সিরাজগঞ্জে মাদ্রাসা সুপারের বিরুদ্ধে নিয়োগ বাণিজ্য ও ঘুষ গ্রহনের অভিযোগ

প্রকাশিত: ২৮ নভেম্বর ২০২২, ১০:৪২ পিএম

সিরাজগঞ্জের তাড়াশের প্রত্যন্ত অঞ্চল তালম ইউনিয়নের রোকনপুর ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসার সুপারের বিরুদ্ধে নানা অনিয়মের অভিযোগ ওঠেছে। অভিযোগকারী শিক্ষক-কর্মচারী ও ম্যানেজিং কমিটির সভাপতিসহ স্থানীয়রা বলছেন, মাদ্রাসা সুপার দলিলুর রহমান মুক্তা মাদ্রাসায় নিয়মিত অনুপস্থিত থাকছেন পাশাপাশি মাদ্রাসায় তিনটি পদের বিপরীতে অগ্রিম লাখ লাখ টাকা ঘুষ গ্রহন করেছেন। শুধু তাই নয় অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের অবসার ভাতার সিটে স্বাক্ষরের জন্য শিক্ষকদের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা নেয়াসহ প্রতিষ্ঠানের গাছ কেটে লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।

মাদরাসার সাবেক সহকারী সুপার মাওলানা আবুল কাশেম জানান, ইসলাম শিক্ষা প্রসারে ১৯৭২ সালে স্থানীয় শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিরা বাশ-কাঠ টিনসহ জমি অনুদান দিয়ে সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল তালম ইউনিয়নের রোকনপুর গ্রামে রোকনপুর ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসাটি প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর প্রতিষ্ঠানটির প্রসার ঘটতে থাকে।

পড়াশোনা ভাল হওয়ায় এমপিওভুক্তি হয় এবং স্থাপনা নির্মাণ হয়। প্রায় পাঁচ বছর আগে স্কুলের সহকারী শিক্ষক দলিলুর রহমান মুক্তা প্রায় ৫ বিঘা জমি বিক্রি করে ২০ লক্ষাধিক টাকার বিনিময়ে সাবেক এমপির সুপারিশে মাদ্রাসায় সুপার পদে নিয়োগ নেন। নিয়োগ পেয়েই তিনি নানা দুর্নীতি জড়িয়ে পড়েন।

মাদ্রসার শিক্ষক মতিয়ার রহমান কান্নাজড়িত কন্ঠে জানান, দুই বছর আগে মাদ্রাসায় নিরাপত্তা কর্মী হিসেবে তার ছেলেকে নেয়ার জন্য প্রস্তাব দেয় মাদরাসা সুপার দলিলুর রহমান মুক্তা। ছেলে বেকার থাকায় তিনি রাজি হয়ে যান। এরপর সে ৮ লক্ষ টাকা দাবী করে। জমি, গাছের বাগান ও বাশ বাগান বিক্রি করে ৮লক্ষ টাকা প্রদান করেন। এরপর সুপার আরো দুই লক্ষ টাকা দাবী করেন। ব্যাংক থেকে লোন করে দুই লক্ষ টাকা প্রদান করা হয়। কিন্তু পত্রিকায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিলেও আমাকে বা আমার ছেলেকে জানানো হয়নি। আবেদনপত্র জমা দেয়ার শেষদিনে বিষয়টি জানতে পারি। পরে ছেলেকে দিয়ে আবেদন করানোর পর আরো সুপার ২০ হাজার টাকা দাবী করছে। তিনি আরো জানান, একই পদের জন্য গ্রামের আরেকজনের কাছ থেকে ৪ লক্ষ টাকা নিয়েছেন। এখন সে কাকে চাকুরী দিবে এনে দুশ্চিন্তয়া রয়েছি।

অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক আলহাজ তোজাম্মেল হোসেন জানান, ২০১৮ সালে অবসর গ্রহন করেছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত কল্যান ট্রাস্ট ভাতা সিটে স্বাক্ষর করছে না। শুধু তালবাহানা করছে। তিনি আরো জানান, আমার মতো অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মাওলানা ইব্রাহীমের কাছ থেকে ৪৩ হাজার টাকা এবং আহম্মদ আলী নামে আরো একজন শিক্ষকের কাছ থেকে ৫২ হাজার টাকা নিয়েছে। তারপরেও আরো টাকার জন্য সিটে স্বাক্ষর করছে না।

অবসরপ্রাপ্ত দপ্তরী সাহেব আলী জানান, দুই বছর আগে অবসর গ্রহন করেছি। আমাকে ৫ মাসের বেতন দেয় নাই। উৎসব ভাতা দেয় নাই। অবসরকালীন ভাতার জন্য একলক্ষ টাকা দাবী করেছে সুপার। আমি খুব কস্টে ৫০ হাজার টাকা দিয়েছি। আর ৫০ হাজার টাকা না দেয়ার কারনে স্বাক্ষর করছে না। বিষয়টি উপজেলা নির্বাহী অফিসার বরাবর জানিয়েছি।

মাদ্রসার শিক্ষক মাওলানা রইচ উদ্দিন জানান, মাদ্রাসার শিক্ষকদের পদবীর জন্য অনলাইন আবেদন করতে লাগে দেড় থেকে দুইশ টাকা আর সুপার আমাদের কাছ থেকে দুই হাজার করে টাকা নিয়েছি।

মাদ্রসার কর্মচারী ও শিক্ষার্থীরা জানান, তিনি কোনদিন সময়মত মাদ্রসায় আসেন না। যখন ইচ্ছে আসেন আবার যখন ইচ্ছে চলে যান। এ অবস্থায় শিক্ষা ব্যবস্থাও ভেঙ্গে পড়েছে।

গ্রামের প্রবীন মুরুব্বী ও মাদরাসা প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য আজহার আলী জানান, সুপার দলিলুর রহমান ১৩০টি গাছ কেটে প্রায় ২০ লক্ষাধিক টাকা আত্মসাত করেছে। বিষয়টি নিয়ে তাকে বললে সে কোন কথা বলে না। উল্টো ইউএনওর কাছে যেতে বলেন। তাই ইউএনও বরাবর লিখিত আবেদন করেছি।

মাদরাসা ছাত্র মোস্তাকিন বিল্লাহ জানান, আমার শিক্ষক হলে কি হবে তিনি একজন দুর্নীতি –মামলাবাজ ও পল্টিবাজ। নিজস্বার্থের জন্য গ্রামবাসীর মধ্যে দুটি গ্রুপে বিভক্ত করে রেখেছে। দল পাল্টানোর ওস্তাদ। তিনি থানা জামায়াতের আমীর ছিলেন। বিএনপির সময় বিএনপি করতেন। এখন আওয়ামীলীগের বড় নেতা হয়েছেন। তিনি নিরাপত্তা কর্মীর জন্য গ্রামের দুজন ছেলের কাছে ১৪ লক্ষ টাকা টাকা নিয়েছেন। আয়া পদের জন্য দুজনের ৫ লক্ষ টাকা নিয়েছেন। এখন কাকে চাকুরী দিবে, কে চাকুরী পাবে এই নিয়ে গ্রামবাসী দুটো গ্রুপে বিভক্ত হয়েছে। যে কোন সময় সংঘর্ষ হতে পারে।

ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল খালেক জানান, আমার বাবা জীবিত থাকাকালীন মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাকালীন সেক্রেটারী ছিলেন। তখন মাদ্রসাা সুন্দরভাবে পরিচালিত হয়েছে। কিন্তু বর্তমান সুপার দলিলুর রহমান অবৈধভাবে টাকার বিনিময়ে সুপার নিয়োগ হবার পর থেকেই নানা অনিয়ম-দুর্নীতি করে মাদ্রাসাটি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে। সুপার এতোটাই খারাপ যে, একজন প্যারালাইসড অসুস্থ অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকের অবসর ভাতার জন্য টাকা দাবী করছে। টাকা না দেয়ায় দীর্ঘদিন যাবত অবসর ভাতার সিটে স্বাক্ষর করছেন না। এছাড়াও নিয়োগ বাণিজ্যসহ তার দুর্নীতির শেষ নেই। বিষয়টি উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে অবহিত করা হয়েছে। আশা করছি মাদ্রাসাটি রক্ষায় তিনি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করবেন।

ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি আল-আমিন কাওসার জানান, সুপারের বিরুদ্ধে নিয়োগের নামে অগ্রিম লাখ লাখ টাকা ঘুষ গ্রহন, অবসরভাতার স্বাক্ষরের নামে হাজার টাকা হাতিয়ে নেয়াসহ শিক্ষকদের মানসিক নির্যাতন ও গাছ কেটে লক্ষ লক্ষ টাকা আত্মসাতের অনেকগুলো লিখিত অভিযোগ পেয়েছি এবং তার সত্যতাও পাওয়া গেছে। তাছাড়া ছুটির নামমাত্র আবেদন দিয়ে তিনি মাদরাসায় অনুপস্থিত থাকছেন এমনকি ফোনও বন্ধ রেখেছেন। ম্যানেজিং কমিটির বৈঠকে সুপার দলিলুর রহমানের বিরুদ্ধে রেজুলেশন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে তিনি জানিয়েছেন।

উপজেলা নির্বাহী অফিসার মেজবাউল করিম জানান, রোকনপুর ইসলামিয়া মাদ্রাসার সুপারের বিরুদ্ধে ঘুষ গ্রহন, মাদ্রসায় অনুপস্থিত ও অবসর ভাতার জন্য টাকা গ্রহনসহ অনেকগুলো লিখিত অভিযোগ পাওয়া গেছে। সবগুলো একসাথে করে তদন্ত কমিটি গঠন এবং কমিটির সুপারিশ মোতাবেক আইনগত ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।

তবে অভিযোগের বিষয়ে মাদ্রাসায় ও তার বাড়ীতে গেলে সুপার দলিলুর রহমানকে পাওয়া যায়নি এবং তার ব্যবহৃত মুঠোফোনের সবগুলো নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়।

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: