বিএনপি কমিটিতে ১৪ নেতার ৪১ পদ!

প্রকাশিত: ১২ অক্টোবর ২০২২, ০৯:৪৬ পিএম

সদ্য ঘোষিত ঝিনাইদহ জেলা বিএনপির কমিটি নিয়ে তৃণমূলে ক্ষোভ আর অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়েছে। অনেকে এই কমিটিকে সভাপতি ও সম্পাদকের পকেট কমিটি বলেও আখ্যায়িত করেছেন। কারন হিসেবে বলা হচ্ছে নতুন এই কমিটিতে বিএনপির প্রভাবশালী একাধিক নেতা ৪০টির বেশি পদ দখল করেছেন। সাংগঠনিক পদ তিনটি। কাউন্সিলে প্রতিযোগিতা করেছেন দুই জন। যা গঠনতন্ত্র পরিপন্থী/অবৈধ। আর এই অসম্ভবকে সম্ভব করা হয়েছে ব্যাপক অনিয়ম সেচ্ছাচারিতা ও স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে।

গত ৫ সেপ্টম্বর জেলা কমিটির তালিকা সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমে প্রকাশের পর পদ বঞ্চিত নেতা ও সংগঠনকে ভালোবাসে এমন সমর্থকরা জেলা নেতাদের বিরুদ্ধে সমালোচনার ব্যাপক ঝড় তুলেছে। অনেকে ২৫ বছর ধরে ঢাকায় বসবাস ও ব্যবসা বানিজ্য করেন এমন ব্যাক্তিকেও জেলা কমিটিতে স্থান দেওয়া হয়েছে। আবার বিভিন্ন সময় আওয়ামীলীগের মিছিল মিটিংয়ে সরব এমন ব্যক্তিকে জেলা বিএনপির কমিটিতে রাখা হয়েছে বলে অভিযোগ। এ নিয়ে ঢাকায় অনুষ্ঠিত খুলনা বিভাগীয় বিএনপির সমাবেশে তোপের মুখে পড়েন জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক জাহিদুজ্জামান মনা। ওই সভায় সভাপতি এম এ মজিদ যোগদান করেননি।

জেলা বিএনপির সাংগঠনিক পদ তিনটি। কিন্তু জেলা বিএনপির কাউন্সিলে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেন ৪জন। এরা হলেন সাজেদুর রহমান পাপপু ও শাহজাহান আলী, আসিফ ইকবাল মাখন ও প্রভাষক কামাল উদ্দীন। পরবর্তীতে আসিফ ইকবাল মাখন ও প্রভাষক কামাল উদ্দীন নির্বাচন থেকে সড়ে দাড়ান। ফলে সাজেদুর রহমান পাপপু ও শাহাজান আলীর মধ্যে প্রকাশ্যে নির্বাচন হয়। এতে সাজেদুর রহমান পাপপু জয় লাভ করে। যা অবৈধ বলে বিবেচিত হয়।যেখানে পদ তিনটি নিবার্চন করলো দুইজন। এখানে কোন নির্বাচন হয় না বলে অভিযোগ রয়েছে নেতা কর্মীদের মাঝে। তারা বলেন, জেলা বিএনপির সভাপতি এ্যাডভোকেট এম এ মজিদ গায়ের জোড়ে নির্বাচন করান।

৫ সেপ্টম্বর জেলা কমিটির তালিকা থেকে দেখা যায় শাহজাহান আলী যুগ্ম সাধারন সম্পাদক পদ দেওয়া হয়। যেখানে সে সাংগঠনিক সম্পাদক পদের জন নির্বাচন করেছেন পরাজয় বরন করেছিলেন। ২ নং সাংগঠনিক পদে জাহাঙ্গীর হোসেকে ও ৩ নং সাংগঠনিক পদে জহুরা খাতুন মৌ চৌধুরীকে দেওয়া হয়েছে। যেখানে কাউন্সিলে জাহাঙ্গীর হোসেন ও জহুরা খাতুন মৌ চৌধুরী প্রতিযোগিতা করেননি। তৃনমুল নেতা কর্মীদের মাঝে এসব প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। যা তাদের মাঝে ক্ষত বিক্ষত করে তুলছে। ব্যাপক অনিয়ম সেচ্ছাচারিতা ও স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে এ কমিটি হয়েছে বলে তারা জানান। এ কমিটি বাতিলের জন্য কেন্দ্রীয় বিএনপির নিকট আবেদন জানান।

তথ্য নিয়ে জানা গেছে, বিএনপি নেতা আনোয়ারুল ইসলাম বাদশা কেন্দ্রীয় কৃষক দলের সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি আবার জেলা কৃষক দলেরও আহবায়ক। তাকে আবার সদ্য ঘোষিত জেলা কমিটির সহ-সভাপতি করা হয়েছে। জিয়াউর রহমান জিয়া মহেশপুর থানা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও মহেশপুর থানা যুবদলের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তাকেও জেলা বিএনপির সদস্য করা হয়েছে। কামরুজ্জামান লিটন জেলা জাসাসের সাধারন সম্পাদক ও সদর থানা বিএনপির সহ সাধারণ সম্পাদক। তাকে জেলা বিএনপির সদস্য করা হয়েছে। জেলা বিএনপির সভাপতি এ্যাড: এম এ মজিদের ব্যবসায়ীক পার্টানার মোঃ শাহিন খাঁন আওয়ামীলীগ পরিবারের সন্তান। তাকে সদর উপজেলার কাচিরনপুর ইউনিয়ন বিএনপির সদস্য, সদর থানা বিএনপির সহ দপ্তর সম্পাদকের পর জেলা বিএনপির সহ দপ্তর সম্পাদক বানানো হয়েছে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ২০০৩ সালে হাফিজ চেয়ারম্যানের সাথে আওয়ামীলীগে যোগদান করেন।

২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য মোঃ সফিকুল ইসলাম অপুর সাথে নির্বাচনী মাঠে বিএনপি নেতা কর্মীদের চরম নির্যাতন করেন। গত ৩ বছর আগে জেলা বিএনপির সভাপতির পার্টানার হওয়ার পরেও তিনি আওয়ামীলীগের সভা সমাবেশে সরব ছিলেন। তিনি বিএনপিতে যোগদান না করেই সভাপতির ব্যবসায়ীক পার্টানার হিসাবে প্রভাব খাটিয়ে বিএনপির একাধিক পদ বাগিয়ে নিয়েছেন। আগামী নিউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে কালিচরনপুর ইউনিয়নে বিএনপি থেকে তাকে মনোনয়ন দেওয়া হবে এই আশায় এলাকায় শুভেচ্ছা জানিয়ে পোষ্টার টাঙ্গিয়ে রেখেছেন।

এদিকে কলেজের প্রভাষক কামাল উদ্দিন জেলা বিএনপির সহ সম্পাদক ছাড়াও জেলা জিয়া পরিষদের সভাপতি ও হরিনাকু-ু থানা বিএনপির সদস্য। প্রভাষক এম আক্তারুজ্জমান মুকুল নিজ উইনিয়নের সদস্য, থানা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক তাকেও জেলা বিএনপির প্রচার সম্পাদক করা হয়েছে। যুব নেতা আশরাফুল ইসলাম পিন্টু সদ্য ঘোষিত জেলা বিএনপির যুব বিষয়ক সম্পাদক হয়েছেন। কিন্তু তিনি এর আগেই জেলা যুব দলের সাধারণ সম্পাদক ও হরিনাকুন্ডু থানা বিএনপির সদস্য হিসেবে রয়েছেন।

শৈলকুপার উসমান আলী জেলা বিএনপির সহ সভাপতি, শৈলকুপা বিএনপির সহ সভাপতি ও কেন্দ্রীয় কৃষকদলের সহ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। কালীগঞ্জের হারুন মোল্লার কালিগজ্ঞ থানা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক, কৃষকদলের নির্বাহী সদস্য ছাড়াও জেলা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক হয়েছেন। প্রভাষক জাহাঙ্গীর হোসেন সদর থানা বিএনপির সদস্য ও জেলা জিয়া পরিষদের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তাকে নতুন কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক করা হয়েছে। কালীগঞ্জের সাইফুল ইসলাম ফিরোজ কেন্দ্রীয় সেচ্ছাসেবক দলের সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বে আছেন। কালিগজ্ঞ থানা বিএনপির সদস্য এই নেতাকেও জেলা বিএনপির নুতন কমিটির সদস্য রাখা হয়েছে। জেলা বিএনপি সভাপতির শশুর ৭৮ বছর বয়সী কালীগঞ্জের আতিয়ার রহমান পৌর বিএনপির আহবায়ক। তাকে আবার জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি করা হয়েছে। প্রভাষক আব্দুল খালেক ঝিনাইদহ সদর থানা বিএনপির ২নং যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি আবার পাগলাকানাই ইউনিয়ন বিএনপিরও সদস্য। তাকে জেলা বিএনপির তথ্য ও গবেষনা সম্পাদক করা হয়েছে। ডাকবাংলার আলাউদ্দিন আল মামুন সাগান্না ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি হিসেবে দায়িত্বে আছেন। তিনি আবার সদর থানা বিএনপির সদস্য। তাকে জেলা বিএনপির সহ সভাপতি করা হয়েছে। এ্যাড মুন্সি কামাল কামাল আজাদ পান্নু সদর থানা বিএনপির সভাপতি। তাকেও জেলা বিএনপির সহ সভাপতি করা হয়েছে। থানা বিএনপির সাধারন সম্পাদক আলমগীর হোসেন চেয়ারম্যান ও ঝিনাইদহ পৌর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুর রহমান শেখরও একাধিক পদে রয়েছেন তাদের ও জেলা বিএনপির নির্বাহী সদস্য করা হয়েছে। পল্লি বিদ্যুতের ঠিকাদার ইঞ্জনিয়ার শাহিন নামে এক ব্যক্তি ২০১৮ সালে সংসদ নির্বাচনের সময় নৌকার প্রার্থীর নির্বাচনী মে উঠে যোগদান করেন।

গত ১১ সেপ্টম্বর ২০২২ পৌরসভা নির্বাচনের সময় তার নিজস্ব ব্যবসায়ীক অফিসে নৌকার প্রচার অফিস বানিয়ে নৌকার পক্ষে ভোট করেন। তাকেও বিএনপির নতুন কমিটির সহ-কোষাধ্যক্ষ পদ দেওয়া হয়েছে। লোকমান হোসেন পৌর বিএনপির ২নং সাংগঠনিক সম্পাদক। তাকে জেলা বিএনপির সদস্য করা হয়েছে। মনিরুজ্জামান খান মিঠু পৌর বিএনপির ১নং যুগ্ম সম্পাদক। তাকে জেলা বিএনপির সদস্য করা হয়েছে। জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক জাহিদুজ্জামান মনার শ্যালক মহেশপুরের জাহিদ হিরোনকে ইউনিয়ন কমিটি, থানা বিএনপির ও সর্বশেষ জেলা বিএনপির সদস্য করা হয়েছে। জাহিদ হিরোনের গোটা পরিবার আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বলে জানা গেছে। ঢাকার উত্তরার জনৈক শাহিনকে জেলা বিএনপির সদস্য করা হয়েছে। তিনি সভাপতি এ্যাডভোকেট এম এ মজিদের ঢাকার প্রতিবেশি। কোটচাঁদপুরের আব্দুর সবুর খান ২৫ বছর ধরে ঢাকায় স্থায়ী ভাবে বসবাস করছেন। সভাপতি মজিদের ব্যবসায়ীক পার্টনার হওয়ার কারণে তিনিও জেলা বিএনপির শিল্প ও বানিজ্য বিষয়ক সম্পাদকের পদ পেয়েছেন।

এদিকে জেলা বিএনপির কাউন্সিলে থানা বিএনপির সভাপতি এ্যাডভোকেট কামাল আজাদ পান্নু ও পৌর বিএনপির সভাপতি আব্দুল মজিদ বিশ্বাস পদত্যাগ করে জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক পদে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেন। নির্বাচন পরবর্তী সময়ে থানা বিএনপির সভাপতি এ্যাডভোকেট কামাল আজাদ পান্নু জেলা বিএনপির সভাপতি ও সম্পাদকের পচ্ছন্দের ব্যক্তি হওয়ায় তাকে থানা বিএনপির সভাপতির পদে পুনর্বহাল করা হয়েছে। অথচ আব্দুল মজিদ বিশ্বাসকে পৌর বিএনপির সভাপতির পদ ফেরৎ দেওয়া হয়নি।

সাংগঠনিক সম্পাদক পদে আ’লীগের মহিলা এমপির জামাই সাজেদুর রহমান পাপপুকে অর্থের বিনিময়ে নির্বাচিত করা হয়েছে বলে গুজব ছড়িয়েছে। পাপপু পরোকীয়ার মাধ্যমে ঘরে স্ত্রী সন্তান থাকার পরও অন্যের স্ত্রী ভাগিয়ে বিয়ে করেন। জেলা সাংগঠনিক সম্পাদক পদে প্রতিদ্বন্দিতাকারী আসিফ ইকবাল মাখন ও শাজাহাজাহান আলীকে সাংগঠনিকের বাকী দুইটি পদ দেওয়া হয়নি। জেলা বিএনপির ১ নং সিনিয়র সভাপতির মতো ভাইটাল পদে অসুস্থ আক্তারুজ্জামানকে বসানো হয়েছে। তিনি সদস্য পৌরসভা নির্বাচনে দলীয় নির্দেশ অমান্য করে স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে প্রকাশ্যে ভোট করেন। তার বিরুদ্ধে আর্থিক লেনদেনেরও গুরুতর অভিযোগ রয়েছে।

ঝিনাইদহ জেলা বিএনপির কমিটি নিয়ে বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা মশিউর রহমান বলেন, দলের কেন্দ্র থেকে সিদ্ধান্ত দেওয়া আছে পৌর, উপজেলা ও জেলা বিএনপির কমিটিতে এক নেতা এক পদ পাবেন। একজন নেতা একের অধীক পদ পাবেন না। যদি কোন নেতা একের অধীক পদে থাকেন তবে সেটা অবৈধ হিসাবে বিবেচিত হবে। নতুন কমিটিতে এমন অনেক নেতা একাধিক পদে রয়েছেন যা অবৈধ।

ঝিনাইদহ জেলা বিএনপির সভাপতি এ্যাডভোকেট এম এ মজিদ অনিয়ম সেচ্ছাচারিতা ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, টপ ফাইভ (সভাপতি, ১ নং সহ-সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, ১ নং সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদক) পদে দলের এমন নির্দেশনা আছে। অন্যান্য পদে নেই। যদি কেউ এমন ব্যাখ্যা দেন তবে সেটা আইনত অগ্রাহ্য হবে। তিনি দলে অপ্রাপ্ত বয়সীদের পদ দেওয়া নিয়ে বলেন ১৮ বছর হলে যে কেউ বিএনপির সদস্য হতে পারবেন। জেলা বিএনপির কমিটি নিয়ে যারা প্রশ্ন তুলছেন বা বিদ্বেষ ছড়াচ্ছেন তারা বিএনপির ভালো চান না বলে তিনি দাবী করেন।

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: