কক্সবাজারে মাদককারবারীদের একটি উড়ো তালিকা ঘিরে ধুম্রজাল

প্রকাশিত: ১৬ জানুয়ারি ২০২৩, ০৮:১৪ পিএম

সম্প্রতি কক্সবাজারে কর্মরত সাংবাদিকদের মুঠোফোনে মাদককারবারীদের একটি তালিকা ঘিরে সৃষ্টি হয়েছে ধুম্রজাল ও রহস্য। লেটার হেড কিংবা স্মারক নাম্বার ছাড়াই প্রণীত এই তালিকা এখন সাংবাদিকদের হাতে হাতে ঘুরছে। এই তালিকায় রয়েছে মূলধারার গণমাধ্যমে কর্মরত ও সাবেক সাংবাদিকদের নামও। নানা ভাবে প্রশ্নবিদ্ধ এই তালিকার সূত্র ধরে এখন পর্যন্ত দুটি জাতীয় পত্রিকা দুটি প্রতিবেদন ছাপিয়েছে। এরপর থেকে উত্তপ্ত হয়েছে উঠেছে পরিস্থিতি। পরস্পরের প্রতি সন্দেহ, উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়, সাংগঠনিক বিবৃতি নিন্দা ও মামলায় বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলেছে সাংবাদিক সমাজ সহ জেলার সচেতন মহলকে।

জানা গেছে, মাদকের অভিশাপ পিছু ছাড়ছেনা সীমান্ত জেলা কক্সবাজারবাসীর। প্রশাসন সর্বশক্তি প্রয়োগ করে মাদকের লাগাম টানার চেষ্টা করে গেলেও ব্যস্তানুপাতিক হারে বাড়ছে মাদক কারবারীদের সংখ্যা। সেই সাথে বাড়ছে স্বার্থান্বেষী মহলের অপতৎপরতাও। ছিনতাই, অপহরণ, খুন, চাঁদাবাজি সহ এধরণের আরও অন্যান্য অপরাধ বৃদ্ধির পেছনে প্রধানতম কারণ হচ্ছে ইয়াবা কারবার। ইতিমধ্যে প্রশাসন একাধিকবার তালিকা তৈরি করে মাদককারবারীদের নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। কিন্তু তালিকাভুক্ত এসব মাদককারবারীদের ঐতিহাসিক আত্মসমর্পন এবং তৎপরবর্তী জামিন লাভের ঘটনাকে প্রশাসনের নমনীয় উদ্যোগ বলে মনে করে জেলার সচেতন মহল। গণমাধ্যমে প্রকাশিত একাধিক প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে জানা যায়- উক্ত আত্মসমর্পন ও জামিনের ঘটনায় বিশাল অংকের টাকার লেনদেন হয়েছে।

অপরদিকে এই তালিকা ঘিরে ব্যাপক চাঁদাবাজি ও হয়রাণি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠে এসেছে নানা মহল থেকে। কেউ কেউ বলছেন, ভুয়া তালিকা তৈরি করে নাগরিকদের হয়রাণি করা হচ্ছে। অতীতেও এরকম তালিকায় নাম আসার কথা বলে একটি দুস্কৃতিকারী চক্র নিরপরাধ মানুষের কাছ থেকে বিপুল অংকের টাকা চাঁদাবাজি করে হাতিয়ে নিয়েছে। আবার কেউ বলছেন, এই উদ্ভট তালিকা প্রণয়ন পরবর্তী মাঠে ছেড়ে দেওয়ার পেছনে রাজনৈতিক কোনো দুরভিসন্ধি রয়েছে। কারণ, তালিকায় বেশিরভাগই নাম এসেছে রাজনৈতিক ব্যাক্তিবর্গের। আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘনিয়ে আসায় একটি মহল জেলায় অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করে রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে চায় বলে মনে করছেন অনেকেই।

জেলায় কর্মরত একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তা ও মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তার সাথে কথা বলে জানা যায়, এই তালিকা ঠিক কিভাবে কারা প্রণয়ন করেছে তা নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। তালিকাটিতে উল্লেখিত লেখার ভাষা ও গঠন দেখে মনে হয়নি এটি প্রশাসন কর্তৃক প্রণীত। ধারণা করা হচ্ছে, কোনো একটি স্বার্থান্বেষী মহল ফায়দা লুটতে দীর্ঘ সময় ব্যায় করে এই তালিকা মাঠে ছেড়ে দিয়েছে। প্রাথমিক ভাবে এই তালিকার প্রাশাসনিক কোনো ভিত্তি আছে বলে মনে করেন না তারা।

যে কারণে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে তালিকাটি:

তালিকায় লেটার হেড, স্মারক নাম্বার কোনো কিছুই উল্লেখ করা হয়নি। তালিকাটি সর্বপ্রথম একটি জাতীয় দৈনিকের করা প্রতিবেদনের মাধ্যমে সবার সামনে এলেও এর আগে এই তালিকা সংক্রান্ত বিষয়ে প্রশাসনের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমকে কিছুই বলা হয়নি। এমনকি উক্ত প্রতিবেদনে উলে¬খিত মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহা পরিচালক মো. আজিজুল ইসলাম তার দেওয়া বক্তব্যে জানিয়েছেন- ২৫৫ জনের যে তালিকার কথা বলছেন সেটি আমার জানা নেই।

তালিকায় তিন নাম্বারে উল্লেখিত ব্যাক্তির ব্যাপারে লেখা হয়েছে, ‘পুলিশের ধৃত ইয়াবার একটি অংশ পুলিশ তার মাধ্যমে বিক্রি করে সোর্সদের টাকা প্রেরণ করে থাকে।’ এক্ষেত্রে উক্ত তালিকায় কোথাও ওইসব ইয়াবা ব্যবসায়ী পুলিশদের নাম তুলে ধরা হয়নি। ফলে এধরণের তালিকা নিয়ে বিব্রত প্রশাসনও। একই ভাবে তালিকায় ৭ নাম্বারে উল্লেখিত ব্যাক্তির ব্যাপারে মন্তব্যের ঘরে লেখা হয়েছে, ‘১০ বছর পূর্বেও ভিখারীর মতো বসবাস করলেও বর্তমানে ইয়াবা ব্যবসার মাধ্যমে বাড়ী, গাড়ী ও কয়েকটি ট্রলারের মালিক হয়েছেন। সমস্ত পরিবারের ছেলে, মেয়ের জামাই সবাই সন্ত্রাসী এবং চিহ্নিত ইয়াবা ব্যবসায়ী।’

এই ব্যাক্তির ব্যাপারে অনুসন্ধানে জানা যায়, তিনি দীর্ঘদিনের পুরোনো ইয়াবা ব্যবসায়ী। কখনোই তিনি হতদরিদ্র বা ভিখারীর মতো ছিলেন না। তিনি মাদক সহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটকও হয়েছিলেন। অথচ উক্ত তালিকায় কোথাও তার ব্যপারে এসব তথ্য উল্লেখ করা হয়নি। উল্লেখ করা হয়নি মাদকের মামলা থাকার বিষয়টিও। এছাড়াও তালিকায় উল্লেখিত বেশিরভাগ নামের বিপরীতে মন্তব্যের ঘরে কিছুই লেখা হয়নি।

এ ব্যাপারে মাঠ পর্যায়ের গোয়েন্দারা বলছেন, যদি এটি সত্যিকারের প্রশাসন কর্তৃক প্রণীত কোনো তালিকা হতো তাহলে মন্তব্যের ঘর কখনোই খালি থাকতো না। এছাড়াও তালিকায় এমন সব সামাজিক ব্যাক্তিবর্গের নাম আনা হয়েছে যাদের ব্যাপারে কখনওই মাদক সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ পাওয়া যায়নি।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত উক্ত তালিকার কথা উল্লেখ করে একজন গণমাধ্যমকর্মী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি পাল্টা প্রশ্ন করে জানতে চান কীসের তালিকা। পরে উপস্থিত সাংবাদিকরা ইয়াবার তালিকা বলে উল্লেখ করলে তিনি বলেন, তালিকা হলেই যে কেউ মাদক ব্যবসায়ী হয়ে যাবে এমন কোনো কথা নেই। আমরা আগে দেখবো এটি কেমন তালিকা। এগুলো যাচাই বাছাই করার দরকার আছে। কেউ জড়িত থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

উল্লেখ্য, গত ১৫ জানুয়ারী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির বৈঠকে যোগ দিতে কক্সবাজার সফর করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। এই সফরের ঠিক সপ্তাহ খানেক আগে গত ৬ জানুয়ারী (শুক্রবার) নতুন প্রকাশিত জাতীয় পত্রিকা দৈনিক বাংলায় ২৫৫ জনের উক্ত তালিকা প্রকাশিত হয়। এরপর গত তিন দিন আগে ১৩ জানুয়ারী প্রাচীনতম জাতীয় দৈনিক ইত্তেফাকেও প্রতিবেদন আকারে উক্ত তালিকার কথা জানানো হয়। এই তালিকায় ইত্তেফাক ৯৩ জনের কথা উল্লেখ করে।

উভয় প্রতিবেদনে কোথাও এই তালিকার সত্যতা নিশ্চিত করা হয়নি। উল্লেখ করা হয়নি কোনো সূত্রও। যদিও ছড়িয়ে পড়া এই তালিকায় মোট ৩৭৬ জনের নাম উল্লেখ রয়েছে। তালিকাটিকে তিন ভাগ করে নাম প্রকাশ করা হয়েছে। শিরোনামে লেখা রয়েছে, মাদকের পাইকারী (বড়) বিক্রেতাদের তালিকা (৯৮ জন), মাদকের খুচরা বিক্রেতাদের তালিকা (১২১ জন) এবং মাদকের বহনকারী/সরবরাহকারীদের তালিকা (১৫৭ জন)।

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: