হালদার উজানে তামাকের ব্যাপাক চাষাবাদ: কমছে জমির উর্বরতা, বাড়ছে স্বাস্থ্য ঝুঁকি!

প্রকাশিত: ১৪ জানুয়ারি ২০২৩, ০২:৩৭ পিএম

মো. ইসমাইল হোসেন, মানিকছড়ি (খাগড়াছড়ি) থেকে: তামাক চাষ শুধুমাত্র খাদ্য নিরাপত্তার জন্য হুমকি নয়, এটি বিষবৃক্ষ চাষ! কেননা এটি উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং বিপনন সকল ক্ষেত্রেই ক্ষতিগ্রস্ত করছে জনসাধারণকে। তামাক চাষের ফলে মাটির উর্বরতা যেমন হ্রা পাচ্ছে তেমনি, পানির ধারণ ক্ষমতা নষ্ট হচ্ছে। সেই সাথে মাটির ক্ষয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়া রাসায়নিকের প্রভাবে জনস্বাস্থ্য, ভূমি, পানি, জলজ প্রাণী ও পরিবেশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

এতো ক্ষতিকর জানা স্বত্বেও প্রতি বছর মানিকছড়ি উপজেলাধীন বাটনাতলী ও যোগ্যাছোলা ইউনিয়নের বেশ কিছু এলাকায় তামাক কোম্পানির নানা প্রলবণে সাড়া দিয়ে তামাক চাষ করছেন স্থানীয় কৃষকরা। ২০১৬ সাল থেকে দেশের একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র ‘হালদা নদীর উৎপাদনশীতা বৃদ্ধি ও হালদা উৎসের পোনার বাজার সম্প্রসারণ’ শীর্ষক ভ্যালু চেইন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে কাজ করছে পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন। যার ফলে উপজেলা প্রশাসনের যৌথ সহযোগিতায় ২০২০ সালের দিকে হালদার উজান মানিকছড়ি অংশে তামাকের চাষাবাদ শূণ্যেও কোটায় নেমে আসলেও বর্তমানে পুনরায় বৃহৎ আকারে চাষাবাদের জন্য আগ্রহী করে তুলেছেন আমেরিকান ব্রিটিশ টোবাকো কোম্পানী। যার ফলে এ বছর প্রায় ৩৭ হেক্টর কৃষি জমিতে তামাকের চাষাবাদ হয়েছে। ২৬জন মূল্য চাষির পাশাপাশি রয়েছেন আরো ৮জন সাইড চাষী।

সরেজমিনে দেখা যায়, উপজেলার গোরখানা, আসাততলী, ছুদুরখীল, কালাপানি এলাকার কৃষি জমিতে তামাকের ক্ষেতে কাজ করছে চাষীরা। নতুন করে লাগানো চারাও বেশ বড় হয়েছে। চলছে পানি দেয়াসহ পরিচর্চার কাজ। তামাকের ক্ষেতে কাজ করছেন নারী-পুরুষ ও শিশু-কিশোর উভয়ে। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নানা সুযোগ-সুবিধা ভোগ করার পরও কিছুতেই তামাক চাষে নিরুৎসাহিত করা যাচ্ছে না কৃষকদের! এবারও হয়েছে ব্যাপক চাষাবাদ। উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তারা চাষীদের তামাক চাষের ক্ষতিকর দিক তুলে ধরে বিকল্প ফসল আবাদ করার পরামর্শ দিলেও চাষীরা তা মানতে নারাজ। জানা গেছে, প্রতি কারি জন্য পর্যাপ্ত বীজ, সার দেয়ার পাশাপাশি অন্যান্য পরিচর্যার কাজের জন্য দেয়া হচ্ছে ১০ হাজার টাকা করে। যা পাতা সংগ্রহকালীন সময়ে কেটে নিবেন টোবাকো কোম্পানী।

আইডিএফ’র উপসহকরি কৃষি উন্নয়ন কর্মকর্তা মো. রুবেল হোসেন বলেন, অর্থ ও দারিদ্রতাকে পুঁজি করে কোম্পানির কিছু শর্ত সাপেক্ষে সার ও কীটনাশক প্রদানসহ অন্যান্য সুবিধা দিয়ে থাকেন বিধায় চাষীরা তামাক চাষে ঝুঁকে পড়ছেন। এ বছরও ৩৪জন জন চাষী প্রায় ৩৭ হেক্টের কৃষি জামিতে তামাকের চাষাবাদ করেছেন। পূর্বে কানি প্রতি ৪ হাজার টাকাসহ প্রয়োজনীয় বীজ, সার দিলেও এ বছর কানি প্রতি ১০ হাজার টাকা দিয়েছে। তামাক কোম্পানির এমন প্রলবনের ফলে হারিয়ে যায় তামাক চাষের নানা সমস্যার দিকগুলো। ফলে প্রত্যেক চাষীই তামাক কোম্পানি হতে ঋণ নিয়ে তামাক চাষ করেছে। তবে এ ব্যাপারে কোনো কথা বলতে রাজি স্থানীয় তামাক চাষীরা।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. হাসিবুর রহমান জানান, তামাক চাষের ফলে জমির উর্বরতা নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি পরিবেশেও নষ্ট হচ্ছে। তাছাড়া চুল্লিতে ব্যবহার করা হচ্ছে বনের কাঠ ও ধানের বিচালী। ফলে গবাদীপশুর খাদ্য ঘাটতি দেখা দিচ্ছে এবং পরিবেশ হারাচ্ছে তার আপন সুন্দর্য্য। এ কাজে কর্মরত কৃষক ও দিনমজুররা তামার পাতা নাড়াচাড়া করার কারণে স্বাস্থ্যগতভাবে ক্ষতির শিকার হচ্ছেন। তিনি আরও বলেন, তামাক চাষ কমাতে আমরা অর্থকরী ফসল হিসেবে ধান, গম, ভূট্টা ও নানা ধরণের সবজি চাষের জন্য উৎসাহ দিচ্ছি। ফসল উৎপাদনের জন্য দেয়া হচ্ছে সরকারি-বেসরকারি ভাবে নানা প্রণোদনা। সরকারি প্রণোদনা অব্যাহত থাকলে এক সময় তামাক চাষ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যাবে বলে মনে করছেন এ কর্মকর্তা।

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা আইডিএফ’র হালদা প্রকল্প ব্যবস্থাপক মো. মাহমুদুল হাসান জানান, প্রচুর রাসায়নিক ও কীটনাশক ব্যবহার তামাক চাষের একটি বড় ক্ষতিকর দিক। যার ফলে মাটির উর্বরতা হ্রাস, পানি ধারণ ক্ষমতা নষ্ট এবং ক্ষয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়া রাসায়নিকের প্রভাবে জনস্বাস্থ্য, ভূমি, পানি, জলজ প্রাণী ও পরিবেশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এসব এলাকার বেশিরভার মানুষ প্রাকৃতিক পানির উপর নির্ভরশীল। অথচ খাল ও জলাশয়ের পার্শবর্তি উর্বর জমিতে ক্ষতিকর তামাক চাষ করে এবং এর ফলে জমিতে ব্যবহৃত কীটনাশক ও তামাকের রাসায়নিক গিয়ে নদী-জলাশয়ের পানিতে মেশায় সে পানি দূষিত হয়ে পড়ছে।

তাছাড়া হালদা একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র। যেখানে প্রতিবছর প্রচুর পরিমানে মাছ বংশ বিস্তার করে। বিশেষ করে মাছে ডিম পাড়ার সময়ে তামাকের কীটনাশক পানির সঙ্গে মেশার ফলে মাছের বংশ বিস্তার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে এবং ক্রমশ মাছের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। হালদার উজান মানিকছড়ি অংশে যেভাবে তামাক চাষ হচ্ছে এভাবে চলতে থাকলে এক সময়ে মাছের বংশ বিস্তার আরো কমে আসবে। এছাড়াও তামাকের পাতা শুকানোর কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে বনাঞ্চলের কাটা, ধ্বংস হচ্ছে বনভূমি। প্রতি একর তামাক পাতা শুকাতে প্রায় ৫ টন জ্বালানি কাঠের প্রয়োজন হয়। যা আমাদের জীববৈচিত্রের জন্য হুমকি স্বরূপ।

মানিকছড়ি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনাক কর্মকর্তা ডা. রতন খীসা বলছেন, তামাক পাতা শুকানোর সময় উক্ত এলাকা ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। ধোঁয়ায় শ্বাসকষ্টসহ নানা সমস্যার সৃষ্টি হয়। তামাক চাষ করার ফলে কৃষক এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত হবার আশংকা থাকে।

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: