সন্ত্রাসীদের পদচারণায় ভারী হয়ে উঠেছে সবুজ পাহাড়

প্রকাশিত: ২৩ ডিসেম্বর ২০২২, ০৫:১৭ পিএম

কক্সবাজারের টেকনাফে পাহাড়ে সশস্ত্র গ্রুপগুলোর কাছে হালকা-ভারী সব অস্ত্রই আছে। এদের হাতে বাঙালি-রোহিঙ্গা সব সাধারণ নাগরিকই জিম্মি। গহীন জঙ্গল আর দুর্গম পাহাড়ি জনপদে সশস্ত্র গ্রুপগুলোর কাছে ‘অসহায়’ আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও। বিভিন্ন সময় পাহাড়ের সশস্ত্র গ্রুপগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে অনেক অত্যাধুনিক অস্ত্র উদ্ধার করেছে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সন্ত্রাসীদের কাছে থাকা অস্ত্রের অতি সামান্য একটি অংশ।

আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত সদস্যরাও বলছেন, সমতল ভূমির মতো যদি সব এলাকায় আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা যেতে পারতো, তাহলে পরিস্থিতি ভিন্ন হতো। জানা গেছে, বর্তমানে সন্ত্রাসীদের ভয়ে আতঙ্কে রয়েছেন উপজেলার পাহাড়ি এলাকার লোকজন। দিনমজুর থেকে শুরু করে বিভিন্ন শ্রেণির লোকজনকে পাহাড়ে ধরে নিয়ে পরবর্তীতে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে চাঁদা আদায় করছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তবে অভিযান চালিয়েও এখন পর্যন্ত কোনো সন্ত্রাসীদের আটক করতে পারেনি পুলিশ।

সূত্রে জানা গেছে, টেকনাফের বাহারছড়া এলাকার পাহাড়ে অস্ত্রধারী এসব সন্ত্রাসীরা মানুষকে ধরে নিয়ে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে মুক্তিপণ দাবি করে। কেউ টাকা দিতে না পারলে তাকে মারধর করা হয়। পাহাড়ে যারা বিভিন্ন বাগান করেছে প্রতিটি বাগানের মালিকের কাছ থেকে সন্ত্রাসীরা টাকা আদায় করে থাকে। পাহাড়ে পানের বরজ, লেবু, বিভিন্ন বাগানের মালিক ও চাষি অপহরণের শিকার হন বেশী। এরকম অন্তত ২০ জনের কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায় করা হয় বলে জানা গেছে।

স্থানীয়রা জানান, পাহাড়ে যারা গাছ বাগান, লেবু বাগানসহ দিন মজুরের কাজ করেন এমন লোকজনকে ধরে নিয়ে টাকা আদায় করা হচ্ছে। গত ১৮ ডিসেম্বর রোববার বিকালে টেকনাফ উপজেলার বাহারছড়া ইউনিয়নের জাহাজপুরা এলাকার একটি পাহাড়ের ভেতর খালে মাছ ধরতে গেলে অস্ত্রধারী কদল অপহরণকারী এক কলেজ শিক্ষার্থীসহ ৮ জনকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। এরপর অপহরণকারীরা অপহৃতদের স্বজনদের সাথে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করে মোটা অংকের টাকার মুক্তিপণ দাবী করে।

তারা হলেন, টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের বাসিন্দা রশিদ আহমদের ছেলে মোহাম্মদ উল্লাহ, ছৈয়দ আমিরের ছেলে মোস্তফা কামাল, তার ভাই করিম উল্লাহ, মমতাজ মিয়ার ছেলে মো রিদুয়ান, রুস্তম আলীর ছেলে সলিম উল্লাহ, কাদের হোসেন ছেলে নুরুল হক, রশিদ আহমদের ছেলে নুরুল আবছার ও নুরুল হকের ছেলে নুর মোহাম্মদ। প্রায় সময় বিভিন্ন পাহাড়ে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের মহড়া চলছে বলে স্থানীয় দিনমজুর ও কাঠুরিয়ারা জানিয়েছেন।

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা ঢল আসার পর থেকে টেকনাফে পাহাড়ী এলাকার গহিন অরণ্য থেকে এসব সন্ত্রাসীদের আনা গোনা বেড়েছে। পাহাড়ে আস্তানা গড়ে রাজার বেশে চলে এইসব অপরাধিররা। অপহরণে শিকার পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, গত বুধবার দিনগত রাত ২ টায় ৮ জন ঘরে ফিরেন। তবে ৬ লাখ ৪০ হাজার টাকা দেয়ার পর এদের ছেড়ে দেয়া হয়েছে বলে তারা দাবী করেছেন।

যার মধ্যে মোস্তফা ও করিমের বড় ভাই মোহাম্মদ উল্লাহ জানিয়েছেন, অল্প সময়ের মধ্যে তাদের ভাই যে তথ্য দিয়েছেন তাতে গহীন পাহাড়ে আস্তানা তৈরী করে অবস্থান নেয়া অপরাধি চক্রের হাতে রয়েছে অসংখ্য ভারী অস্ত্র। তাদের সংখ্যা ২২ থেকে ২৫ জন হলেও অস্ত্রের সংখ্যা আরও বেশি। পাহাড়ের গুহায় গুহায় রাখা হয়েছিল অপহৃতদের। যেখানে চালানো হয়েছে নির্যাতন। অপহরণকারিদের ৩ জন ছাড়া সকলেই মুখোশ পরিহিত ছিলেন। যে তিন জন মুখোশ পড়েননি তারা রোহিঙ্গা। মুখোশ পরিহিতরা শুদ্ধ বাংলায় কথা বলেছেন এবং চক্রের প্রধানকে ‘মেজর’ বলে সম্বোধন করেছেন। এরা বাংলাদেশের নাগরিক বলে দাবি করেন তিনি।

মোহাম্মদ উল্লাহ দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে জানান, গহীন পাহাড়ে অবস্থান নেয়া এ চক্রের সদস্যরা ল্যাপটপ ও আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর ডিভাইস ব্যবহার করতে দেখেছেন অপহৃতরা। যে প্রযুক্তির মাধ্যমে অপহরণের পর বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ, আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের আগাম তথ্য তারা জানতেন। মোহাম্মদ উল্লাহ জানান, অপহৃত ৮ জনের পরিবার মিলে একটা অংকের

টাকা পাঠানোর পর ৮ জনকে ছেড়ে দেয়া হয়। তবে এই টাকার অংক কত এব কিভাবে পাঠানো হয়েছে এব্যাপারে তিনি কোন তথ্য দেননি।
মোস্তফা ও করিমের অপর ভাই টেকনাফ থানায় দায়ের হওয়া অপহরণ মামলার বাদি হাবিব উল্লাহ জানান, ফেরার পর তারা যে তথ্য প্রদান করেছেন তাতে গহীন পাহাড়ে অপরাধীদের খাবার সরবরাহে একজন বয়স্ক ব্যক্তি রয়েছেন। যিনি তাদের জন্য রান্না করা খাবার নিয়ে যান এবং মাঝে-মধ্যে রান্না উপকরণ নিয়ে গিয়ে রান্না করে দেন এই বয়স্ক লোক।

যাকে সকলেই ‘বাবা’ বলে ডাকেন। ৮ জন অপহরণের পর আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা পাহাড়ে অভিযান চালানোর সময় প্রায় কাছা-কাছি স্থানে পৌঁছে ছিলেন। আরও কিছু এগিয়ে গেলে হয়তো অপহরণকারিদের পাওয়া যেত। এ ঘটনায় এলাকাবাসীর মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, টেকনাফের বাহারছড়া, শামলাপুরসহ বেশ কিছু পাহাড় নিয়ন্ত্রণ রাখতে দীর্ঘদিন কয়েকটি অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী গ্রুপ সক্রিয়। তারা প্রতিনিয়ত পাহাড়ের বাগান মালিক ও কাজে যাওয়া শ্রমিকদের জিম্মি করে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করে থাকে। এর মধ্যে রয়েছে দুটি রোহিঙ্গা গ্রুপ ও একটি বিভিন্ন সন্ত্রাসীদের সমন্বয়ে গঠিত সন্ত্রাসী গ্রুপ। তারা জলপাই কালারের পোশাক ও ওয়াকিটকি, ল্যাপটপ সহ আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর ডিভাইস ব্যবহার করে থাকে।

মুক্তিপণই ফেরত আসা নুরুল আবছার জানিয়েছেন, অপহরণকারি চক্রের সদস্যের মধ্যে রোহিঙ্গা রয়েছে। পুলিশ পাহাড়ে অভিযান চালানো শুরু করলে তাদের অন্য পাহাড়ে নিয়ে যায়। এই সময় আবছার সহ ২ জনকে আটকে রেখে ৬ জনকে টাকা আনতে ছেড়ে দেয়। ওই সময় অপহরণকারিরা জানান রাতের মধ্যে টাকা না দিয়ে ২ জনকে মেরে ফেলা হবে। যে ৬ জনকে ছেড়ে দেয়া হয় তারা ঘরে এসে সকলের পরিবার থেকে ৬ লাখ ৪০ হাজার টাকা নিয়ে আবার পাহাড়ে যায়। টাকা পাওয়ার পর এদের ছেড়ে দেয়া হয়। ফেরত আসা মোহাম্মদ উল্লাহ জানান, অপহরণকারিরা সশস্ত্র এবং বেশিভাগ মুখোশ পরিহিত। এদের মধ্যে রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশী রয়েছে।

স্থানীয় ও অপহৃত একাধিক ব্যক্তি বলেন, বিভিন্ন পাহাড় ও আশেপাশে কাজ করতে যায়। সমতল ভূমি থেকে ১০-১২ কিলোমিটার গহীনে ওৎপেতে থাকেন সন্ত্রাসীরা। পাহাড়ি ঢাল ও ছড়া ধরে গহীন পাহাড়ে যাওয়ার সময় অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে মারধর ও গাছে বেঁধে ফেলা হয়। তাদের জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায়সহ সাথে থাকা নগদ টাকা, মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নিয়ে ছেড়ে দেয় সন্ত্রাসীরা।

বাহাছড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আমজাদ হোসেন জানিয়েছেন, পাহাড় ঘীরে একটি অপরাধি চক্রের শক্ত অবস্থান রয়েছে। যারা গত ৫ মাসে বাহারছড়া ইউনিয়নের ১৫-২০ জনকে অপহরণ করেছে। এবার আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর অভিযান দেখা গেছে। এটা অব্যাহত রাখার দাবি জানান তিনি। এদিকে এ ঘটনায় বৃহস্পতিবার বিকাল ৫ টায় কক্সবাজার পুলিশ সুপার কার্যালয়ে এক প্রেসব্রিফিং করেন কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মোঃ মাহফুজুল ইসলাম। ব্রিফিং এ পুলিশ সুপার মোঃ মাহফুজুল ইসলাম জানিয়েছেন, ৩ দিন পর অপহরণকারি চক্রের কাছ থেকে ফেরা ৮ ব্যক্তির সাথে আলাপ করে পুলিশ তথ্য সংগ্রহ করেছে।

অপহরণের পর এদের পরিবার থেকে মুক্তিপণ দাবী করা হয়েছিল। ওই সব পরিবারের সাথে কথা বলে পুলিশের পাহাড়ে অভিযান শুরু করেছে। অভিযানের পুলিশ স্থানীয়দের সাথে নিয়ে পাহাড় ঘীরে রাখে। যার ভয়ে এদের ছেড়ে দেয়া হয়। এদের চিকিৎসা প্রদান করা হয়েছে। পুলিশ সুপার জানান, মুক্তিপণ দাবী করলেও অপহৃতরা কোন মুক্তিপণ দেননি বলে পুলিশকে জানিয়েছেন।

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: