গাড়ল পালন করে এখন বছরে আয় কোটি টাকা

প্রকাশিত: ০৯ নভেম্বর ২০২২, ০৬:০৫ পিএম

আব্দুল বাশির, চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে: চাঁপাইনবাবগঞ্জের রয়েছে হাজার হাজার বিঘা আমের বাগান। বাগানের গাছের নিচে থাকা লতাপাতা ও ঘাসকে কাজে লাগিয়ে ২০১৭ সালে মাত্র ৪৪টি গাড়ল নিয়ে খামার গড়ে তোলেন মো. মাসুদ রানা। গাড়ল খামারের সফলতায় শিবগঞ্জ উপজেলার কানসাট ইউনিয়নের শিবনারায়ণপুর গ্রামের বাসিন্দা মো. মাসুদ রানাকে মাত্র ৩৩ বছর বয়সেই আদর্শ উদ্যোক্তা হিসেবে পরিচিত লাভ করিয়েছে।

মাত্র তিন বছরের ব্যবধানে খামারে বছরে কোটি টাকা আয় শুরু হয়েছে মাসুদ রানার। গাড়ল দিয়ে শুরু করলেও গাড়ল খামারের সফলতা পেয়ে পাশাপাশি আরেকটি গরু খামার তৈরিতে উদ্বুদ্ধ করে তরুণ উদ্যোক্তা মাসুদ রানাকে। তার প্রতিষ্ঠিত মধুমতি গাড়ল ও গরু খামারের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে স্থানীয় তরুণ উদ্যোক্তারা। সেই সাথে খামারে সৃষ্টি হয়েছে বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান।

মাত্র ৪৪টি গাড়ল দিয়ে খামার শুরু করলেও এখন মাসুদ রানার মধুমতি খামারে রয়েছে প্রায় দুই শতাধিক গাড়ল। গত ৪ বছরে ইতোমধ্যে বিক্রি করেছেন প্রায় তিন শতাধিক গাড়ল। প্রতিনিয়তই খামারে বাড়ছে গাড়লের সংখ্যা। গাড়লের মাংস ও চামড়ার ব্যাপক চাহিদা থাকায় খরচের চাইতে অধিক দামে বিক্রি করছেন খামারে পালিত গাড়ল।

মো. মাসুদ রানা মার্কেটিং বিভাগ হতে বিবিএ ও এমবিএ সম্পন্ন করেন। এরপর বিভিন্ন দপ্তরে দপ্তরে চাকুরির জন্য ঘুরতে থাকেন। অবশেষে নিজ বাড়ির পাশে একটি উন্নত জাতের গাড়ল খামার গড়ে তুলেন। গাড়ল খামারে সাফল্য পেয়ে সেখানেই গড়ে তুলেছেন মধুমতি ডেইরি খামার। সেখানে প্রায় দুইশ গরুর মধ্যে বর্তমানে প্রতিনিয়ত দুধ দিচ্ছে ৩৫টিতে। এই দুই খামারে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে স্থানীয় অন্তত ১৭ জন বেকার মানুষের।

খামার শ্রমিক মো. মিঠুন বলেন, ২০১৭ সাল থেকে খামার শুরুর সময় থেকেই আমি এখানে যুক্ত আছি। ধীরে ধীরে ৪৪টি গাড়ল বেড়ে এখন দুইশ ছাড়িয়েছে। ইতোমধ্যে বিক্রি করা হয়েছে প্রায় সাড়ে তিনশ গাড়ল। বাজারে এর ব্যাপক চাহিদা থাকায় দ্রুত লাভবান হওয়া সম্ভব হয়েছে। খামার থেকেই গাড়ল কিনে নিয়ে যায় ক্রেতারা। ডায়াবেটিস ও প্রেসারের রোগীদের জন্য খুবই সহায়ক হওয়ায় এর ক্রেতাও অনেক।

তিনি আরও বলেন, মালিক প্রথমে বিনিয়োগ করলেও দুই খামারে থাকা ১৭ জন শ্রমিকের বেতন অন্যান্য খরচ বাদ দিয়ে আমরা এখন তাকে লাভের টাকা তুলে দিতে পারি। এই খামারে এসে অনেকেই বাচ্চা নিয়ে খামার শুরু করেছে। তারা বিভিন্ন সময়ে নানারকম পরামর্শ নিতে আসে। আমার মতো ১৭ জন শ্রমিকের সংসার চলে এই খামার থেকে।

আরেক শ্রমিক তরিকুল ইসলাম জানান, আমরা খামারের পাশে বিলের জমিতে বিভিন্ন ঘাস চাষাবাদ করি। সেসব ঘাস, খড়, ভুসি, ডাল, ভুট্টা, গম ভাঙ্গা, সরিষার খৈল খাবার হিসেবে গাড়ল ও গরুকে দিয়ে থাকি। এছাড়াও খাবার প্রদানে আমরা হাতে কাটার বাদ দিয়ে মেশিন ব্যবহার করি। সবগুলো খাবার মিশিয়ে তারপর গাড়ল ও গরুকে প্রদান করে থাকি। মাসুদ রানার মতো এমন উদ্যোক্তার কারনে আজ সুফল পাচ্ছে আমার মতো আরও ১৭ জনের পরিবার।

গাড়ল ও গরুকে দেয়া খাবার থেকে নষ্ট হওয়া খাবারকে কাজে লাগিয়েছে মধুমতি খামার। গাড়ল ও গরুর খামারের পাশাপাশি ব্যতিক্রমী একটি ঘোড়ার খামার গড়ে তুলেছেন তরুণ উদ্যোক্তা মাসুদ রানা। ফেলা দেয়া খাবারগুলো দেয়া হয় ঘোড়াকে। এনিয়ে খামার শ্রমিক আলমগীর হোসেন বলেন, গরু ও গাড়লে দেয়ার পর তারা যেসব খাবার নষ্ট করে দেয়, যা আমাদের ফেলে দিতে হতো। এখন তা আমরা ঘোড়াকে দেয়। উছিষ্ট খাবারকে ব্যবহার করে বিনোদনের উদ্দেশ্যে খামারে যুক্ত করা হয়েছিল ৫টি ঘোড়া। বাচ্চা দেয়ার পর মধুমতি খামারে এখন মোট ঘোড়া ৭টি। আরও একটি ঘোড়া বর্তমানে গর্ভবতী রয়েছে। এখানে ঘোড়া দেখতে দূর দূরান্ত থেকে ছুটে আসছে বিনোদনপ্রেমীরা।

মধুমতি খামারের ম্যানেজার মোশাররফ হোসেন জানান, বর্তমান সময় প্রযুক্তির। মধুমতি খামারেও ব্যাপকভাবে প্রযুক্তির ব্যবহার করা হয়েছে। হাতের স্পর্শ ছাড়াই সংগ্রহ করা হয় দুধ। যা সম্পূর্ণভাবে জীবাণুমুক্ত। এছাড়াও গাড়ল ও গরুকে নিয়মিত গোসল এবং প্রতিদিন জীবানুনাশক স্প্রে করা হয়। এমনকি খামারে গরু থেকে পাওয়া গোবরকে কাজে লাগিয়ে গ্যাস উৎপাদন করে বাজারজাত করার পরিকল্পনা রয়েছে খামার কর্তৃপক্ষের।

মধুমতি ডেইরী খামারের দুধ থেকে স্থানীয়ভাবে তৈরি হচ্ছে নানান জাতের মিষ্টি৷ খামার থেকেই দুধ কিনে নেন মিষ্টির দোকানীরা। মিষ্টি দোকানী ও দুধ ক্রেতা রিন্টু ঘোষ জানান, গত ৩০ বছর ধরে এই ব্যবসা করি। কিন্তু বাড়ি বাড়ি যারা দুধ সংগ্রহ করে তাদের দুধে অনেক সময় ভেজাল পেয়েছি। কিন্তু গত দুই বছর ধরে মধুমতি ডেইরী খামারের সবগুলো দুধ আমি একাই কিনে নেয়। দুধ ভালো হওয়ায় মিষ্টির মানও ভালো হয়। ফলে আমরাও লাভবান হয়।

তরুণ উদ্যোক্তা মো. মাসুদ রানা'র সাথে আলাপকালে তিনি বলেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জে আমগাছের নিচে অনেক গাছপাল, ঘাস ও লতাপাতা হয়ে থাকে। এসবকে কাজে লাগিয়ে গাড়লের খাবার হিসেবে খামার তৈরি করেছি। এর বাইরে গাড়লকে তেমন খাবার দিতে হয় না। গাড়লের সফলতা পেয়ে এরই ধারাবাহিকতায় গরুর ডেইরী খামার প্রতিষ্ঠা করি। দুই বছর থেকে বছরে দুই খামার থেকে কোটি টাকা আয় হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, গরু ও গাড়লের খামার থেকে আয়ের টাকায় ২০২১ সাল থেকে শুরু করি মধুমতি বিজনেস ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড নামে একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। সেখানে উৎপাদিত হয় তেল, আটা, খাতা, টিস্যু ব্যাগ, বিশুদ্ধ পানি, ব্যাটারির পানিসহ ২১টি উৎপাদনমুখী পন্য উৎপাদন করে তা বাজারজাত করছে মধুমতি। সেখানে অন্তত তিনশ বেকার যুবকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের খামার দেখে অনেক তরুণ বেকার যুবক এখানকার বাচ্চা সংগ্রহ করে ও পরামর্শ নিয়ে থাকে।

শুরু থেকেই গাড়ল ও গরু খামারে নানরকম পরামর্শ দিয়ে আসছে শিবগঞ্জ উপজেলা প্রাণীসম্পদ কার্যালয়। অনেক তরুণ উদ্যোক্তা মাসুদ রানার গাড়ল ও ডেইরী খামার দেখে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন বলে জানান শিবগঞ্জ উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. রনজিৎ চন্দ্র সিংহ। তিনি বলেন, বর্তমানে মাসুদ রানাকে দেখে অনেকেই খামার তৈরিতে আগ্রহী হয়েছেন। সেখান থেকে গাড়ল ও গরুর বাচ্চা নিয়ে গিয়ে গড়ে তুলছেন খামার। তাদেরকে সঠিক পরামর্শ প্রদান করছে মধুমতি খামারের উদ্যোক্তা মাসুদ রানা।

তিনি আরও বলেন, গাড়ল পালনে তেমন খরচ হয় না। সঠিক নিয়মে পরিচর্যা ও দেখাশোনা করলেই বড় হয়। খামারের আশেপাশে ব্যাপক চারণভূমি থাকায় সারাদিন বাইরের খাবারেই বড় হয়। এ ছাড়া গাড়লগুলো শৃঙ্খলাবদ্ধ হওয়ায় তাদের লালন পালনে তেমন বেগ পেতে হয় না। একেকটি গাড়ল ১৪ মাসে দুটি করে বাচ্চা দেয়। ফলে মাসুদ রানাকে দেখে অনেকেই গাড়লের খামার তৈরিতে আগ্রহী হচ্ছেন।

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: