ভাঙা হলো তসলিমা নাসরিনের বাড়ি, হচ্ছে বহুতল অট্টালিকা!

প্রকাশিত: ১০ নভেম্বর ২০২২, ১১:০৪ এএম

নির্বাসিত লেখিকা তসলিমা নাসরিনের জন্মস্থান ময়মনসিংহের বাড়িটি এবার ভেঙে ফেলা হচ্ছে। সেখানে নির্মাণ করা হবে বহুতল ভবন। ‘অবকাশ’ নামের নান্দনিক ওই বাড়িটি শহরের টিএন রায় রোডে অবস্থিত ছিল। যেখানে কেটেছে তসলিমার শৈশব-কৈশোর আর যৌবন।

বুধবার (৯ নভেম্বর) বিকেলে দেখা যায়, সেই বাড়ির দেয়াল থেকে ইট খুলে নিচ্ছেন শ্রমিকরা। জানতে চাইলে শ্রমিকরা বলেন, স্থানীয় নয়ন নামে এক ব্যক্তি লিখিত ডকুমেন্ট করে তিন লাখ টাকায় পুরোনো বাড়িটির ইট-কাঠ ও রড কিনে নিয়েছেন। আমরা তার অধীনে শ্রমিক হিসেবে বাড়ি ভাঙছি। এর বাইরে আমাদের কিছু জানা নেই।

তসলিমা নাসরিনের ভাতিজা সাফায়েত কবীর বলেন, বাড়িটি ছিল আমার দাদা প্রয়াত ডা. রজব আলী সাহেবের। তার মৃত্যুর পর সম্প্রতি এ বাড়ির জমিটি তার উত্তরাধিকারদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা হয়েছে। এর মধ্যে সামনের অংশে আমার বাবা ও চাচার জায়গা। আর পেছনে রয়েছে ফুফুদের জায়গা। সাফায়েত আরও বলেন, ভূমি বণ্টনামার নিয়ম মেনেই অংশ ভাগ করে পুরোনো বাড়ি ভেঙে নতুন ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। এটি আমাদের পারিবারিক বিষয় এবং এতে আইনগত কোনো সমস্যা নেই।

এদিকে ‘অবকাশ’ নিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন তসলিমা। তার লেখায় ফুটে উঠেছে এই বাড়িটি নিয়ে স্মৃতি, হাহাকার, আবেগ, ভালোবাসা ও ক্ষোভ। আরটিভি নিউজের পাঠকদের জন্য তসলিমার স্ট্যাটাসটি হবহু তুলে ধরা হলো-

‘কেউ কেউ ফেসবুকে ‘অবকাশ’ ভাঙার ছবি পোস্ট করছে, দুঃখ করছে, স্মৃতিচারণ করছে। আমার শৈশব, কৈশোর, যৌবনের সেই ‘অবকাশ’। ময়মনসিংহ শহরের টি এন রায় রোডে আমার বাবার কেনা সুন্দর বাড়িটি অবকাশ। এই অবকাশ ভেঙে গুঁড়ো করার সিদ্ধান্ত যারা নিয়েছে, তাদের সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ নেই, আমার কোনো সম্পর্ক নেই। শুধু এইটুকু জানি, তাদের মধ্যে কেউ কেউ খুব লোভী, স্বার্থপর, ধুরন্ধর, কেউ কেউ কট্টর মৌলবাদি। সকলেরই আমি চক্ষুশূল। এককালে শহরের সাহিত্য সংস্কৃতি, জ্ঞান বিজ্ঞান আর প্রগতিশীলতার একটি কেন্দ্র ছিল যে বাড়িটি, আজ সেটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত।

ধন দৌলতের কাঙালদের কাছে প্রগতিশীলতা, উদারতা, সহমর্মিতা, স্মৃতি ও সৌন্দর্যের কোনও মূল্য নেই। শুনেছি বাড়িটিতে আমার মায়ের হাতের লাগানো সব ফুল ফুল গাছ শেকড়সুদ্ধ উপড়ে ফেলে একটি আধুনিক বহুতল বিল্ডিং বানানো হচ্ছে। আমার কর্মঠ বাবার অকর্মণ্য উত্তরসুরিরা সেই বিল্ডিং-এ পায়ের ওপর পা তুলে বংশ পরম্পরায় খাবে।

ও বাড়ির এখন আমি কেউ নই। আমি তো তিরিশ বছর ব্রাত্যই। ইট পাথরে, চুন সুরকিতে, কাঠে কংক্রিটে স্মৃতি থাকে না, স্মৃতি থাকে মনে। অবকাশ রইল আমার মনে। যে বাড়িটিতে বসে আমি প্রথম কবিতা লিখেছি, প্রথম কবিতা-পত্রিকা ছাপিয়েছি, প্রথম কবিতার বই লিখেছি, নির্বাচিত কলাম লিখেছি, যে বাড়িটির মাঠে প্রথম গোল্লাছুট খেলেছি, যে বাড়িটির ছাদে প্রথম পুতুল খেলেছি, যে বাড়িটির ভেতর প্রথম রবীন্দ্রনাথ আওড়েছি, উঠোনজুড়ে নেচে চিত্রাঙ্গদা মঞ্চস্থ করেছি, যে বাড়িটিতে দাদা বেহালা বাজাতো, ছোটদা গিটার বাজাতো, বোন গান গাইতো, মা আবৃত্তি করতো, বাবা মানুষের মতো মানুষ হওয়ার স্বপ্ন দেখাতো, যে বাড়িটিতে বসে প্রথম প্রেমের চিঠি লিখেছি, যে বাড়িটিতে আমি একই সঙ্গে সংবেদনশীল এবং সচেতন মানুষ হয়ে উঠেছি, সে বাড়িটি রইলো আমার মনে। কোনও হাতুড়ি, শাবল, কুড়ালের শক্তি নেই সে বাড়িটি ভাঙে।’

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: