বাংলাদেশের হবিগঞ্জের নাব্যতা হারানো ৪৫টি নদী খনন করা হবে

প্রকাশিত: ১৩ জানুয়ারি ২০২৩, ০৮:৫০ পিএম

হবিগঞ্জের হাওরাঞ্চলে নাব্যতা হারানো ৪৫টি নদ-নদী খননের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এর মধ্যে শাখা বরাক,বিজনা, ডেবনা, রত্না, বিবিয়ানা, খোয়াই, শাখা কুশিয়ারা, কালনী ও গোপলা নদী রয়েছে। এসব নদী খনন করা হলে কৃষি ক্ষেত্রে আমুল পরিবর্তন আসবে। নদীগুলো ফিরে পাবে তাদের নতুন যৌবন।

উল্লেখ্য যে, এক সময়ের কার্গো জাহাজ চলাচলকারী খরস্রোতা নদীগুলোর কোথাও এখন আর ঘটি ডোবে না। পাহাড়ি ছড়া দিয়ে নেমে আসা বালিমাটি ও পলি জমে নদীর উৎসমুখ ভরাট হয়ে গেছে। আর এমনি অবস্থায় চলতি পৌষ মাসের শুরুর দিকেই হবিগঞ্জের প্রবহমান বরাক, কুশিয়ারা, গোপলাবিজনা, বিবিয়ানা এ চার নদীর ২৫০ কিলোমিটার নৌপথজুড়ে দেখা দিয়েছে চরম নাব্যতা সংকট। শুষ্ক মৌসুমে পানি না থাকলে ঠিক বৈশাখ মাসে নদীগুলো আকস্মিক পাহাড়ি ঢল ও অকাল বন্যায় পানিতে ফুলে ওঠে বোরো ফসল তলিয়ে দেয়।

বিশেষজ্ঞদের ধারণা নদীগুলো খনন ও ড্রেজিং করলে নৌপথে পরিবহন বিড়ম্বনা দূর হবে পাশাপাশি নবীগঞ্জ, বাহুবল,বানিয়াচং, আজমিরীগঞ্জ, সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরের কয়েক লাখ কৃষক নিরাপদে তাদের বোরো ফসল ঘরে তুলতে পারবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্থানীয় সমস্যা সম্পর্কে নদীগুলো ড্রেজিংয়ের আশ্বাস দিলেও এখন পর্যন্ত তা বাস্তবায়নের কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। ৫০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের কুশিয়ারা নদীর বুকে এখন অসংখ্য চর জেগে উঠেছে। খরস্রোতা এ নদীতে কয়েক হাজার বারকি শ্রমিক বালিপাথর উত্তোলন করে জীবিকা নির্বাহ করে আসলেও এখন নাব্যতা সংকটের কারণে বালিপাথর উত্তোলন করতে পারছে না। ২৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের বরাক নদী ভরাট হয়ে যাওয়ায় কুশিয়ারা ও সুরমার সঙ্গে নৌপথের যোগাযোগ প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে।

এতে বালিপাথর ব্যবসার সঙ্গে জড়িত হাজারও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান বন্ধের উপক্রম হয়েছে। মৌলভীবাজার উপজেলাকে সংযোগকারী ২০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে বিবিয়ানা নদীর বুক পানি শূন্য হয়ে পড়ায় পলি পড়ে রীতিমত ফুটবল খেলার মাঠের উপযোগী হয়ে উঠেছে। ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে গোপলাবিজনা নদীর উৎসমুখে পানি নেই। এ অবস্থায় নদী খনন না করলে ব্যবসায়ীদের বিড়ম্বনা আরও বাড়বে। একাধিক নৌশ্রমিক জানান, প্রবহমান বরাক, কুশিয়ারা, গোপলাবিজনা, বিবিয়ানা নদীতে প্রায় ছোট বড় ইঞ্জিনচালিত ট্রলারের ওপর ২০ হাজার নৌশ্রমিকের জীবন-জীবিকা চলে। এখন নদীর উৎসমুখে পানি না থাকায় গত এক মাস ধরে তারা বেকার হয়ে বসে আছে।

গত ৪০ বছরেও নদীগুলো খনন ও সংস্কারের উদ্যোগ না থাকায় একদিকে যেমন নদীগুলো নাব্যতা হারিয়েছে, তেমনি নদী তীরবর্তী মানুষের কৃষি মৎস্য আহরণ ও নৌপরিবহনের ওপর জীবিকা নির্ভরশীল পরিবারগুলোতেও বিরূপ প্রভাব পড়েছে। দেশব্যাপী বর্তমান সরকার নদী-খালখনন সংস্কার ও দখলকৃত নৌপথ পুনরুদ্ধারে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও ভাটি অঞ্চলের নদীগুলো খনন ও নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে সরকারি তরফ থেকে কোন রকম ভূমিকা নেয়া হয়নি।

সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, নবীগঞ্জ, বাহুবল, বানিয়াচং, আজমিরীগঞ্জ, সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরের এখনও নৌপথই কয়েক লাখ মানুষের যোগাযোগের একমাত্র ভরসা। নবীগঞ্জ উপজেলার প্রবহমান বরাক, কুশিয়ারা, গোপলাবিজনা, বিবিয়ানা এখনকার বড় নদী। পাহাড় থেকে নেমে আসা বালি ও পলি জমে এ নদীগুলো ক্রমেই ভরাট হয়ে নাব্যতা হারিয়ে ফেলেছে। হাওরগুলোতে দেখা দিয়েছে জলাবদ্ধতা। উপজেলার ছোট বড় ৪০টির অধিক হাটবাজারের ব্যবসা-বাণিজ্য পড়েছে হুমকির মুখে। উপজেলার বিবিয়ানা নদী কসবা থেকে আজমিরীগঞ্জ পর্যন্ত শুকিয়ে নভেম্বর থেকে নৌচলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। উপজেলা সদরের পাশ দিয়ে প্রবাহিত বরাক নদী শুটকি নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে।

এ নদী দিয়েই পুর্বদিকে কিশোরগঞ্জের কমিরগঞ্জ, ভৈরবসহ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে নবীগঞ্জের নৌ যোগাযোগ ব্যবস্থা। কিন্তু নদীর নাব্যতা সংকটে হেমন্তকালে উপজেলা সদরের সঙ্গে অভ্যন্তরীণ ও বাহিরের নৌযোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। হেমন্তে প্রবহমান বরাক, গোপলাবিজনা, বিবিয়ানা নদী শুকিয়ে যাওয়ায় ছোট ছোট ডিঙিতে করে মালামাল আনা যায় না।

এতে করে ৫০০ কিলোমিটার নৌপথে মালামাল আনতে যে খরচ ও ভোগান্তি পোহাতে হয়, সে কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দামও কিছুটা বেড়ে যায়। ভারতের ত্রিপুরা মেঘালয় পাহাড় থেকে নেমে আসা কুশিয়ারা নদী মেঘনা নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে। এর একটি শাখা মিলিত হয়েছে সুরমার নদীর সঙ্গেও। এ নদী থেকেই বালি সংগ্রহ করে সারাদেশে সরবরাহ করা হয়ে থাকে। মেঘালয় পাহাড় থেকে নেমে আসা বালি ও পাথরের কারণে নদীটি সম্পদশালী ও গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এ বালিপাথরই নদীটির কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। হেমন্তকালে কয়েক মাস তো এ নদী দিয়ে একবারেই নৌকা চলাচল করতে পারে না। নদী পাড়ের বাসিন্দারা জানান, শীতের শুরু থেকে বড় নৌকার পরিবর্তে ছোট ছোট নৌকা দিয়ে বালি লোড করতে হয়। এরপরও নদীর একাধিক স্থানে জেগে ওঠে চর। এ নদীর ওপর প্রায় ২০ হাজার ব্যবসায়ী পরিবারের জীবনজীবিকা নির্ভর করে।

নবীগঞ্জ জে কে সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের ৮ম শ্রেণির শিক্ষার্থী শাকির আহমেদ জানান- ‘বই পুস্তকে শাখা বরাক নদী সম্পর্কে পড়েছি। কিন্তু নিজের বাড়ির পাশে নদীটি থাকলেও এর স্বাভাবিক রূপ দেখতে পারিনি।’

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) হবিগঞ্জ জেলা শাখা সহ সভাপতি তাহমিনা বেগম গিনি বলেন- ‘বার বার বাপাসহ বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে নদীটি রক্ষায় আন্দোলন করে আসছি। কিন্তু প্রশাসন কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করছে না। যার ফলে দিন দিন শাখা বরাকসহ দেশের সবগুলো নদ-নদী হারিয়ে যাচ্ছে।’
তিনি বলেন- ‘দ্রুত নদীগুলো রক্ষায় কার্যকরি পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হলে এক সময় বাংলাদেশে নদীর কোন অস্থিতত্ব থাকবে না।

এ ব্যাপারে হবিগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড নির্বাহী প্রকৌশলী শামীম হাসনাইন মাহমুদ জানান- ‘ শাখা বরাক নদীকে দখলমুক্ত করে খননের জন্য কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে। হবিগঞ্জে ৯টি উপজেলায় পাঁচটি করে ছোট বড় নব্যতা হারানো নদী খননের জন্য প্রস্তাব পানি সম্পদ মন্ত্রনালয়ে পাঠানো হয়েছে। অচিরেই সেই প্রস্তাব একনেকে পাস হলে নব্যতা হারানো নদীগুলো দখল মুক্ত করে খননের কাজ শুরু হবে।

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: