শরীয়তপুরে কৃষি জমিতে মাছের খামার, বিপাকে চাষিরা

প্রকাশিত: ১৪ ডিসেম্বর ২০২২, ০৬:৩৮ পিএম

আসাদ গাজী, শরীয়তপুর থেকে: শরীয়তপুর জেলার বিভিন্ন উপজেলায় বিগত বছরের ন্যায় আবারো শুরু হয়েছে অপরিকল্পিত পুকুরখনন। তবে পুকুরখনন সিন্ডিকেটের সদস্যরা পরিকল্পিতভাবেই ম্যানেজের মাধ্যমে চালিয়ে যাচ্ছে এই খননযজ্ঞ।

বুধবার (১৪ ডিসেম্বর) সকালে ভেদরগঞ্জ উপজেলার সখিপুর ইউনিয়নে গিয়ে দেখা যায় তিন ফসলি জমিতে শুরু হয়েছে মাটি বিক্রির জন্য পুকুরখনন। চোর-পুলিশ খেলায় বিভিন্ন কারণে হেরে যাচ্ছে পুলিশসহ উপজেলা প্রশাসন। এতে পুকুর খনন বন্ধে উপজেলা ও জেলা প্রশাসনে আবেদন দিয়েও ফলাফল শূণ্যই থেকে যাচ্ছে। প্রেক্ষিতে একদিকে আবেদনকারিরা পড়ছে বিপাকে এবং অন্যদিকে খননকারিরা হচ্ছে উৎসাহিত। এতে জেলায় কমেছে খাদ্য উৎপাদন, হুমকিতে পড়েছে পরিবেশ। গত পাঁচ বছরে বাণিজ্যিক মাছের খামার বেড়েছে বহুগুণ। কমেছে চারণভূমি, সংকট বেড়েছে পশু খাদ্যের। মাছের খামার করার কারণে গত দুই বছরে ধানের জমি কমেছে সাড়ে তিন হাজার একরের বেশি। ধানের উৎপাদনও কমেছে।

মূলত ধানের দাম পড়ে যাওয়া এবং উপযুক্ত দাম না পাওয়ার কারণে কৃষকেরা নিজেরা মাছের খামারের দিকে যাচ্ছেন কিংবা খামারের জন্য ভাড়া দিচ্ছেন। জমির উপযুক্ত ভাড়া না পাওয়ায় কৃষকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন এবং মধ্যস্বত্বভোগীরা লাভবান হচ্ছেন। অভিযোগ রয়েছে, কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি প্রথমে কিছু জমিতে খামার করে পরে পাশের জমিও খামারের জন্য ভাড়া দিতে কৃষকদের বাধ্য করছেন।

উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে, ভেদরগঞ্জ উপজেলায় ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৪ হাজার ৩২০ একর জমিতে বোরো ধানের চাষ হয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে তা কমে ৩ হাজার ৮৪০ একরে নেমে এসেছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা আরও ক​মে দাঁড়ায় ৩ হাজার ৪৮০ একর। উৎপাদন কমেছে ৪ হাজার ৩৯১ মেট্রিক টন ধান।

কৃষকেরা জানান, ধানের দাম কম থাকায় অনেক জমির মালিক এক ফসলি জমি মৎস্য খামারিদের কাছে ভাড়া দেন। মৎস্য খামারিরা একসঙ্গে ১৫ থেকে ২০ একর জমি নিয়ে একেকটি মৎস্য খামার তৈরি করেন। সেখানে অনেক ক্ষুদ্র কৃষকের জমিও থাকে। ওই কৃষকদের তখন বাধ্য হয়ে খামারিদের কাছে ধান উৎপাদনের জমি ছেড়ে দিতে হয়। কৃষকেরা প্রতি শতাংশ জমি বছরে ভাড়া পান ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা।

উপজেলার সখিপুর ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডের তালিকা কান্দি মৌজার সাড়ে ৪ একর জমিতে স্থানীয় কৃষকেরা ফসল ফলিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন। ওই এলাকার কিছু ব্যক্তি তাঁদের ওই জমি মাছের খামার করার জন্য আবুল কালাম হাওলাদারের কাছে ভাড়া দেন। এলাকার ৪৪ জন কৃষক তাঁদের ৮০ একর জমি মৎস্য খামার করার জন্য ভাড়া দেননি। আবুল কালাম হাওলাদার ওই জমির পাশের ভাড়া না দেওয়া জমিতেও গত ৫ ডিসেম্বর থেকে পুকুর কাটার কাজ শুরু করেছেন।

তালিকা কান্দি গ্রামের বকুল বেগম বলেন, আমরা গরিব মানুষ। ওই জমিটুকুই আমার পরিবারের শেষ সম্বল। আবুল কালাম দখল করে মাছের খামার বানাচ্ছেন। কে আমার জমিটি উদ্ধার করে দেবে? এ জমিটি হাতছাড়া হয়ে গেলে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে পথে পথে ঘুরতে হবে। জমিতে ধান উৎপাদন না করতে পারলে মাছ দিয়ে কী করব? ভাত ছাড়া শুধু মাছ খেয়ে তো বাঁচতে পারব না।

অভিযোগ প্রসঙ্গে আবুল কালাম হাওলাদারের কাছে জানতে গেলে তার পক্ষে ভেকু মেশিনের মালিক রাশেদ মিয়া টাকা দিয়ে মেনেজ করার চেষ্টা করেন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শ্রেণি পরিবর্তন করে আবাদযোগ্য জমিতে পুকুর খননের সুযোগ নেই আইনে। তারপরও এক শ্রেণির অসাধু ব্যক্তি নানান কৌশলে পুকুর খনন করে যাচ্ছে। বিশেষ করে বিল ও নিচু এলাকাগুলোকে অনাবাদি কিংবা এক ফসলি দেখিয়ে পুকুর খনন করছেন তারা।

শরীয়তপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা প্রণব কুমার কর্মকার বলেন, গত কয়েক বছরে শরীয়তপুরে প্রায় দ্বিগুণ মাছ উৎপাদন বেড়েছে। গত ১০ বছরের মধ্যে পুকুরও বেড়েছে কয়েক গুণ। মাছ চাষ করে অনেক বেকার যুবক স্বাবলম্বী হচ্ছেন। মাছ চাষের জন্য চাষিদের নানাভাবে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। ফলে জেলায় মাছ এখন উদ্বৃত্ত থাকছে। যা দেশের বিভিন্ন জেলা এবং দেশের বাইরে রফতানি করে বিপুল অর্থ আয় হচ্ছে।

উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণের উপসহকারি মামুন হোসেন বলেন, সহজ-সরল কৃষকেরা অনেক সময় বাধ্য হয়ে মৎস্য খামারিদের কাছে জমি ভাড়া দিচ্ছেন। কৃষক যদি নিজে মাছের খামার করতেন, তাহলে সমস্যা হতো না। বরং লাভবানই বেশি হতেন। কিন্তু কিছু ব্যক্তি জমি ভাড়া নিয়ে মাছের খামার করছেন। ফলে তাঁরা লাভবান হচ্ছেন। বিনিময়ে জমির যে ভাড়া দেওয়া হচ্ছে তাও সামান্য।

উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ইমামুল হাফিজ নাদিম বলেন,জমির শ্রেণি পরিবর্তন করার এখতিয়ার কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠির নেই। এখানে কৃষি জমি খনন করে জমির শ্রেণি পরিবর্তন করে আইনভঙ্গ করা হচ্ছে। তদন্ত করে তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: