চাঁদাবাজি করে পর্যটন মেলার বাস্তবায়ন

প্রকাশিত: ০৩ অক্টোবর ২০২২, ০৮:৪৮ এএম

বিশ্ব পর্যটন দিবস উপলক্ষে ৭ দিনব্যাপি পর্যটন মেলার আয়োজন করেছে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন। তবে মেলার জন্য বাজেট এবং বীচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির ফান্ডে তেমন টাকা না থাকায় সর্বজন থেকে দান, অনুদান ও চাঁদা নিয়ে মেলাটি বাস্তাবায়ন করছে জেলা প্রশাসন। জানা গেছে, পর্যটন রাজধানী খ্যাত সমুদ্র নগীর কক্সবাজার। বঙ্গোপসাগরের তীরে ১২০ কিলোমিটার অখণ্ড বালিয়াড়ির পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সবুজ পাহাড় ও দৃষ্টিনন্দন মেরিন ড্রাইভের সৌন্দর্য উপভোগে এ শহরে প্রতিবছর আসে ১৫-২০ লাখ পর্যটক।

মেলা বাস্তবায়নে অনুদান নেওয়া হয়েছে দেশের শীর্ষ শিল্প প্রতিষ্ঠান বসুন্ধরা গ্রুপ থেকে শুরু করে কক্সবাজার শহরের তারকা মানের হোটেল, রেস্তোরাসহ সকল ধরণের পর্যটন সংশ্লিষ্ঠ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে। এমনকি আয়োজকদের অনুদান না দিয়ে পার পায়নি ভ্রাম্যমান হকার, ঝালমুড়ি, চানাচুর, আমড়া, চা ও পান-সিগারেট বিক্রেতারা। তাছাড়া স্থানীয় নারী উদ্যোক্তাদের জন্য স্টল ফ্রি ঘোষণা দিয়েও পরবর্তীতে টাকা আদায় করার প্রমাণ মিলেছে।

কক্সবাজার জেলা প্রশাসন ও বীচ ম্যানেজমেন্ট কমিটি সূত্র জানায়, ২৭ সেপ্টেম্বর থেকে সৈকতের লাবনী পয়েন্টে ৭ দিনব্যাপী মেলাটি চলছে। মেলা উপলক্ষে সড়কের দুই পাশের ফুটপাতে নির্মান করা হয়েছে দুইশ স্টল। এছাড়া লাবনী পয়েন্টে বালিয়াড়িতে নির্মিত হয়েছে ২৫টি স্টল। তাছাড়া মেলায় প্রতিদিন সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত চলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

মেলার শুরু থেকে রবিবার পর্যন্ত সমুদ্র সৈকত এলাকা ঘুরে দেখা যায়, মেলাতে জনসমাগম বাড়াতে সমুদ্র সৈকতের সী ইন পয়েন্টের পাঁচ শতাধিক দোকানপাট বন্ধ রাখা হয়েছে। মেলার স্টলে ঠাই পেয়েছে গার্মেন্টেস কাপড়, নিম্ন মানের চকলেট, আচার, পান, চা, আমড়া, নানা ধরনের হোটেলের তৈরি নাস্তা, জুসবার, শুটকি ও সামুদ্রিক ভাজা মাছ (ফিস ফ্রাই)সহ হরেক রকম ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠান। তবে মেলায় দেখা যায়নি কক্সবাজার পর্যটন স্পটগুলো ‍স্থির চিত্র। জানানো হয়নি কক্সবাজার দর্শনীয় স্থান সম্পর্কে। মেলার মঞ্চের পেছনের সমুদ্র বালিয়াড়িতে নির্মিত ২৫টি স্টলের ৮টি কক্সবাজার স্থানীয় নারী উদ্দ্যোক্তরা পরিচালনা করলেও বাকি স্টলগুলো চালাচ্ছে নানা এনজিও। এসব স্টলগুলো থেকে ভাড়া আদায় করা হবে না মেলা শুরুর আগে এমন ঘোষণা দেওয়া হলেও পরবর্তীতে সেখান থেকেও টাকা নেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।

এ বিষয়ে সুগন্ধা পয়েন্টের একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী শাহা আলম বলেন, মেলা শুরুর আগে মেলায় দোকান নিতে বলা হয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে। এর জন্য তাদেরকে ১০ হাজার টাকা ব্যাংকে জমা দিতে বলা হয়। কিন্তু ওত টাকা না থাকায় স্টল নেননি তিনি। পরে বীচ কর্মীরা জানায় যতদিন মেলা চলবে ততদিন সুগন্ধা পয়েন্টের কোনো দোকান খোলা যাবে না। এজন্যই বাধ্য হয়ে দোকান বন্ধ রেখেছি।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মেলার আয় ব্যয়ের হিসাব রক্ষার্থে একটি নতুন ব্যাংক একাউন্ট খোলা হয়েছে। সেখানে স্টল ভাড়ার সর্বনিম্ন ১০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত জমা দিয়ে রসিদ দিয়েই নিতে হয়েছে স্টল। এর পাশাপাশি মেলা উপলক্ষে জেলা প্রশাসনের পর্যটন সেলের পক্ষ থেকে নতুন রশিদ বই ছাপা হয়েছে। আর রশিদ বই দিয়ে সমুদ্র সৈকতের ভ্রাম্যমান ঝালমুড়ি, চানাচুর, বাদাম, আমড়া, পান সিগারেট বিক্রেতার কাছ থেকে নেওয়া হচ্ছে টাকা। একই সঙ্গে কক্সবাজার স্থানীয় নারী উদ্যোক্তাদের জন্য স্টলগুলো ফ্রি ঘোষনা দেওয়া হলেও তাদের কাছ থেকে ৬ হাজার টাকা করে নিয়েছে কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স। পাশাপাশি লাবনী পয়েন্টে উম্মুক্ত মঞ্চের পাশে বীচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির বার্ষিক অনুমোদনে বসা ৮টি চটপটি ও ১টি চায়ের দোকান থেকে নেওয়া হয়েছে টাকা।

এ বিষয়ে একজন ক্ষুদ্র বাদাম বিক্রেতা (হকার) মিজান বলেন, মেলা চলছে শুনে শুক্রবার রাতে আমি আমার ভ্যান গাড়ি নিয়ে বাদাম বিক্রি করতে আসি। একটি স্টল খালি পড়ে রয়েছে দেখে সেই স্টলের সামনের ফাঁকা সড়কে ভ্যান দাঁড় করায়। এর কিছু্ক্ষণ পরেই বীচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির দুই সদস্য আমার কাছে এসে ভাড়া চায়। পরে তারা একটি স্লিপ দিয়ে দেড় হাজার টাকা নেন।

একই সময়ে এক প্রতিবন্ধি নারী বলেন, আমি ঝুড়িতে করে আমড়া বিক্রি করি, মেলার মঞ্চের পেছনে সমুদ্র ঘেঁষে আমড়া বিক্রি করি। শুক্রবার রাতে একটি স্লিপ দিয়ে ২ হাজার টাকা নেয় বীচ কর্মীরা।

আর স্থানীয় নারী উদ্যোক্তাদের ফ্রিতে স্টল দেওয়ার বিষয়ে গ্লোরিয়াস ওমেন এন্টারপ্রাইজ অব বাংলাদেশের নির্বাহি পরিচালক শাহরিন জাহান ইফতা বলেন, আমাদের ফ্রি স্টলের কথা বলা হয়েছিল। সেকারণে প্রথমে আমরা ২৫টি স্টল পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কিন্তু পরে টাকা দাবি করায় আমরা ৮টি স্টল নিয়েছি। এর জন্য ৬ হাজার করে ৪৮ হাজার টাকা দিয়েছি। বাকি স্টলগুলো চেম্বার অব কমার্সের এনজিওকে ভাড়া দিয়েছে।

তবে কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী খোকা বলেন, কক্সবাজার জেলা প্রশাসন নারীদের জন্য কিছুই করেনি। তারা শুধু স্থান নির্ধারন করে দিয়েছিল। আর সেখানে প্যান্ডেল ও স্টল তৈরি সব চেম্বার অব কমার্স করেছে। এই কারণে নারীদের কাছ থেকে আমরা ৬ হাজার টাকা করে নিয়েছি। বাকি টাকা আমরা ভুর্তকি দিয়েছি। যেসব এনজিওতে নারী উদ্যোক্তা রয়েছে তাদেরকে দেওয়া হয়েছে অন্য স্টল।

তবে, কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট (এডিএম) আবু সুফিয়ান বলেন, নারী উদ্যোক্তাদের বিশেষ জোন থেকে টাকা নেয়ার প্রশ্নই আসে না। ওখানকার সমস্ত স্টল ফ্রি ঘোষনা আগেই করা ছিল। কাজেই এখান থেকে টাকা নেওয়া অনৈতিক। বিষয়টি আমি দেখছি।

ঝালমুড়ি, বাদাম, চানাচুর বিক্রেতা থেকে টাকা নেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, এমন হতে পারেনা । আমরা সমস্ত অনুদান, স্টল ভাড়ার টাকা ব্যাংক একাউন্টে জমা নিয়েছি। কেউ যদি স্লিপ বা রশিদ দিয়ে টাকা নিয়ে থাকে সেটির দায়ভার আমার বা প্রশাসনের নয়।

এ বিষয়ে শুক্রবার রাতে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) আল আমিন পারভেজ বলেছিলেন, ব্যাংক একাউন্ট ছাড়া কোথাও কোনো ধরনের লেনদেন হলে সেটি অবৈধ। হকার, ভ্রাম্যমান বিক্রেতারদের কাছ থেকে টাকা আদায় অপরাধ। আমাদেরকে দুটি দিন সময় দিন যাদের থেকে স্লিপ দিয়ে টাকা আদায় হয়েছে তাদেরকে টাকা ফেরত দেওয়া হবে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এর পর পরই জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে ভ্রাম্যমান হকোরদের, নারী উদ্যোক্তা ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সমিতি থেকে নেওয়া অনুদান ফেরত দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয় সংশ্লিষ্ঠদের। কিন্তু রোববার রাত সাড়ে ৭টায়ও সকলের টাকা ফেরত দেয়নি সংশ্লিষ্টরা। আরও প্রায় ২০ জন ভ্রাম্যমান হকার তাদের কাছ থেকে নেওয়া টাকা ফেরত পায়নি। স্টল ভাড়া ফেরত পায়নি নারী উদ্যোক্তারা।

তবে কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের নির্বাহি ম্যাজিস্ট্রেট মাসুম বিল্লাহ বলেন, উর্ধতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে রসিদ বই দিয়ে অনেকের কাছ থেকে টাকা সংগ্রহ করা হয়েছিল। এতে কিছু ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সমিতিও ছিল। তাদের অনেকের টাকাসহ রোববার ৫ লাখের অধিক টাকা একাউন্টে জমা হয়েছে। এ ছাড়া মুসাফির সমিতি নামের একটি হকার সমিতির ও মিজান নামের এক হকারকে টাকা ফেরত দেওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে কথা বলার জন্য কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশীদকে কয়েক দফা মুঠোফোনে কল করা হলেও তিনি রিসিভ না করায় এবং ক্ষুদে বার্তার জবাব না দেওয়ায় তার বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: