নাগেশ্বরীতে সাবরেজিস্ট্রার কর্মকর্তা ও দলিল লেখকদের দ্বন্দ: ২ মাস ধরে দলিল সম্পাদন বন্ধ

প্রকাশিত: ৩০ নভেম্বর ২০২২, ০৪:৪০ পিএম

কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী সাবরেজিস্ট্রার অফিসে সাবরেজিস্ট্রার কর্মকর্তা ও দলিল লেখক সমিতির দ্বন্দে দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে জমির দলিল সম্পাদন বন্ধ রয়েছে। ফলে চরম বিপাকে পড়েছেন জমির ক্রেতা-বিক্রেতারা। একইসাথে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন দলিল লেখক, স্ট্যাম্প বিক্রেতাসহ সংশ্লিষ্ঠ পাঁচ শতাধিক মানুষ।

সাবরেজিস্ট্রার অফিস ও দলিল লেখকদের তথ্যমতে, নাগেশ্বরী সাবরেজিস্ট্রার অফিসে সপ্তাহের মঙ্গল, বুধ ও বৃহস্পতিবার এ তিনদিন দলিল সম্পাদন করা হতো। অফিসের পূর্বের কর্মকর্তা অবসরে গেলে গত ২১ সেপ্টেম্বর অতিরিক্ত দায়িত্ব পায় উলিপুর উপজেলার সাবরেজিস্ট্রার কর্মকর্তা নাবীব আফতাব। তিনি এখানে যোগদানের পর দলিল লেখকদের কিছু শর্ত জুড়ে দেন।

কিন্তু দলিল লেখকদের সংগঠনের নেতারা সে শর্তে রাজী না হওয়ায় যোগদানের দু’দিন পর দলিল সম্পাদন বন্ধ করে দেন কর্মকর্তা। দলিল সম্পাদন না হওয়ায় বন্ধ হয়ে যায় জমির কেনাবেচা। এতে ক্রেতা-বিক্রেতারা পড়েছেন মহাবিপাকে। দূরদূরান্তের লোকজন বিষয়টি না জেনে একাধিকবার এসে ফিরে যাচ্ছেন অনেকে। এতে আর্থিক ক্ষতিতেও পড়ছেন মানুষ।

উপজেলার নেওয়াশী ইউনিয়নের হরিনাশ চন্দ্রের সাথে। তিনি চারদিন থেকে ঘুড়ছেন জমি রেজিস্ট্রি করতে। কিন্তু কর্মকর্তা না থাকায় প্রতিদিন ফিরে যাচ্ছেন তিনি। হরিনাশ চন্দ্র বলেন, আমার খুব সমস্যা। টাকার খুব দরকার। এজন্য জমি বিক্রি করতে হচ্ছে। জমি রেজিস্ট্রি না দিলে ক্রেতা টাকা দিচেছন না। একই এলাকার রবিনাশ চন্দ্র জানান, আমরা কয়েকদিন থেকে এসে এসে ঘুরে যাচ্ছি। যার জমিটা কিনবো তিনিও আসতেছেন আমার সাথে। কিন্তু জমি রেজিস্ট্রি করতে না পারায় তাকে টাকা দিতে পারছিনা।

এদিকে দলিল সম্পাদন না হওয়ায় সাধারণ দলিল লেখক, স্ট্যাম্প বিক্রেতাসহ সংশ্লিষ্টদের আয় রোজগার বন্ধ হওয়ায় অন্য কর্মে চলে গেছেন অনেকে। দলিল সম্পাদন বন্ধের বিষয়ে খোঁজ নিতে অফিসে গিয়ে পাওয়া যায়নি সাবরেজিস্ট্রার কর্মকর্তা নাবীব আফতাবকে। তবে অফিস সহকারি সুরেশ চন্দ্র সেন জানান, দলিল সম্পাদনে যে সকল সরকারি ফি রয়েছে সেসব ফি দলিল লেখকদের অফিসের বাইরে সংগ্রহ করতে বলেছেন বর্তমান স্যার। দলিল লেখকরা তাতে রাজী না হওয়ায় স্যার বন্ধ করে দিয়েছেন।

দলিল লেখক সমিতির সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম শামীম বলেন, সরকারি ফি অফিসের ভিতরে সংগ্রহ করার নিয়ম। কিন্তু কর্মকর্তা বাইরে নিতে বলছেন। এটা নিয়মের বাইরে। আমরা তা করবোনা। তিনি জানান, দলিল লেখকরা অনেক ক্ষতির মুখে পড়েছেন। এ সমস্যা সমাধান প্রয়োজন।

তবে অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রতিটি সম্পাদনকৃত দলিলের বিপরীতে সরকারি ফি ছাড়াও আদায় করা হয় বাড়তি টাকা। এই টাকার ভাগাভাগি নিয়ে দলিল লেখক ও সাব-রেজেষ্টারের মধ্যে দ্বন্দের কারণেই বন্ধ রয়েছে সম্পাদন। একাধিক দলিল লেখক বিষয়টি নিশ্চিত করলেও তারা নাম প্রকাশ করতে চাননি লাইসেন্স বাতিলের ভয়ে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক দলিল লেখক জানান, সম্পাদনকৃত প্রতিটি দলিলে নির্ধারিত সরকারি ফি ব্যাংকে জমা করা হয়। এর বাইরে প্রতি দলিলে কর্মকর্তাকে বাড়তি এক হাজার টাকা দিতে হতো। এর জন্য সাধারণ মানুষের কাছে তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকা বেশি নিতো দলিল লেখকরা। দলিল লেখক সমিতির নেতাদের মদদে এসব হতো। বিভিন্ন হিসাব দেখিয়ে ক্রেতা বিক্রেতাদের বাড়তি টাকা দিতে বাধ্য করা হতো। এ টাকা আদায় হতো দলিল লেখক ও অফিস সহকারির মাধ্যমে।

কর্মকর্তা নাবীব আফতাব যোগদানের পর বাড়তি ফি এক হাজার থেকে বাড়িয়ে তিন হাজার দাবি করেন তিনি। একই সাথে সকল ফি অফিসের বাইরে সংগ্রহ করতে বলেন দলিল লেখকদের। কাগজপাতিতেও কড়াকরি নির্দেশ দেন নাবীব আফতাব। বাড়তি টাকাতে সমিতির আপত্তি না থাকলেও অফিসের বাইরে সংগ্রহ করতে নারাজ সমিতি। অন্যদিকে বাড়তি উৎকোচ দিলে কাগজপত্র যাচাই শিথিল চান তারা। এতে রাজী ছিলেন না কর্মকর্তা নাবীব আফতাব। যদিও দলিল লেখক সমিতির সভাপতি আলী আজম প্রধান দাবী করেছেন বাড়তি টাকার বিষয় নেই এখানে। বাড়তি টাকা নেয়া হয়না। সরকারি ফি সংগ্রহ নিয়ে এ জটিলতা বলে দাবি তার।

তিনি বলেন, দুই মাসে অনেক দলিল লেখক নি:স্ব হয়েছেন। এখানে স্থায়ী কর্মকর্তা আসলে সমস্যা সমাধান হবে। সাবরেজিস্ট্রার অফিসের মোহরার আতাউর রহমান জানান, ওই অফিসে মাসে সাতশ থেকে এক হাজার দলিল সম্পাদন হতো। এ সমস্যার কারণে বিশেষভাবে কিছু দলিল সম্পাদন হচ্ছে। এরমধ্যে চলতি নভেম্বর মাসে মাত্র পাঁচটি দলিল সম্পাদন হয়েছে। অক্টোবর মাসে সম্পাদন হয়েছে মাত্র ৬৪টি দলিল। তারও দাবি, স্যার এসে কড়াকরি করেছেন। টাকা বাইরে নেয়ার কথা বলেছেন। এখানে অন্য কিছু নেই।

এ বিষয়ে মুঠোফোনে কথা বলার চেষ্টা করা হলেও সাবরেজিস্ট্রার নাবীব আফতাব কল রিসিভ করেননি। উপজেলা নিবাহী কর্মকর্তা ফারজানা জাহান বলেন, বিষয়টি তাদের অভ্যন্তরিন। যেহেতু মানুষের ভোগান্তি হচ্ছে। তাদের সাথে কথা বলে দ্রুত সমাধান করা হবে।

এ বিষয়ে কুড়িগ্রাম জেলা রেজিস্ট্রার মোস্তাফিজ আহমেদ বলেন, তাদের দুপক্ষের সাথে আমি কথা বলেছি। সমস্যা সমাধানে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আগামী সপ্তাহে নতুন কর্মকর্তা দেয়া হবে।

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: