চারদিক পানিতে একাকার, নেই শুধু খাওয়ার পানি

প্রকাশিত: ২২ মার্চ ২০২৩, ০৬:১৭ পিএম

দক্ষিণাঞ্চলের শেষ জেলা সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলা থেকে নীলডুমুর খেয়াঘাট, দক্ষিণপশ্চিমে খেলপেটুয়া নদী, তার উত্তরদক্ষিণে কপোতাক্ষ নদ। একদিকে বুড়িগোয়ালিনী অন্যদিকে দ্বীপ ইউনিয়ন গাবুরা। কিন্ত চারদিকে পর্যাপ্ত পানি থাকলেও নেই বিশুদ্ধ খাওয়ার পানি। এমন অবস্থা সাতক্ষীরার উপকূলীয় উপজেলা শ্যামনগরে। সুপেয় পানির জন্য এলাকাভেদে তিন-চার কিলোমিটার দূরে যেতে হয়। অনেককে বর্ষা ছাড়া সারা বছরই কিনে খেতে হয় পানি।

পাঁচ সদস্যের হতদরিদ্র পরিবারটিতে নিত্যদিনের সুপেয় পানি জোগানের দায়িত্ব অনিমা মন্ডলের কাঁধে। প্রতিদিন খুব সকালে বাড়ি থেকে তিন কিলোমিটার দূরের বুড়িগোয়ালিনী থেকে খাওয়ার পানি সংগ্রহ করেন তিনি। রান্না ও খাওয়ার পানির জন্য প্রতিদিনই অনিমা মন্ডলের পাড়ি দিতে হয় এতখানি পথ। সুপেয় নিরাপদ পানির সংকট এত প্রবল যে প্রতিদিন যদি এই পথ তিনি পাড়ি না দেন, তাহলে ঘরের পাশের নদীর লবণক্ত পানি হবে তার শেষ ভরসা।

তিনি বলছিলেন, ‘চারিদিক পানিতে একাকার, কিন্তু খাওয়ার উপযোগী এক ফোঁটা পানির জন্য তাঁর বাড়ি থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে বুড়িগোয়ালিনী গ্রামে পানি আনতে ছুটতে হয়। এত কষ্ট করে পানি আনার পর তৃষ্ণা মেটানোর জন্য পান করতে গিয়েও ভাবতে হয় তাঁদের। কারণ, পানি শেষ হলে আবারও ছুটতে হবে। তাই পানি খেতেও তাঁরা মিতব্যয়ী। এভাবেই পানির জন্য জীবন সংগ্রামের কথা এজেড নিউজ বিডি ডটকমকে জানান সাতক্ষীরার উপকূলীয় বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের অনিমা মন্ডল।

একই এলাকার চন্দনা রাণীর অসহায় আর্তি, আমাদের এলাকায় পানির সংকট খুবই। আমরা লবণ পানি খেয়ে বেচে আছি। আগে সরাসরি পুকুরের পানি খেতাম। এখান ফিল্টার হওয়ার কারণে কিছুটা হলেও নিরাপদ পানি পান করছি। তাঁর পরেও আমাদের পানি লবণ, আমরা আর লবণ পানি খেয়ে জীবন ধারণ করতে পারছি না। আমাদের গ্রামে যারাই আসে তাদের কাছে আমরা মিষ্টি পানির জন্য দাবি জানায়। অমলা রাণী সেন বলেন, আমরা অনেক দূর থেকে এসে পানি নিয়ে যায়, আমাদের এই খাওয়ার পানিটা চৈত্র- বৈশাখ মাসে বেশি লবণাক্ত হয়ে যায়, যে কয় মাস বৃষ্টি হয় সে কয় মাস একটু পানি খাওয়া যায়।

ওই এলাকার দিলিপ মাঝি জানান, আমাদের প্রামে আগে পিএসএফ (পন্ড স্যান্ড ফিল্টার) ছিলনা, আমরা ছোটবেলায় দেখেছি আমাদের এখানে এই পুকুরটা খনন করা ছিল না, অপরিষ্কার ছিল। একটি বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগে আমাদের গ্রামে একটি কমিটি গঠন করা হয়, ওই কমিটির মাধ্যমে জেলা পরিষদের যোগাযোগ করলে জেলা পরিষদ থেকে এই পুকুর খনন করে দেওয়া হয়। ঘূর্ণিঝড় আইলার সময় আমাদের এই পুকুরটি লবণ পানিতে ডুবে যাওয়ার কারণে পুকুরটি লবণ পানিতে ভরে যায়। পরবর্তীতে আবারও জেলা পরিষদ খনন করে দেয়। কিন্তু আগের মতো আর ভালো পানি পাওয়া যায় না। তখন আমাদের আবেদনের ভিত্তিতে বেসরকারি সংস্থা সুশীলন এই পিএসএফ (পন্ড স্যান্ড ফিল্টার) করে দেয়।

তিনি আরও জানান, পানখালী, তালবারিয়াসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে এই ফিল্টারে আগে প্রায় ৩'শ থেকে ৪'শ পরিবার পানির নিত। লবণাক্ততা বৃদ্ধির কারণে এখন দুই থেকে আড়াই 'শ পরিবার পানি নেয়। আমাদের ফিল্টারের আনুষঙ্গিক খরচ আছে। যে কারণে সবাইকে মাসে ২০ টাকা করে দিতে হয়। তিনি আরও বলেন, আমাদের এই পুকুরের লবণাক্ততার কারণ হচ্ছে পাশে যে চর আছে ওটা সরকার ডিসিআর দেয়। ওই জমিতে লবণ পানি তুলে বন্ধ করে রাখে, এই কারনেই আমাদের খাওয়ার পানির পুকুরটি লবণে ভরে যায়। পুকুরের যদি মিষ্টি পানি থাকতো তাহলে আমাদের পুকুরটা সমস্যা হতো না। আমরা সরকারের কাছে দাবি রেখেছিলাম, কিন্ত আমাদের দাবি রাখা হয়নি।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানায়, সাতক্ষীরা শ্যামনগর উপজেলার উপকূলের জীবন্ত সমস্যা বিশুদ্ধ সুপেয় পানি। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সাগরকূলে বসবাসরত এ জনপদের মানুষকে প্রতিনিয়ত লোনা পানির সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকে থাকতে হচ্ছে। উপর্যুপরি বেড়িবাঁধ ভাঙনের কারণে একসময়ের সবুজ শ্যামল জনপদ প্রায় গাছগাছালিশূন্য হয়ে পড়েছে। কৃষি উৎপাদন নেমে এসেছে শূন্যের কোটায়। ফলে এলাকায় কর্মসংস্থানের সংকট মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। বৃক্ষরাজি শূন্য হয়ে পড়ায় এ অঞ্চলের মানুষকে প্রতিনিয়ত মারাত্মক জ্বালানি সংকটও মোকাবিলা করতে হচ্ছে। সুপেয় খাওয়ার পানির সংকটে এখানকার মানুষের জীবন বিপর্যস্ত।

২০০৭ সালের ঘূর্ণিঝড় সিডর ও ২০০৯ সালের ২৫ মে ঘূর্ণিঝড় আইলার তান্ডবের পর থেকে উপকূলীয় এলাকায় সুপেয় পানির এ সংকট কাটছে না। আইলার আঘাতে সমুদ্রের লবণাক্ত পানিতে প্লাবিত হয় বিস্তীর্ণ অঞ্চল। এ অঞ্চলের প্রায় সব বিশুদ্ধ পানির উৎস ধ্বংস হয়ে যায়। লবণাক্ত পানি লোকালয়ে ঢুকে পড়ায় দেখা দেয় সুপেয় পানির তীব্র সঙ্কট। উপকূলের মানুষ সেই সংকট এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি। যদিও গত একযুগে সরকার ও বিভিন্ন বেসরকারি উদ্যোগে নানান পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।

সাতক্ষীরা জেলা পানি কমিটির সভাপতি অধ্যক্ষ আশেক-ই-এলাহী বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরার খাবার পানির মারাত্মক সংকট। খাওয়ার সাথে ব্যবহারের পানিরও তিব্রতা রয়েছে, যাঁর কারণ লাবণ পানির মাত্রটা অনেক বেড়েছে। আশির দশক থেকে এই এলাকায় পানির এই তীব্র সংকট মারাত্মক ভাবে বাড়ে, যদিও এরআগে উপকূলের মানুষ পুকুরের বা বিভিন্ন পানি ব্যবহার করতেন।

তিনি আরও বলেন, ২০০৯ সালে আইলা আঘাত হানলে শ্যামনগর উপকূলের কৈখালী, মুন্সিগঞ্জ, পদ্মপুকুর, গাবুরা, পার্শ্ববর্তী কয়রার বেতকাশী, উত্তর বেতকাশী, এই পুরো অঞ্চলটা প্লাবিত হয়ে যায় এবং পানির যত আধার ছিল মানুষগুলো যে পানি ব্যবহার করত সেই পানিগুলো সব লবণ পানিতে ডুবে যায়। পাশাপাশি এই এলাকায় মারাত্মকভাবে আশির দশকের পর থেকে বাণিজ্যিক চিংড়ি মাছ চাষ শুরু হয়ে যায়, ফলে পুরোপুরিভাবে এ এলাকার পানি চিংড়ি চাষের কারণে আশপাশের কৃষি জমি গুলো লবণ পানিতে ভরে যায়।

তিনি বলেন, এ অঞ্চলে একসময়ে জেলা পরিষদের মাধ্যমে অনেক গুলো পুকুর খনন করা হয়েছিল সুপেয় পানির জন্য, সবগুলোই নষ্ট হয়ে যায়। বাণিজ্যিক চিংড়ি চাষে স্থানীয় সরকারের নানান ধরনের ত্রুটির কারণে এগুলোকে আবার বন্দোবস্ত দেওয়া হয়, এটার ফলে পুরোপুরি ভাবে এখানে পানি নষ্ট হয়ে গেছে।

অধ্যক্ষ আশেক-ই-এলাহী বলেন, সম্প্রতিক কিছু সংগঠন আইলার পরবর্তীতে সরকারি এবং বেসরকারি ভাবে একটি মিনিমাম পানির ব্যবস্থা করা হয় খাবার পানির বিভিন্ন সোর্স থেকে, যে পরিমাণে পানির সংকট তাঁর ১০ পারসেন্টও কভার হয়না। আমাদের দক্ষিণ উপকূলীয় অঞ্চলের ৬০ ভাগ মানুষ সুপেয় খাবার পানি থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত। নারীদের ২-৩ কিলোমিটার দূরে যেয়ে পানি সংগ্রহ করতে হয়। এবং এ এলাকায় নারীর প্রতি সহিংসতার যে ঘটনা গুলো, তাঁর অন্যতম কারণ হচ্ছে খাওয়ার পানি সংগ্রহ করার কারণে দীর্ঘ সময় পরিবার থেকে বাহিরে থাকার কারণে।

তিনি বলেন, এই অবস্থার একটা পরিবর্তন আনতে হলে সরকারকে একটি বড় প্রোগ্রাম করতে হবে। উপকূলীয় অঞ্চলের পানির স্থায়ী সমাধানের জন্য একটি বড় পরিকল্পনার মধ্যে আসতে হবে। সেক্ষেত্রে বৃষ্টির পানির একটা ব্যবস্থা করা। আর উপরের মিষ্টি পানির যে ফ্লো ছিল, আমাদের প্রধানত কপোতাক্ষ নদের যে পানিটা যেত বেতনা দিয়ে যেয়ে খোলপেটুয়ার যে পানিটা। পিছনে ইছামতীর মিষ্টি পানির ফ্লো, এইযে ফ্লো গুলো সব বন্ধ হয়ে গেছে, এই ফ্লো গুলোকে যদি সচল করে দেওয়া যায় তাহলে একটা পানির আধার গড়ে উঠবে মিষ্টি পানির আগে যেটা ছিল। দ্বিতীয়তঃ হলো অনেক পরিমাণে পুকুর খনন করা দরকার এবং পুকুর খনন করে বৃষ্টির পানিটাকে সংরক্ষণ করা, যাতে পিএসএফ অথবা অন্য মাধ্যমে সাধারণ মানুষ পানিটা খেতে পারে। সুতরাং এই এলাকার জন্য সরকারের একটা দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা জরুরি বলে তিনি মনে করেন।

শ্যামনগর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এস এম আতাউল হক দোলন বলেন, দেশের সর্ব দক্ষিণের সর্ববৃহৎ উপজেলা শ্যামনগর,এ অঞ্চল সিডর, আইলা, ফণি, বুলবুল, আম্পান, ইয়াসে বার বার লন্ড ভন্ড হয়েছে। এই উপজেলার সাধারণ মানুষের সবথেকে প্রবল সমস্যা হচ্ছে বেড়িবাঁধ ও খাওয়ার পানি। বর্তমানে যে মৌসুম চলছে এখানে পানির তিব্রতা দেখা দিয়েছে। আমাদের উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের মধ্যদিয়ে মানুষের কল্যাণে আমরা প্লাস্টিকের বড় পানির ট্যাংকি প্রদান করে থাকি।

এর বাহিরেও যে বরাদ্দ আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রদান করেন সেই বরাদ্দ থেকেও আমরা স্বল্প পরিসরে পানির ট্যাংকি দিয়ে সাধারণ মানুষের পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে থাকি। তবে যে পরিমাণে পানির চাহিদা সেই পরিমাণে খুবই অপ্রতুল। সুপেয় পানির জন্য আমাদের বেশি করে রেইন ওয়াটার হারভেস্টিং প্ল্যান যদি দেওয়া হয়, এবং যে এলাকাগুলো নলকূপ সাকসেসফুল সেই এলাকাগুলোয় যদি আরও বেশি নলকূপ বরাদ্দ দেওয়া হয় তাহলে এলাকার মানুষের পানির চাহিদা মিটবে।

উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. মোস্তাফিজুর রহমান জানান, শ্যামনগর উপজেলার ১২টি ইউনিয়নের মধ্যে দ্বীপ ইউনিয়ন গাবুরা এবং পদ্মপুকুর ইউনিয়নে সুপয়ে পানির বেশি সমস্যা। ভুরুলিয়া, শ্যামনগর সদর, নুরনগর, ঈশ্বরীপুর ও বুড়িগোলনি এই ৫টি ইউনিয়নে কোন মিষ্টি পানির আধার নেই। বাকী ইউনিয়ন গুলোয় কিছু কিছু অংশে নলকূপ বাসানো সম্ভব। যেখানে বাসানো সম্ভব হচ্ছে না, সেখানে রেইন ওয়াটার হারভেস্টিংয়ের মাধ্যমে পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। যেখানে মিষ্টি পানির পুকুর আছে, সেখানে ফিল্টারে মাধ্যমে দিয়ে থাকি। বর্তমানে পানির স্থাপনা রয়েছে ৬ হাজারের অধিক।

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: