পাহাড়টি ঘিরে আতঙ্ক-উদ্বেগ

প্রকাশিত: ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১০:৩৭ পিএম

কক্সবাজার শহরের কলাতলীর মোড় থেকে টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের জাহাজপুরা এলাকার দূরত্ব ৬০ কিলোমিটারের কাছাকাছি। মেরিন ড্রাইভ বাদ দিয়ে অভ্যন্তরিন এলজিইডি সড়কের পূর্ব পাশে অবস্থিত গর্জন বাগান। দীর্ঘদিনের পুরানো এই বাগান ঘোর পাহাড় বললেও ভুল হবে। আর সড়কের পশ্চিমে অবস্থিত গ্রামের দোকানটির মালিক মোহাম্মদ উল্লাহ।

তিনি ১৮ ডিসেম্বর পাহাড়ের খালে মাছ ধরতে গিয়ে অপহরণ হওয়া ৮ জনের একজন। যে ৮ জন ৬ লাখ ৪০ হাজার মুক্তিপণে ফিরেছিলেন ৪ দিন পর ২১ ডিসেম্বর রাতে।

ঘটনার ১ মাস অতিবাহিত হলে মোহাম্মদ উল্লাহর মন থেকে কাটেনি আতংক। বৃহস্পতিবার (২৬ জানুয়ারি) দুপুরে তিনি বলেন, দোকান পরিচালনা করে সংসার চালান তিনি। শখের বশে পাহাড়ি খালে গিয়েছিলেন মাছ ধরতে। ওখানে গিয়ে নির্যাতনের শিকার হলেন। আর শেয তার পরিবারের পক্ষে ৫০ হাজার টাকা মুক্তিপণ দিয়ে ফিরেছেন। একই সময় আশে পাশে ছিলেন, ওই দিন অপহরণ হওয়া করিম উল্লাহ, মো রিদুয়ান, নুরুল আবছার ও নুর মোহাম্মদ।

তারা জানিয়েছেন, পাহাড়টির গহীনে আস্তানা তৈরী করে অবস্থান নেয়া অপরাধি চক্রের হাতে রয়েছে অসংখ্য ভারী অস্ত্র। তাদের সংখ্যা ২২ থেকে ২৫ জন হলেও অস্ত্রের সংখ্যা আরও বেশি। এরা কালো রঙের পোষাক, প্যান্ট, একই ধরনের জুতা ও ক্যাপ ব্যবহার করেন। বাহিনীর রোহিঙ্গা সদস্য ছাড়া সকলের মুখে থাকে মুখোশ। এরা প্রশিক্ষিত, প্রযুক্তি জ্ঞান সম্পন্ন এবং পাষাণ। এদের ভয়ে ভুলে পাহাড়ে যান না এরা। একই সঙ্গে এলাকার কেউ পাহাড়ে প্রবেশ করারও সাহস পাচ্ছে না।

ওই এলাকার প্রবীণ ব্যক্তি হাবিবুর রহমান জানান, বাহারছড়া ইউনিয়নের মানুষের জীবন জীবিকার উৎস সাগর ও পাহাড়। সাগরে মাছ ধরা, পাহাড়ে পান বরোজ, সবজি ক্ষেত করাই কাজ করেন বেশি ভাগ মানুষ। সশস্ত্র সন্ত্রাসীর কারণে পাহাড়ে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল।

তিনি জানান, জাহাজপুরা বাগান থেকে শুরু পূর্ব গেলে শেষ এলাকাটি হ্নীলা ইউনিয়নের লেচুয়াপ্রাং। যার দূরত্ব হল ১০ কিলোমিটার মত। এই পাহাড় এখন অনিরাপদ ও আতংকের।

বাহারছড়া ইউনিয়নের সাগর উপকুল শামলাপুর-হোয়াইক্যং পাহাড়ি সড়ক থেকে শুরু করে দক্ষিণের মাথাভাঙা পাহাড় আর পূর্বের হ্নীলা ও হোয়াইক্যং ইউনিয়নের পাহাড়টি আতংকিত বলছেন সকলেই। এখানে গত ৪ মাসে একজনের মরদেহ উদ্ধার হয়েছে। আর অপহরণের শিকার হওয়ার পর মুক্তিপণ দিয়ে ফিরেছেন ২০ জন স্থানীয় মানুষ। যারা সকলেই বাহারছড়া ও হ্নীলা ইউনিয়নের মানুষ।

এর মধ্যে সর্বশেষ ২১ জানুয়ারি হোয়াইক্যং শামলাপুর সড়ক পাহাড়ি ঢালার ভেতর থেকে মোহাম্মদ হোসেন নামে এক ইজিবাইক চালকের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের লেচুয়াপ্রাং এলাকার শাহ আলম প্রকাশ বাদশা মিয়ার ছেলে মোহাম্মদ হোসেন ১২ জানুয়ারি সকালে ইজিবাইক নিয়ে বাড়িতে থেকে বের হওয়ার পর রাতে আর বাড়িতে ফিরে আসেনি। ৯ দিন পাওয়া যায় তার মরদেহ। পাওয়া যায়নি তার ইজিবাইকটি।

বাহারছড়া ইউনিয়নে গত ৩৫ বছরের শিক্ষকতার জীবনে এমন ভয়াবহ আতংক আর কোন দিন দেখেন বলে মন্তব্য করেছেন বাহারছড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক আবুল মঞ্জুর। তিনি জানান, পাহাড় ঘীরে এ অপরাধ শুরু হয় গত দেড় বছর আগে থেকে।

তিনি জানান, ২০২১ সালের ২৯ জুন হোয়াইক্যং-বাহারছড়া সড়ক থেকে অপহরণ করা হয় বাহারছড়ার উত্তর শিলখালী এলাকার মৃত ছালেহ আহমেদের ছেলে সিএনজি চালক মোহাম্মদ করিমকে। এর পর ফোনে মুক্তিপণের টাকা দাবি করা হয়। পরিরারের লোকজন ৫০ হাজার টাকা মুক্তিপণও দেন। কিন্তু ছেড়ে দেয়া হয়নি। পরে ১২ আগস্ট বনবিভাগ কর্তৃক ঝোপঝাড় পরিস্কার করার সময় পরিচ্ছন্নতা কর্মীর একটি মাথার খুলি ও কঙ্কাল দেখতে পায়। মরদেহের পরিহিত কাপড়, বেল্ট দেখে এটি করিমের মরদেহ বলে শনাক্ত করা হয়। ওই ঘটনা থেকে একের পর এক অপহরণ মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনায় আতংক তৈরী হয়েছে। বাহারছড়া, হোয়াইক্যং ও হ্নীলা ইউনিয়ন জুড়ে এই আতংক বিরাজ করছে। অথচ পূর্ব পশ্চিমের ১০ কিলোমিটার এবং উত্তর দক্ষিণ ২০ কিলোমিটার পাহাড়টি যৌথ বাহিনী অভিযান করে সশস্ত্র সন্ত্রাসী আটক কঠিন কোন কাজ না। রহস্যজনক কারণে এটা হচ্ছে না।

টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুর আহমদ আনোয়ারী জানান, তাঁর ইউনিয়নের কম্বনিয়াপাড়া মহেশখালিয়াপাড়া, কাঞ্জরপাড়া, খারাংখালী, সাতঘড়িয়াপাড়া, রইক্ষ্যম এলাকায় এক হাজারের বেশি পরিবার পাহাড়ের সন্ত্রাসীদের আতংকে রয়েছে। যেখানে গত ১ বছরে চারজন স্থানীয় বাসিন্দাকে অপহরণের পর মুক্তিপণ না পেয়ে হত্যা করা হয়েছে। তাঁদের একজন হোয়াইক্যং আলী আছিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের দপ্তরি।

হ্নীলা ইউপির চেয়ারম্যান রাশেদ মাহমুদ আলী বলেন, তাঁর এলাকার দমদমিয়া, জাদিমোরা, লেদা, আলীখালী, রঙ্গিখালী, পানখালী, কম্মুনিয়াপাড়া ও মরিচ্চ্যঘোনা এলাকায় দেড় হাজারের বেশি পরিবার রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের কাছে জিম্মি। রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা প্রায়শ মানুষকে ধরে নিয়ে মুক্তিপণ আদায় করেছে। চাঁদা না পাওয়ায় যুবলীগের নেতা ওমর ফারুক ও স্থানীয় বাসিন্দা মো. হোসেনকে গুলি করে হয়। ফলে আতংক বাড়ছে দিনের পর দিন।

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: