কমিউনিটি সেন্টারের নিকাহ রেজিষ্ট্রি নিয়ে টানাটানি, দুই কাজীর দ্বন্দ্ব

প্রকাশিত: ১৯ মার্চ ২০২৩, ১০:০৪ পিএম

হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলায় একটি কমিউনিটি সেন্টারকে দুটি ইউনিয়নের নিকাহ রেজিষ্ট্রি নিয়ে টানাটানি চলছে। বিয়ে রেজিস্ট্রিকে কেন্দ্র করে দুই কাজীর দ্বন্দ্ব ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। ফলে নিকাহ ও তালাক রেজিস্টারের বিষয়টি নিয়ে জনতার মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছে।। যেকোনো মুহুর্তে দুই ইউনিয়নের লোকজনের মধ্যে বড় ধরণের সংঘর্ষের আশঙ্কা রয়েছে।

এনিয়ে জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর অভিযোগ দেয়া হয়েছে। উপজেলা প্রশাসন বিষয়টি সমাধান করলেও এক পক্ষ আবার জেলা প্রশাসকের কাছে অভিযোগ দিয়েছেন। উপজেলা প্রশাসন বলছে একটি পক্ষ তাদের নির্দেশনা অমান্য করে জেলায় অভিযোগ করেছে।

লিখিত অভিযোগ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়- নবীগঞ্জ উপজেলার ১৩টি ইউনিয়নের নিকাহ ও তালাক রেজিস্টারের জন্য ১৩ জন কাজী দায়িত্ব পালন করছেন। মুসলিম বিবাহ এবং বিবাহ বিচ্ছেদ (নিবন্ধন) বিধিমালা ২০০৯ অনুয়ায়ী একজন কাজী দায়িত্বরত এলাকায় দায়িত্ব পালন করবেন। দায়িত্বরত এলাকার বাহিরে বিবাহ-তালাক রেজিস্ট্রি করা নিয়ম পরিপন্থি ও আইনের লঙ্ঘন।

নবীগঞ্জ উপজেলার ২নং বড় ভাকৈর (পূর্ব) ইউনিয়নের কাজীগঞ্জ বাজারে ২০০৪ সালে ময়মনা কমিউনিটি সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেন ওই এলাকার আছকির মিয়া। দীর্ঘ ১৯ বছর ধরে ময়মনা কমিউনিটি সেন্টারের ট্যাক্স ২নং বড় ভাকৈর (পূর্ব) ইউনিয়নে পরিশোধ করে আসছেন আছকির মিয়া । এছাড়া এই ইউনিয়ন থেকে সংগ্রহ করা ট্রেড লাইন্সেন্স প্রতি বছর নবায়নও করা হয়। প্রতিবছর উপজেলা প্রশাসন কর্তৃক হাট বাজার ইজারা সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তিতে কাজীগঞ্জ বাজারকে ২নং বড় ভাকৈর (পূর্ব) ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত দেখানো হয়। এই ইউনিয়নের নিকাহ ও তালাক রেজিস্টার (কাজী) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন কাজী মাওলানা গুলজার আহমেদ।

ময়মনা কমিউনিটি সেন্টার দায়িত্বপ্রাপ্ত এলাকায় হওয়ায় কাজী মাওলানা গুলজার আহমেদ বিবাহ-তালাক রেজিস্ট্রি করে আসছেন। ৩নং ইনাতগঞ্জ ইউনিয়নে নিকাহ ও তালাক রেজিস্টার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন কাজী ছালিম উদ্দিন। ২০১৩ সালে ময়মনা কমিউনিটি সেন্টার ইনাতগঞ্জ ইউনিয়নের একটি মৌজার অন্তভুক্ত দাবী করে বড় ভাকৈর (পূর্ব) ইউনিয়নে নিকাহ ও তালাক রেজিস্টার কাজী মাওলানা গুলজার আহমেদকে বিবাহ ও তালাক রেজিস্ট্রিতে বাঁধা প্রদান করেন ইনাতগঞ্জ ইউনিয়নের কাজী ছালিম উদ্দিন।

বিষয়টি সমাধানে চেষ্টা করে জাতীয় কাজী সমিতি নবীগঞ্জ উপজেলা শাখা। কিন্তু আসেনি সমাধান। পরে ২০১৩ সালে ইনাতগঞ্জ ইউনিয়নের কাজী ছালিম উদ্দিন বাদী হয়ে হবিগঞ্জ সহকারী জজ আদালতে স্বত্ত মামলা নং ৯৩/২০১৩ ও মামলা নং ৫৪/২০১৪ দায়ের করেন। মামলায় কাজী ছালিম উদ্দিন ময়মনা কমিউনিটি সেন্টার ইনাতগঞ্জ ইউনিয়নের অন্তভুক্ত এবং উক্ত কমিউনিটি সেন্টারে বিবাহ রেজিস্ট্রিতে বড় ভাকৈর (পূর্ব) ইউনিয়নে কাজী মাওলানা গুলজার আহমেদের বিরুদ্ধে স্থায়ী নিষেধাজ্ঞা চেয়ে আদালতের হস্তক্ষেপ কামনা করেন। ২০১৮ সালে হবিগঞ্জের সহকারী জজ আদালতের বিচারক মোহাম্মদ নুরুল হুদা চৌধুরী কাজী ছালিম উদ্দিনের দুটি মামলাটি খারিজ করে দেন।

পরে জেলা জজ আদালতে কাজী ছালিম উদ্দিন আপিল করেন। কিন্তু কিছুদিন পর মামলা পরিচালনা করবেন না মর্মে আপিল তোলে নেন। ২০২২ সালের ১০ অক্টোবর বড় ভাকৈর (পূর্ব) ইউনিয়নে কাজী মাওলানা গুলজার আহমেদ ময়মনা কমিউনিটি সেন্টারে একটি বিবাহ রেজিস্ট্রিকালে ইনাতগঞ্জ ইউনিয়নের কাজী ছালিম উদ্দিন বাঁধা দেন এবং হুমকি দেন। এনিয়ে ২৩ অক্টোবর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার বরাবর একটি লিখিত অভিযোগ দেন কাজী মাওলানা গুলজার আহমেদ।

অভিযোগের তদন্ত শেষে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইমরান শাহরীয়ার কাজী ছালিম উদ্দিনকে ময়মনা কমিউনিটি সেন্টারে বিবাহ রেজিস্ট্রি’র জন্য আদেশ দেন। কাজী গোলজার আহমদ বলেন, আমি ২০২২ সালের ৪ ডিসেম্বর আদালতের আদেশ অমান্য করার অভিযোগ এনে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসকের বরারর লিখিত অভিযোগ দেন কাজী মাওলানা গুলজার আহমেদ। কিন্তু ৩ মাস অতিবাহিত হলেও এর কোনো সুরাহা হয়নি। তিনি বলেন ইউএনও স্যার আদালতের আদেশ অমান্য করেছেন। আমি এতোদিন এই কমিউনিটি সেন্টারে নিকাহ রেজিষ্ট্রি করেছি এখন জোর করে বাঁধা দেয়া হচ্ছে।

কাজী ছালিম উদ্দিন বলেন, আমি বৈধ কাজী হিসাবে তাকে বাঁধা দিয়েছি। প্রশাসন তদন্ত করে পেয়েছেন ময়মনা কমিউনিটি সেন্টার ইনাতগঞ্জ ইউনিয়নে অবস্থিত তাই আদেশ আমার পক্ষে আসার পরও সেই কাজী গোলজার জোর করে এখানে এসে বিয়ে রেজিষ্ট্রি করতে চায়।তাই আমরা বাঁধা দিয়েছি, আগামীতেও প্রতিহত করা হবে।

আগনা গ্রামের রহিম উল্লাহ বলেন, এঘটনাকে কেন্দ্র করে দুই ইউনিয়নের লোকজনের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছে যেকোনো মুহুর্তে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা।

এ প্রসঙ্গে বড় ভাকৈর (পূর্ব) ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান খালেদ মোশারফ বলেন- কাজীগঞ্জ বাজার ২নং বড় ভাকৈর (পূর্ব) ইউনিয়নের অন্তভুক্ত, ২০০৪ সালে ময়মনা সেন্টার প্রতিষ্ঠার পর থেকে ট্যাক্স, ট্রেড লাইসেন্স এই ইউনিয়ন থেকেই নবায়ণ করা হয়ে আসছে। আমাদের ইউনিয়নের প্রায় সকল বিয়ে এই সেন্টারে অনুষ্ঠিত হয়। আদালতের আদেশ থাকার পর ইউএনও সাহেব আবার কিভাবে এ বিষয়ে আদেশ দেন বিষয়টি বোধগম্য নয়। এখানে ইনাতগঞ্জ ইউনিয়নের কাজী বিবাহ রেজিস্ট্রি করলে ইউনিয়ন বাসী চরম দুর্ভোগে পড়বে।

ইনাতগঞ্জ ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান নোমান আহমদ বলেন, ময়মনা সেন্টারের জায়গাটি ইনাতগঞ্জ ইউনিয়নের আগনা মৌজায় পড়েছে। জায়গাটি যেহেতু ইনাতগঞ্জ ইউনিয়নের একটি মৌজার অন্তভুক্ত তাই ইনাতগঞ্জের কাজী সাহেব ওই সেন্টারে বিবাহ রেজিস্ট্রি করবেন মর্মে ইউএনও সাহেব সম্প্রতি একটি আদেশ দিয়েছেন।

নবীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইমরান শাহরিয়ার বলেন, তিনি আদালতের কোন আদেশ অমান্য করেননি। আদালত আদেশ দিয়েছেন স্থানীয় প্রশাসন তদন্ত করে ব্যবস্থা নিবেন, সেই আলোকে আমরা তদন্ত করে আদেশ দিয়েছি। এখন কাজী গোলজার আহমদ বিভিন্ন জায়গায় আদালতের ভুল তথ্য দিচ্ছেন,প্রশাসনকে বিভ্রান্ত করছেন আমরা তার নিকাহ রেজিষ্ট্রি বাতিলের জন্য আইন মন্ত্রনালয়কে চিঠি দিয়েছি।

হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসক ইশরাত জাহান বলেন, এ নিয়ে কোনো আবেদন আমার কাছে দেয়া হয়েছে বলে আমার মনে নেই। যদি তাদের কাছে আবেদনের কপি তাকে তারা যেন আমাকে দেয়, আমি পরবর্তী ব্যবস্থা নিবো।

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: