আজ পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির ২৫ বছর

পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির আজ ২৫ বছর পূর্ণ হলো। পার্বত্য চট্টগ্রামে রক্তক্ষয়ী সংঘাত অবসানের লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদের তখনকার চিফ হুইপ আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ ও জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন। চুক্তির ফলে প্রাথমিকভাবে শান্তি বাহিনীর সদস্যরা অস্ত্র জমা দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে। সরকার তাদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন।
শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর থেকেই পাহাড়ে শান্তির সুবাতাস বইতে শুরু করে। যোগাযোগ ব্যবস্থা থেকে শুরু করে বেড়েছে মানুষের বেড়েছে আয়। স্বচ্ছলতায় ফিরেছে অর্থনৈতিক চাকা। চুক্তির ফলে গত ২৫ বছরে পাহাড়ের আনাচে-কানাচে উন্নয়নের চাকা ঘুরেছে বিরামহীন গতিতে। রাঙ্গামাটি পর্যটন শহর হিসেবে ব্যাপক সুনামে বিস্তৃতি ছড়িয়েছে সর্বত্র। পাহাড়ের বুক চিড়ে মাইলের পর মাইল চোখ ধাঁধানো আকাঁবাঁকা-উচনিচু রাস্তা তৈরি হয়েছে। পর্যটন ঝুলন্ত ব্রীজ থেকে শুরু করে মেঘের রাজ্য সাজেক পর্যটন স্পট সর্বত্র সুনাম ছড়িয়েছে। নতুন পর্যটন স্পট থেকে শুরু করে বড় বড় হোটেল-রেস্তোরাঁ গড়ে উঠেছে। প্রতিনিয়ত বাড়ছে পর্যটকের আনাগোনা। পাহাড়ের ব্যাপক উন্নয়ন হওয়ার ফলে পাহাড়ে শান্তির পাশাপাশি বসবাসকারীদের আর্থ-সামাজিক জীবনেও এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন।
তথ্যমতে, শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে বিগত ২৫ বছরে বেশ কিছু পদক্ষেপ গৃহীত হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং আঞ্চলিক পরিষদ গঠন করা হয়েছে। তিনটি পার্বত্য জেলা পরিষদ এবং নিয়ন্ত্রণাধীন ৩৩টি দফতর-সংস্থার মধ্যে রাঙ্গামাটিতে ৩০টি হস্তান্তর করা হয়েছে। ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি করতে গঠন করা হয়েছে ভূমি কমিশন। প্রত্যাগত ১২ হাজার ২২৩টি উপজাতি শরণার্থী পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। সংসদ উপনেতার নেতৃত্বে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন মনিটরিং কমিটি গঠন করা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটি গঠন করা হয়েছে। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান বিল-২০১০ জাতীয় সংসদে গৃহীত হয়েছে। তিন পার্বত্য জেলায় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। উন্নয়নের মধ্যে সীমান্তে ১ হাজার কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। রাঙ্গামাটির নানিয়ারচরে চেঙ্গি নদীর ওপর ৫০০ মিটার দীর্ঘ সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। রাজস্থলী উপজেলা থেকে দুর্গম বিলাইছড়ি উপজেলা পর্যন্ত সীমান্ত সড়ক নির্মিত হচ্ছে। যেখানে ব্রীজ এবং রাস্তা নেই, সেখানে বর্তমান সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড এবং জেলা পরিষদ ব্রীজএবং রাস্তা তৈরি করছেন। পাহাড়ের প্রত্যন্ত অঞ্চলে
বিদ্যুৎ পৌঁছে যাচ্ছে। যেখানে বিদ্যুৎ যাওয়ার সম্ভাবনা নেই, সেখানে সৌর বিদ্যুতের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। কৃষকরা ন্যায্য ও বিনামুল্যে সার বীজ পাচ্ছে। পাহাড়ে পাহাড়ে সবুজ ফসলের বিপ্লব চলছে।
জানা গেছে, বর্তমানে পাহাড়ে পাঁচটি আঞ্চলিক দল বিভিন্ন উপজেলা দখল করে তাদের সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। দলগুলো হচ্ছে, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (সন্তু গ্রুপ), ইউনাইটেড পিপলস্ ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট-ইউপিডিএফ (প্রসিত গ্রুপ), পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (লারমা সংস্কার গ্রুপ), ইউনাইটেড পিপলস্ ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট-ইউপিডিএফ (সংস্কার গ্রুপ) ও মগ লিবারেল ফ্রন্ট। তবে চুক্তির পর দুই দশকের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের সমাপ্ত হলেও সাম্প্রতিক সময়ে এই পাঁচটি দলের ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতে ফের অশান্ত হয়ে উঠেছে পাহাড়। পাঁচটি আঞ্চলিক সংগঠন নিজেদের মধ্যে হানাহানি অব্যাহত রেখেছে। তাদের মধ্যে চাঁদাবাজির ভাগাভাগি নিয়ে চলছে সংঘাত ও প্রাণহানির ঘটনা। চার সন্ত্রাসী গ্রুপের অত্যাচারে পার্বত্যাঞ্চলে অতিষ্ঠ পাহাড়ি-বাঙালি। একটি হিসাবমতে, শান্তিচুক্তি পরবর্তী ২৫ বছরের আঞ্চলিক সংগঠনের দ্বন্ধে প্রাণ হারাতে হয়েছে প্রায় ৫ হাজারের অধিক নেতাকর্মীকে। এই সংখ্যায় প্রাণ দিতে হয়েছে বহু আওয়ামী লীগ পাহাড়ী নেতাকর্মীকে। হিসাবমতে, আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর বছরে চাঁদার আদায়ের পরিমান প্রায় ৪শত কোটি টাকা। ঠিকাদারী থেকে শুরু করে চাকরীজীবি, পেশাজীবি, কৃষক, জেলে, খামারী সবার থেকে নির্দিষ্ট হারে চাঁদা দিতে হয় তাদের। চাঁদাবাজি ও স্বশস্ত্র হামলার অভিযোগে প্রায়শঃ যৌথবাহিনীর অভিযানে ব্যাপকহারে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করা হয়।
গত দুইদিন আগেও অথ্যাৎ গত ৩০ নভেম্বর বুধবার রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার দুর্গম সাজেক ইউনিয়নের নিউলংকর দাড়ি পাড়ার মিডপয়েন্ট এলাকায়
দুর্বৃত্তের গুলিতে নিহত হন সুখেন চাকমা। এছাড়াও এ ঘটনায় সজীব চাকমা নামে আরেকজন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। এতে আতঙ্কিত পাহাড়ের সাধারণ মানুষ। চুক্তির ২৫ বছর পেরিয়ে গেলেও পাহাড়ে এখনো পুরোপুরি শান্তি ফেরেনি। এখনো ঘটছে গোলাগুলি, রক্তক্ষয়ী সংঘাত, সংঘর্ষ, চাঁদাবাজি, খুন, গুম ও অপহরণসহ নানা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। পাহাড়ে বিভিন্ন দল ছেড়ে নতুন নতুন দল-উপদল তৈরির মাধ্যমে সন্ত্রাসী কার্যক্রম ও চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটানো হচ্ছে। এসব দলের মধ্যে একে অপরের সাথে চাঁদাবাজি, অস্ত্রবাজি, আধিপত্য বিস্তার ও জাতিগত ভেদাভেদ লেগেই থাকে। এ অবস্থায় পাহাড়ের অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে অভিযান চালানোর দাবি তুলেছেন সচেতন মহল।
পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদ কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান কাজী মুজিবর রহমান জানান, আমরা চুক্তি বাস্তবায়নের পক্ষে। সরকারও চুক্তি বাস্তবায়নে যথেষ্ট আন্তরিক। চুক্তি হওয়ার পর গত ২৫ বছরে একটি পক্ষ লাভবান হয়েছে বেশি এবং আরেকটি পক্ষ বঞ্চিত হয়েছে। চুক্তির লক্ষ্য ছিলো, পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত মানুষের মাঝে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু চুক্তির ২৫ বছর পেরিয়ে গেলেও পাহাড়ে চাঁদাবাজি এবং অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানি কমেনি। বরং বেড়ে চলছে চাঁদাবাজি এবং আমদানি করা হচ্ছে আরো অত্যাধুনিক অস্ত্র। তিনি আরো জানান, চুক্তির ফলে পাহাড়িরা এগিয়ে গেছে এবং বাঙালিরা পিছিয়ে রয়েছে। সুতারাং, চুক্তির সাংঘর্ষিক ধারাগুলো বাতিল করে সংশোধনের দাবি জানান তিনি।
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সহ-সভাপতি এবং সাবেক সংসদ সদস্য ঊষাতন তালুকদার জানান, অনেক আশা-ভরসা প্রত্যশা নিয়ে এই অঞ্চলের মানুষ পার্বত্য
সমস্যাকে স্থায়ীভাবে সমাধানের লক্ষ্যে ২৫ বছর আগে পার্বত্যচুক্তি সম্পাদিত হয়েছে। মানুষ আশা করেছিল এই চুক্তি যথাযথ বাস্তবায়ন হবে এবং এবারও উৎসবমূখর পরিবেশে চুক্তির বর্ষপূর্তি পালিত হবে এই আশা ছিল। কিন্তু এই চুক্তি দীর্ঘ ২৫ বছর পরেও আশাব্রত কিছু বয়ে আনতে পারেনি। তিনি আরো জানান, বর্তমান সরকারের আন্তরিকতার অভাব, রাজনৈতিক স্বদিচ্ছার অভাবের কারণে এবং সরকারী একটি অংশ চুক্তি বিরোধীতার কারণে চুক্তি ব্যাহত হচ্ছে এবং বাস্তবায়ন হচ্ছে না।
খাদ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি এবং রাঙ্গামাটি আসনের সংসদ সদস্য দীপংকর তালুকদার জানান, শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন হউক এটি আমরাও চাই,তারাও চাই। শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত আন্তরিক। এই প্রেক্ষিতে আমাদের বুঝাপড়ার মাধ্যমে এগিয়ে যেতে হবে। কিন্তু শান্তিচুক্তি একটি শক্তি নীতিবাচক প্রভাবের কারণে এগিয়ে যাওয়া হচ্ছে না। শান্তিচুক্তির বড় বাধা হলো আস্থার সংকট এবং নির্দিষ্ট একটি জায়গায় অবস্থান না করা। তিনি আরো জানান, পাহাড়ে মানুষের শান্তির জন্য চাঁদাবাজি এবং অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের দাবি জানান।
এদিকে আজ শান্তিচুক্তির ২৫ বছর উপলক্ষে গণসমাবেশ করছেন,পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি। রাঙ্গামাটি শহরের জিমনেসিয়াম প্রাঙ্গণে এ সমাবেশ চলছে। এছাড়াও সরকারীভাবেও শান্তিচুক্তির ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে রাঙ্গামাটি জেলা নানান কর্মসূচি পালিত হচ্ছে।
বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এডিটর ইন চিফ: আমিরুল ইসলাম আসাদ
বাড়ি#৩৫/১০, রোড#১১, শেখেরটেক, ঢাকা ১২০৭
ই-মেইলঃ [email protected]
ফোনঃ (০২) ৫৮১৫৭৭৪৪
নিউজ রুমঃ ০৯৬৭৮৬৭৭১৯১
মফস্বল ডেস্কঃ ০১৫৫২৫৯২৫০২
বার্তা প্রধানঃ ০৯৬৭৮৬৭৭১৯০
মার্কেটিং ও সেলসঃ ০৯৬১১১২০৬১২
ইমেইলঃ [email protected]

পাঠকের মন্তব্য: