উন্নয়ন হোক তারুণ্য নির্ভর

প্রকাশিত: ২৪ অক্টোবর ২০২২, ১০:০৯ এএম

তারুণ্যের শক্তি বিশ্বায়নের যুগে একটি দেশকে নেতৃত্বের আসনে চালিত করতে বড় ভূমিকা রাখে। ক্ষুদ্র, মাঝারি কিংবা বড় উদ্যোক্তা তৈরী করা যেকোনো দেশের স্থিতিশীল উন্নয়নে ইতিবাচক। কারন তরুণরা সবসময় আশাবাদী হয়। আবার পুরনো ধ্যান-ধারণাকে পাল্টে সমাজ পরিবর্তনের মূল কাঁঠি হিসেবে তরুণদের পথচলা একটি জাতিকে নতুন যুগে প্রবেশ করায়। এটাই তরুণ্যের ধর্ম।

আমাদের দেশের মোট জনগোষ্ঠীর ৩৪ শতাংশ তরুণ। একটি অনলাইন সংবাদপত্রের জরিপে জানা গেছে, তরুণদের ৮৭.৫ শতাংশ আশাবাদী হওয়ার মতো মনোভাব রাখে। তাদের মধ্যে ৪৭ শতাংশ তরুণের যে লক্ষ্য, তা অর্জন করার ব্যাপারে তারা খুব বেশি আত্মবিশ্বাসী। যদি এটিকে বয়সভিত্তিক বিবেচনা করা হয় তবে দেখা যায় ১৮ থেকে ২২ বছর বয়সী তরুণদের ৫৫ শতাংশ তাদের জীবন সম্পর্কে অনেক বেশি আশাবাদী।

যদি ২৩ থেকে ৩০ বছর বয়সী তরুণদের কথা ভাবা হয় তবে আশাবাদী তরুণের হার ৪৬ শতাংশ। তবে ৩০ থেকে ৪০ বছর বয়সী জনগোষ্ঠীর ৩৫ শতাংশ ইতিবাচক ধারণা পোষণ করেন।

যদিও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করে যে, শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত ও অশিক্ষিত জনগোষ্ঠীকে বিবেচনায় ১০ কোটি ৯১ লাখ কর্মক্ষম মানুষের মধ্যে ৬ কোটি ৮ লাখ মানুষ কর্মে নিয়োজিত। অর্থাৎ এখনও পর্যন্ত দেশের ৪ কোটি ৮২ লাখ ৮০ হাজার মানুষ শ্রমশক্তির বাইরে থেকে গেছে। আমাদের এই বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে কর্মে নিয়োজিত করা গেলে চলতি উন্নয়ন আরও গতিশীল হবে।

কৃষিপ্রধান হওয়ায় কর্মসংস্থানের মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখছে তরুণরা। তরুণদের কৃষিতে অবদান ২৪ শতাংশ, শিল্পে ৩০ শতাংশ, এবং সেবাখাতে ৪৬ শতাংশ। এর মধ্যে বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে ২১.০৯ শতাংশ, হাউসহোল্ডে ১৫.৫৯ শতাংশ, সরকারি প্রতিষ্ঠানে ৩.৩৮ শতাংশ এনজিওতে ০.৭৬ শতাংশ, ব্যক্তিগত পর্যায়ে ৫৮.২৪ শতাংশ এবং অন্যান্য সেক্টরে ০.৯৫ শতাংশ নিয়োজিত রয়েছে।

দেশের ৫ কোটি ৩০ লাখ তরুণ সমাজকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তিতে রুপান্তরিত করা গেলে বাংলাদেশ ২০৩০ সালে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ও ২০৪১ সালের রূপকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে বিশ্বের বুকে উন্নত দেশ হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে।

জাতিসংঘের এক প্রতিবেদন মতে, ২০৫০ সাল নাগাদ তরুণদের সংখ্যা ১০ থেকে ১৯ শতাংশে নেমে আসবে। তাই আজকের এই বিশাল কর্মক্ষম ও উদ্যমী তরুণ জনশক্তিকে জনসম্পদে পরিণত করার এখনই সময়।

তবে এক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, কর্মে নিয়োজিতদের মধ্যে থেকে কত শতাংশ নিজ প্রচেষ্টায় ক্ষেত্র তৈরি করতে পেরেছে সেটির কোন নির্দিষ্ট পরিসংখ্যান নেই। অর্থাৎ কর্মে নিয়োজিত করার ক্ষেত্রে উদ্যোক্তা তৈরির যে কৌশল সেটি যথাযথ কিনা তা ভেবে দেখতে হবে।

আরও উল্লেখ করবার মত বিষয় হল, তরুণদের মাঝে নিজ প্রচেষ্টায় কর্মক্ষেত্র তৈরির চেয়ে প্রস্তুতকৃত কর্মক্ষেত্রে নিয়োজিত হবার প্রবণতা বেশি দেখা যায়। যেটি মূলত উদ্যোক্তা তৈরির ক্ষেত্রে আশান্বিত কোন বাস্তবতা নয়। যেসকল উন্নত রাষ্ট্রসমুহ প্রযুক্তি কিংবা অন্যান্য বৈশ্বিক নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে নিজেদের আধিপত্য ধরে রেখেছে, আমরা খেয়াল করলে দেখব তাদের এই অগ্রগতির পেছনে তরূণদের অবদান অসামান্য।

বেকারত্ব এবং কর্মসংস্থানের অভাবে আমাদের দেশে এই মুহূর্তে তরুণদের একটি বড় অংশ তাদের শিক্ষা ও কর্মজীবন নিয়ে উদ্বিগ্ন। বিষয়টি তারা তাদের কথায় এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশ করছে। এ ছাড়াও তরুণদের একটা বড় অংশ তাদের নিয়মিত লেখাপড়া শেষ করার আগেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ত্যাগ করেছে। এর পেছনে রয়েছে দারিদ্র্য, সুযোগের অভাব, লেখাপড়ায় অকৃতকার্যতা এবং বিদেশে যাওয়ার প্রত্যাশা।

২০১৮ সালের একটি জরিপে দেখা যায়, বাংলাদেশে এখনও প্রায় ৩৫ শতাংশ তরুণ টেলিভিশন দেখে না কিংবা রেডিও শোনে না।

আপাতদৃষ্টিতে তরুণ সমাজ বললেই যে নতুন প্রাণের শক্তি নিয়ে তারুণ্যের একদল তরুণ-তরুণীর ছবি আমাদের চোখের সামনে ভাসে, তার একটা বড় অংশই কারিগরি শিক্ষা ও প্রয়োজনীয় তথ্য এবং তথ্যের বাইরে অবস্থান করছে।

গত কয়েক দশক ধরে নিজেদেরকে পৃথিবীর অন্যতম প্রযুক্তিধর দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে ইসরায়েল। মাত্র ৮০ লক্ষের চেয়ে সামান্য বেশি জনসংখ্যার এই দেশে অবিশ্বাস্যভাবে ৪ হাজারেরও বেশি প্রযুক্তি কোম্পানি রয়েছে। সিসকো, পেপাল, মাইক্রোসফট, গুগল, ফেসবুক, অ্যাপল কিংবা ইনটেল হচ্ছে এমনই কিছু হাতেগোনা কোম্পানির নাম, যারা ইসরায়েলে নিজেদের নতুন পণ্য উৎপাদন ও গবেষণার কাজ করে।

ইসরায়েলে ৪ হাজারেরও বেশি টেক কোম্পানি রয়েছে, যেগুলোর মধ্যে বিশ্বের প্রথম সারির সবচেয়ে বড় কোম্পানিগুলোর নাম। বিশ্বের সবচেয়ে প্রধান ৫০০টি টেক-জায়ান্টের ৮০টিরই গবেষণাকেন্দ্র এবং নব্যপ্রযুক্তি বিষয়ক কেন্দ্র রয়েছে ইসরায়েলে। মূলত দেশটির এমন অভাবনীয় উন্নয়নের পেছনে তাদের তরুণ উদ্যোক্তাদের পথচলা বিশেষ ভূমিকা রেখেছে।

আইএলও-এর হিসাব মতে, ২০১৮ সালে বাংলাদেশে তরুণদের কর্মসংস্থানহীনতার হার ছিল ১২ শতাংশ। এ পরিস্থিতির তেমন কোন উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন এখনও পরিলক্ষিত হয়নি। তরুণদের কিভাবে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যাবে, সে জন্য ব্যাংকিং সেক্টরকে কাজে লাগাতে হবে। এদেশে শিক্ষিত তরুণরা যে ধরনের কর্মসংস্থান পাচ্ছে, তাতে বেতন অত্যন্ত স্বল্প এবং অনেকটা অপ্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর মতো। স্বাবলম্বী করার জন্য আত্মনির্ভরশীল করে তোলার মাধ্যমে পরমুখাপেক্ষীহীন করার প্রয়াস গ্রহণ করা হয়নি।

সরকারী সংস্থা কিংবা বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলো কতটুকু স্কিল এনহ্যান্সমেন্ট করতে সক্ষম হয়েছে, সেটি একটি জরিপের মাধ্যমে সরকার খুঁজে বের করতে পারে। এ ব্যাপারে পরিকল্পনা কমিশনও একটি প্রকল্প গ্রহণ করতে পারে। আত্মনির্ভরশীল হোক, স্বকর্মসংস্থান হোক, আগামী দিনে তরুণদের জন্য নিজের পায়ে দাঁড়ানোটাই একটি চ্যালেঞ্জস্বরূপ। আশা করব সরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠুক, বিসিকের শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহের সমস্যা দূরীভূত হোক এবং রফতানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহের পাশাপাশি নতুন শিল্প খাত গড়ে উঠুক- যাতে তরুণ-তরুণীদের কর্মসংস্থান হয়। এ বিষয়ে গবেষণার ক্ষেত্রে ইউজিসি গুরুত্ব দিক।

লেখক: ড. জান্নাতুল ফেরদৌস, সহযোগী অধ্যাপক, লোক প্রশাসন বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: