নগরায়ন হোক সুপরিকল্পিত

প্রকাশিত: ২৫ জানুয়ারি ২০২৩, ০৩:৩৮ পিএম

নগরায়ন আমাদেরকে আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে যেভাবে উন্নতির দিকে ধাবিত করে একইরকম এই প্রক্রিয়ায় অসচেতনতা এবং পরিকল্পনার অভাবে উন্নয়ন একটি গলার কাঁটায় পরিনত হয়ে থাকে। বিশেষত বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে নগরায়ন প্রক্রিয়া খুব দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে। শুধু ঢাকা চট্টগ্রামের মতো বড় শহরেই নয়, নগর, বন্দর, মফস্বল এলাকা ও এর আশেপাশেও অপরিকল্পিত নগরায়ন গড়ে উঠছে। তবে এই বৃদ্ধির ধারা সব জায়গায় সমান নয়। সাধারণত বড় শহরে শিল্প-কারখানা, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, শিক্ষা-চিকিৎসার সুবিধা, সরকারি প্রশাসন ও বিনোদন ব্যবস্থার জন্য সেই সকল স্থানের নগরায়ন প্রক্রিয়া অধিক গতিশীল।

মূলত পরবর্তী প্রজন্মের ভবিষ্যৎ নগরীর সুবিধা এবং অসমন্বিত, অপরিকল্পিত, অসম ও ইতস্তত বিক্ষিপ্তভাবে ধীরে ধীরে একটি নগরের সম্প্রসারণকে বোঝায় যা সাধারণত টেকসই হয় না। এটি একাধিক বিভিন্ন প্রক্রিয়ার একটি ফলাফল যেখানে সম্পদের দক্ষ ব্যবহার সম্ভব হয় না।

আদি শহর ঢাকায় অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে তিল পরিমাণ স্থান খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়েছে। ইতোমধ্যে এই চক্রে পাহাড়সম সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। বাসস্থানের অভাবের ফলে গড়ে উঠছে ভাসমান মানুষের বস্তি। যার ফলশ্রুতিতে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের সৃষ্টি। এ শহরে ময়লা-আবর্জনা দুর্গন্ধ ইত্যাদি নিত্যদিনের সঙ্গি। শহরের বিপুল জনসংখ্যার বাসস্থানের ব্যবস্থা করতে গিয়ে অবৈধ দখলদারিত্ব বেড়ে চলেছে আশঙ্কাজনক হারে। লেক ও নদীর পাড়গুলো দখল করে নিচ্ছে কিছু অসাধু লোক। যার ফলে নদী হারাচ্ছে নাব্যতা, লেক হচ্ছে দূষিত। যার ফলশ্রুতিতে ঢাকা শহরে জলাবদ্ধতার মতো সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। খুব সহজ সমীকরণে বলা যায় জনসংখ্যা যত বেশী হবে তাদের দ্বারা সৃষ্ট ময়লা-আবর্জনা তত বেশী হবে এবং এই ময়লা আবর্জনা যত্র-তত্র নিক্ষেপের ফলে সৃষ্টি হয় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। পাশাপাশি পরিবেশ দূষণও মারত্মক আকার ধারণ করে। লেক ও নদীতে ময়লা আবর্জনা ছুঁড়ে ফেলার ফলে পানি হচ্ছে দূষিত এবং এ থেকে বিভিন্ন পানিবাহিত রোগের সৃষ্টি হচ্ছে। শহরের বস্তি এলাকগুলোতে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ সবচাইতে বেশি পরিলক্ষিত হয়। এই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বিভিন্ন জীবাণু থাকে যা আশেপাশের পরিবেশকে দূষিত করে এবং এর ফলে মানুষ অসুস্থ্য হয়ে পড়ে।

দ্রুত এবং অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে জলবায়ু পরিবর্তন এবং শহরে মাইগ্রেশন বাড়ছে। একইসঙ্গে শহরে সুপেয় পানির ওপর প্রভাব পড়ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে সঠিক পরিকল্পনা মাফিক কাজ না হলে শহর ব্যবস্থাপনা আমাদের জন্য কঠিন হবে। সমস্যা সমাধানে আমাদের স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে আগাতে হবে। তাছাড়া আগে জলবায়ুর একটা সীমারেখা ছিল। কিন্তু এখন আর সেটা নেই। যেই সময়ে শীত থাকার কথা সেই সময়ে থাকছে না। আমাদের শহর জলবায়ুর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। একশন এইড বাংলাদেশের ধারণাপত্রে বলা হয়, বৈশ্বিক উষ্ণতা ইতোমধ্যে জলবায়ুর স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় যে ভারসাম্যহীনতা তৈরি করেছে, তার প্রভাবে গত দুই দশক ধরে বিশ্ব জুড়ে লাখ লাখ মানুষের ওপর জলবায়ু পরিবর্তন জনিত বিপর্যয়ের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। যে কারণে বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলির মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। জলবায়ু পরিবর্তন একটি সমস্যা। তার সঙ্গে যোগ হচ্ছে নগরায়নের বিষয়। এই সমস্যাগুলো সমাধানে সচেতনতা বাড়াতেই হবে। যারা ক্ষমতায় আছেন তাদের দায়িত্ব পালন করতে হবে। গবেষকসহ বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব পালন করতে হবে। জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচি বাংলাদেশের সহকারী কান্ট্রি ডিরেক্টর খুরশিদ আলম বলেন, বাংলাদেশ সমস্যাগুলো খুঁজে বের করেছে। এখন সমন্বিতভাবে সমাধানে কাজ করতে হবে। বিভিন্ন শহরের কর্তাদের বিশেষ করে মেয়রদের রাজনৈতিক ক্ষমতা ও সচেতনা বাড়াতে হবে। যাতে তারা সমস্যা সমাধানে সঠিক উদ্যোগ নিতে পারেন

বর্তমানে ঢাকা শহরের ৬২ শতাংশ ভূমিতে গড়ে উঠেছে আবাসিক এলাকা। এর মধ্যে ২৫ শতাংশ ভূমিতে পরিকল্পনা অনুযায়ী এবং বাকি ৩৭ শতাংশে অপরিকল্পিত আবাসন ব্যবস্থা রয়েছে। এ ছাড়া আট শতাংশ ভূমিতে বাণিজ্যিক ও নয় শতাংশে প্রশাসনিক অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে। চার শতাংশ জায়গায় উন্মুক্ত জলাশয়সহ ১০ শতাংশ ভূমিতে গড়ে উঠেছে সেনানিবাস এবং দুই শতাংশে বিমানবন্দর। পরিকল্পিত কোনো মাস্টারপ্ল্যান না থাকায় শহরের প্রাণকেন্দ্রে গড়ে উঠেছে বড় বড় প্রশাসনিক ভবন, বিশ্ববিদ্যালয় ও বিমানবন্দর। শহরের ১২ শতাংশ জায়গা নিয়ে গড়ে ওঠা এসব স্থাপনা প্রভাব ফেলছে সামগ্রিক উন্নয়নে।

এক গবেষণায় বলা হয়, ৩৪ শতাংশ মানুষ নগরে বসবাস করে। অথচ গত ২০-২৫ বছরে নগরায়ন পরিকল্পিতভাবে হয়নি। যেখানে সেখানে ঘরবাড়ি উঠে যাচ্ছে। অপরিকল্পিতভাবে নগরায়নের থাবা পড়েছে ফসলি জমির ওপর। কমে যাচ্ছে আবাদি বা ফসলি জমি। অনেক শহরে এ অবস্থা আশঙ্কাজনক। দেখা যাচ্ছে জমি কমে যাওয়ায় একদিকে উৎপাদন কমছে, অন্যদিকে আগামীর বসতির জন্য চরম হুমকি ও চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে, যা আমাদের দেশের জন্য মোটেও কোনো সুখকর খবর নয়।

উন্নত নাগরিক সুবিধা দেওয়ার লক্ষ্যে দেশের সব উপজেলার জন্য মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করছে সরকার, ভবিষ্যতে উপজেলা পর্যায়ে পরিকল্পিত নগরায়নের উন্নয়ন কর্মকান্ডের দিক-নির্দেশনা হিসেবে কাজ করবে এ মাস্টারপ্ল্যানের নথি। ভূমি সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার ও পরিবেশ সংরক্ষণ করে শহুরে ও গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নের কথা আছে এ মাস্টারপ্ল্যানে।

দেশের ৪৯৫টির মধ্যে ১৪ উপজেলার মাস্টারপ্ল্যান আগেই তৈরি করা হয়েছে এবং আটটির মাস্টারপ্ল্যান তৈরির কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে।

২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত বাংলাদেশ গড়ার বর্তমান সরকারের লক্ষ্যের অংশ হিসেবে ৪৯৫টি উপজেলায় মাস্টারপ্ল্যান তৈরি হয়েছে। আবার ২০৩০ সালের মধ্যে সব উপজেলার স্বতন্ত্র মাস্টারপ্ল্যান তৈরি হবে। মাস্টারপ্ল্যানে প্রত্যেক উপজেলায়– উপযুক্ত আবাসন, হাসপাতাল, মার্কেট, স্কুল-কলেজ, খেলার মাঠ, কৃষি খামার, শিল্প কারাখানার জন্য স্থান নির্ধারণ করা থাকবে। যেই উদ্যোগ বাস্তবায়ন এখন সময়ের দাবী। অর্থাৎ দ্রুত বর্ধনশীল আমাদের নগরায়ন কাঠামোতে পরিকল্পিত উদ্যোগই পারে স্থিতিশীল এবং ভারসাম্যপূর্ণ উন্নয়ন নিশ্চিত করতে।

প্রকৃতির বৈরিতার কাছে যেমন সব অর্থ বা ক্ষমতা হেরে যায়, তেমনি ধারণক্ষমতার চেয়ে অত্যধিক জনসংখ্যার চাপে সৃষ্ট সমস্যাও অপ্রতিরোধ্য। তাই হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ফ্লাইওভার নির্মাণ, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থাসহ বহু উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড ঢাকাকে বাসযোগ্য করতে কিংবা কাঙ্ক্ষিত সুফল দিতে পারেনি।

তাই পরিকল্পিত নগরায়ন এখন সব শ্রেণী-পেশার মানুষের প্রাণের দাবি। আর এজন্য যা করণীয় তা হল, সুষ্ঠু পরিবহন ব্যবস্থা, মেগাসিটির নাগরিক সমস্যার সমাধান, বস্তি জীবনের উন্নয়ন, অবকাঠামো উন্নয়ন, গ্যাস-পানি-বিদ্যুতের সরবরাহ নিশ্চিতসহ ভবিষ্যৎ উন্নয়ন প্রকল্প সমূহকে নির্ধারিত পরিকল্পনায় সংযুক্ত করা। তবেই উন্নত নগরী এবং সুশাসন নিশ্চিত সহজতর হবে।

লেখকঃ ড. জান্নাতুল ফেরদৌস, সহযোগী অধ্যাপক, লোক প্রশাসন বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: