নিয়ে। ঘটনার দুইদিন পর ছেলের লাশ পেয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। একমাত্র ছেলের অর্ধগলিত লাশ প্রশাসনের কাছ থেকে বুঝিয়ে নিয়ে দাহ করতে নিয়েযান শ^শানঘাটে। বোদা ময়দানদিঘের খালপাড়া গ্রামের হিমালয় (৩৫) এখনও নিখোঁজ রয়েছে। মহালয়ার দিন তিনি তার স্ত্রী স্বপ্না রানীকে নিয়ে নৌকাডুবির শিকার হন। তার স্ত্রী বেঁচে গেলেও হিমালয়কে গত তিনদিন ধরে খুজে পাচ্ছেন না স্বজনরা। মলিন (৩৫) জানান, তার চাচাতভাই হিমালয় দেড়মাস আগে বিয়ে করেন। বোদা উপজেলার সাকোয়ারহেমন্ত বর্মন নৌকাডুবির সময় ওই নৌকার যাত্রী ছিলেন। নৌকাটিতে অতিরিক্ত যাত্রীর কারণে মাঝ নদীতে গিয়ে দুলতে দুলতে এক পর্যায়ে পানিতে ডুবে যায়। তিনি কোনমতে সাঁতরে নদী পাড়ে আসেন। মাড়েয়ার বাসিন্দা ও মজনু বলেন, কোনদিন তিনি এত মানুষের প্রাণহানি এই এলাকায় দেখেননি। তার ৩৪ বছরের জীবনে তো বটেই তার বাপ-চাচারাও এত মৃত্যু একসঙ্গে দেখেননি।

বোদা পৌর মেয়র ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এডভোকেট ওয়াহিদুজ্জামান সুজা দুপুরে ঘটনাস্থলে এসে জানান নৌকাডুবির ঘটনায় যেভাবে লাশ উদ্ধারে মুসলিমরা অংশ নিয়েছেন আমার মনে হয় সম্প্রীতির এক মিলন মেলা হয়েছে। স্থানীয় সাংস্কৃতিক কর্মী নাট্যকার এবং ভূমিজ নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সরকার হায়দার জানান আগামি বছরগুলোতেও মহালয়া আসবে। কিন্তু বোদা উপজেলার মাড়েয়া বামনহাট ইউনিয়নের করতোয়া নদীর আউলিয়া ঘাটের এই নির্মম নৌকাডুবি নিহতদের স্মৃতি বয়ে বেড়াবে তাদের স্বজনরা।

দুপুরে রেলপথমন্ত্রী এডভোকেট নূরুল ইসলাম সুজন মাড়েয়া বামন হাট ইউনিয়ন পরিষদে এসে সাংবাদিকদের জানান আমি এই নৌকাডুবির ঘটনায় শোকাহত। প্রশাসনের সাথে স্থানীয়রা এই দূর্যোগে এগিয়ে এসেছে। বিশেষ করে হিন্দুদের মরদেহ মুসলিমরা উদ্ধার করে নজীর সৃস্টি করেছেন। নিহতদের পরিবারগুলোর মধ্যে যাদের পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যাক্তি নিহত হয়েছেন তাদের পূনর্বাসনের ব্যাপারে সরকারের সহযোগীতা অব্যাহত থাকবে। সেই সাথে তদন্ত রিপোর্টে দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেন তিনি।

এদিকে রেলপথ মন্ত্রী, মৃত পরিবারদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ব্যাক্তিগতভাবে আর্থিক সহযোগিতা প্রদান করেছেন বলেও জানা গেছে।

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: