জুড়ীতে প্রকাশ্যে চলছে টিলা কাটার মহোৎসব!

প্রকাশিত: ২০ জানুয়ারি ২০২৩, ০৪:১১ পিএম

টিলা ও পাহাড় প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। তবে এক শ্রেণির অসাধু ভূমিদস্যুরা নিজেদের ব্যক্তি স্বার্থে পাহাড়কেটে সাবাড় করছে। কোন কিছুতেই যেন পাহাড় কাটা থামানো যাচ্ছে না। পাহাড় কাটা বন্ধ তো দূরের কথা দিন দিন পাহাড় কেটে সাভাড় করায় প্রাকৃতিক ভারসাম্য পড়েছে হুমকির মুখে।

সীমান্তবর্তী মৌলভীবাজার জেলার জুড়ী পাহাড় ও টিলা বেষ্টিত একটি উপজেলা। এসব টিলা ও পাহাড় গুলোর প্রতি রয়েছে ভূমি খোকোদের কু-নজর। দিন ও রাতের বেলায় প্রকাশ্যে টিলা কাটলেও সংবাদপত্র সংবাদ প্রকাশের পর দায়সারা শাস্তির কারণে টিলা খোকোরা আরো উৎসাহ পাচ্ছে। দিনের পর দিন পাহাড় কেটে প্রকৃতিকে ধ্বংস করলেও পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা রয়েছেন অন্ধকারে। মাঝে মাঝে উপজেলা প্রশাসনের অভিযানে বন্ধ থাকলেও কয়েকদিন পর আবারো চলে টিলাকাটার মহোৎসব। নিজস্ব ফায়দা লুটতে পাহাড়ের মাটি কেটে বিক্রি, আবাস্থল গড়ে তোলাসহ নানা স্বার্থে এসব পাহাড়গুলোকে নির্বিচারে বিলীন করে দিচ্ছে। অথচ ১৯৯৫ সালের বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের এর ৬ (খ) ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান সরকারি বা আধা সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন বা দখলাধীন বা ব্যক্তিমালিকানাধীন পাহাড় ও টিলা কর্তন বা মোচন করতে পারবে না। তবে অপরিহার্য জাতীয় স্বার্থের প্রয়োজনে অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নিয়ে পাহাড় বা টিলা কাটা যেতে পারে।

প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিতে টিলা খেকোরা এখন টিলা কাটায় তাদের কৌশল পাল্টাচ্ছে। দিনের বেলা টিলা কম কাটলেও রাতকে বেছে নিয়েছে টিলাকাটার মুখ্য সময় হিসেবে। বেশিরভাগ সময়ে নিঝুম রাতে চলে বনাঞ্চলের আবৃতে ঘেরা পাহাড় কাটার ধুম। বিগত কয়েক বছরে এ অঞ্চলের প্রায় অর্ধেকের চেয়ে বেশি পাহাড় ও টিলা কেটে সমতল করা হয়েছে। এ নিয়ে স্থানীয় লোকজনের মাঝে চাপা ক্ষোভ থাকলেও প্রভাবশালীদের ভয়ে কেউ মুখ খুলতেও পারছেন না। প্রভাবশালী মহলটি ক্ষমতার দাপট ও প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে রাতের আধাঁরে পাহাড়ের মাটি কেটে সাবাড় করে ফেলছে। ফলে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য হুমকি মুখে পড়েছে।

সরেজমিন উপজেলার পূর্বজুড়ী, সাগরনাল ও গোয়ালবাড়ী ইউনিয়নের বিভিন্ন পাহাড়ী এলাকা ঘুরে দেখা যায়, উঁচু পাহাড়ের মাঝখানে মাটি কেটে করা হয়েছে সমতল। পাশেই হারানো পাহাড়ের ক্ষত চিহ্ন। কোথাও কোথাও পাহাড়ের বুক চিরে সমতল করা জায়গায় স্থানীয় এক শ্রেণির বাসিন্দারা ঘর নির্মাণের কাজে ব্যস্ত। যেন পাহাড় কাটার উৎসবে নেমেছে তারা। সে সঙ্গে পাহাড়ের চূড়ায় থাকা বিভিন্ন প্রজাতির গাছ নিধন করে ফেলছে। প্রকৃতির বুকে মানুষের এমন আচরণের কারণে জীববৈচিত্র্য এখন হুমকির মুখে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পাহাড়ের মাটি কাটার কাজে অনেক সময় অধ্যাধুনিক ভেকু মেশিন ব্যবহার করা হচ্ছে। তবে বেশির ভাগ সময়ে শ্রমিকদের মাধ্যমে কোদাল দিয়ে টিলার মাটি কেটে সেগুলোকে টাক্টরে করে বিভিন্ন স্থানে নিয়ে বিক্রি হচ্ছে। আবার অনেকেই গর্ত বা জমি ভরাট করে ঘর বাড়ি নির্মাণ করছে। তবে টিলা কেটে প্রকাশ্যে পরিবহন দিয়ে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে গেলও কারো যেন এসব চোখে পড়ছে না।

আলাপকালে স্থানীয় সচেতন মহল জানান, যেভাবে প্রভাবশালীরা নির্বিচারে ও অপরিকল্পিতভাবে পাহাড় কাটছে তাতে করে তা জনজীবনের জন্য হুমকি স্বরূপ। পাহাড়ের তলে কিংবা পাহাড়ে যেসব বাড়িঘর রয়েছে ভারী বর্ষণে যেকোনো মুহূর্তে ধসে গিয়ে প্রাণহানি হবে এবং পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। তারা আরো বলেন, প্রশাসন টিলা কাটার বিরুদ্ধে কখনও কখনও ব্যবস্থা গ্রহণ করলেও আবার থমকে যায়। প্রভাবশালীসহ অনেক জনপ্রতিনিধি দিন দিন টিলা কেটে পাহাড়ি জনপদগুলো নষ্ট করে দিচ্ছে। পাহাড় রক্ষায় প্রশাসনকে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে।

সরেজমিনে শুক্রবার (২০ জানুয়ারি) সকালে উপজেলার সাগরনাল ইউনিয়নের বড়ডহর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, বড়ডহর গ্রামে প্রবেশের কাঁচা রাস্তার পাশঘেঁষে ২০ থেকে ২৫ ফুট উচ্চতার দুটি টিলা। একটির মালিক স্থানীয় বাসিন্দা সৈয়দ আবদুর রব। আর আরেকটির মাসুক মিয়া। আবদুর রবের টিলার এক পাশে বসতঘর। তাঁদের উঠানের সামনে টিলার বেশ কিছু অংশ কাটা। এর উল্টো দিকে চার-পাঁচ জন শ্রমিক কোদাল দিয়ে বেশ কয়েকদিন ধরে মাসুকের টিলা কাটছিলেন। সেখানে কেউ যাতে বুঝতে না পারে সেজন্য কাটা টিলার গায়ে গাছের ডালপালা বিছিয়ে রাখা রয়েছে। আবার টিলার উপর থেকে দড়ি দিয়ে ডালপালা বেঁধে নিচের দিকে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে।

টিলা কাটানোর ব্যাপারে জানতে চাইলে মাসুক বলেন, ওই স্থানে আরেকটি বাড়ি নির্মাণ করবেন। তাই, স্থান সমান করতে চার-পাঁচ দিন ধরে টিলা কাটাচ্ছেন।মাসুকের পাশের বাড়ীর সৈয়দ আবদুর রবের বাড়িতেও চলছে টিলা কাটার মহোৎসব। টিলা কেটে গাড়ি দিয়ে মাটি বিক্রি করা হচ্ছে। টিলা কাটার বিষয়ে তাঁর স্ত্রী সুলতানা বেগম বলেন, জামাল নামের স্থানীয় এক গাড়িচালক একটি রাস্তার কাজের জন্য টিলা কাটিয়ে ট্রাকে করে মাটি নেন। রাতে টিলা কাটা ও মাটি পরিবহনের কাজ চলে। টিলা কাটার অনুমতি দিলেন কেন এ প্রশ্নে তিনি কোনো মন্তব্য করতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

সহকারী কমিশনার (ভূমি) রতন কুমার অধিকারী বলেন, দুটি টিলার প্রায় পুরোটাই কাটা হয়ে গেছে। টিলা কাটায় জড়িত কোনো লোককে পাওয়া যায়নি। টিলার মালিকদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কার্যালয়ে প্রতিবেদন পাঠানো হবে।
মনিরুল ইসলাম, মৌলভীবাজার

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: