
১৫ আগস্ট বাঙালি জাতীয় এক শোকের দিন। এই দিনে বাংলার আকাশ-বাতাস আর প্রকৃতিও অশ্রুসিক্ত হওয়ার দিন। কেননা ১৯৭৫ সালে এই দিনে বঙ্গবন্ধুসহ সপরিবারের রক্ত আর আকাশের মর্মছেঁড়া অশ্রুর প্লাবন হয়েছিল।
ঘড়ির কাঁটা তখনও ভোর ৫টা ছুঁই ছুঁই। দূরে মসজিদ থেকে ভেসে আসছে মুয়াজ্জিনের কণ্ঠে ফজর নামাজের আজানের সুমধুর ধ্বনি। ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরের ৬৭৭ নম্বর বাড়িটির চারপাশে তখন ভোরের আলো সবেমাত্র ফুটছে। বাড়িটি আড়াই তলা। দুই রুমবিশিষ্ট দোতলায় ছিলেন তিনি। এসময় বঙ্গবন্ধুসহ সপরিবারে বুলেটের বৃষ্টিতে ঘাতকরা ঝাঁঝরা করে দিয়েছিল, তখন যে বৃষ্টি ঝরছিল, তা যেন ছিল প্রকৃতিরই অশ্রুপাত। ভেজা বাতাস কেঁদেছে সমগ্র বাংলায়। ঘাতকদের উদ্যত অস্ত্রের সামনে ভীতসন্ত্রস্ত বাংলাদেশ বিহ্বল হয়ে পড়েছিল শোকে আর অভাবিত ঘটনার আকস্মিকতায়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি স্বাধীনতার স্বপ্নকে হারিয়েছিল। আজ ১৫ আগস্ট শোকার্দ্র বাণী পাঠের দিন, স্বাধীনতার স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৮তম শাহাদাতবার্ষিকী।
সেই বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডে পাষণ্ড ঘাতকদের হাত থেকে রেহাই পায়নি শিশু রাসেল,শিশু বাবু,এমনকি অস্তঃসত্ত্বা বধূও। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী শেখ ফজিলাতুননেছা, পুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রাসেল, শেখ কামালের স্ত্রী সুলতানা কামাল, জামালের স্ত্রী রোজী জামাল, বঙ্গবন্ধুর ভাই শেখ নাসের, এসবি অফিসার সিদ্দিকুর রহমান, কর্নেল জামিল, সেনা সদস্য সৈয়দ মাহবুবুল হক, প্রায় একই সময়ে ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুর ভাগনে যুবলীগ নেতা শেখ ফজলুল হক মণির বাসায় হামলা চালিয়ে শেখ ফজলুল হক মণি, তার অন্ত:সত্ত্বা স্ত্রী আরজু মণি, বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াতের বাসায় হামলা করে সেরনিয়াবাত ও তার কন্যা বেবী, পুত্র আরিফ সেরনিয়াবাত, নাতি সুকান্ত বাবু, আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বড় ভাইয়ের ছেলে সজীব সেরনিয়াবাত এবং এক আত্মীয় বেন্টু খান।
কেন মারা হয়েছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে?
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পিছনে আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ কারণ রয়েছে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী এবং তাদের আন্তর্জাতিক মুরব্বিদের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। স্বাধীনতার পর থেকেই পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ভুট্টো বাংলাদেশ বিরোধী প্রচারণা চালাতে থাকেন এবং বাংলাদেশের চরম ডান ও বামপন্থিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে বঙ্গবন্ধুকে উৎখাত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। আমেরিকান গবেষক ও লেখক স্টেনলি ওলপার্টের মতে, ‘ভুট্টো দুই বছর ধরে আব্দুল হকসহ অন্যান্য মুজিববিরোধী দলকে অর্থ ও অস্ত্র সাহায্য অব্যাহত রাখেন এবং বিনিময়ে ১৯৭৫ সালের আগস্টে ফল লাভ (মুজিব হত্যা) করেন।’
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ সৃষ্টির তিন বছর পর ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু নতুন যে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রবর্তনে উদ্যোগী হন, তাকে তিনি দ্বিতীয় বিপ্লব বলে আখ্যায়িত করেন। দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচির মধ্যে ছিল সরকার পদ্ধতির পরিবর্তন (সংসদীয় পদ্ধতির স্থলে রাষ্ট্রপতি শাসিত ব্যবস্থা), সব দল বিলুপ্ত করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সব দল ও সব শ্রেণী-পেশার মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) নামে একটি জাতীয় দল গঠন করেন।
বঙ্গবন্ধু কর্তৃক দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দেয়ার একটি পটভূমি রয়েছে। স্বাধীনতা-উত্তর বঙ্গবন্ধু সরকারকে এক চরম বৈরী অবস্থায় দায়িত্ব পালন করতে হয়। সশস্ত্র ডাকাতি, লুটতরাজ, ঘুষ, দুর্নীতি, কালোবাজারি, মজুদদারি, ’৭৪-এর দুর্ভিক্ষ ইত্যাদি থেকে উদ্ভূত পরিস্থিতি নবগঠিত সরকারের পক্ষে মোকাবেলা করা খুবই কঠিন ছিল। তত্কালীন চরম বামপন্থী কিছু সংগঠন যেমন সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বাধীন সর্বহারা পার্টি, আব্দুল হকের পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি, আ স ম আব্দুর রবের জাসদসহ আরো কিছু চরমপন্থী দল থানা, পুলিশ ফাঁড়ি, বাজার ও ব্যাংক লুট, পাটের গুদামে আগুন, রেললাইনের স্লিপার উপড়ে ফেলা, শ্রেণী শত্রু খতমের নামে মানুষ হত্যা, সংসদ সদস্য হত্যা ইত্যাদির মাধ্যমে কার্যত সরকারের বিরুদ্ধে অঘোষিত যুদ্ধে লিপ্ত হয় এবং দেশে এক অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। সেই অরাজতা ও তাদের ক্ষমতার লোভে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেন।
কীভাবে মারা হয়েছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে?
বিপথগামী হিংস্র সেনাসদস্যদের হামলার খবর পেয়েই বঙ্গবন্ধু নিজ কক্ষ থেকে ইন্টারকম টেলিফোনে তার ব্যক্তিগত সহকারী আ ফ ম মুহিতুল ইসলামকে বলেন, ‘সেরনিয়াবাতের (তৎকালীন কৃষিমন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাত) বাসায় দুষ্কৃতকারীরা আক্রমণ করেছে। বঙ্গবন্ধু তখন আ ফ ম কে বলেন জলদি পুলিশ কন্ট্রোল রুমে ফোন লাগা।’ কিন্তু কন্ট্রোল রুমের লাইনে সংযোগ হচ্ছিল না। একটু পরে বঙ্গবন্ধু নিজেই তার কক্ষের দরজা খুলে বেরিয়ে আসেন।
এসময় সেনাবাহিনীর কয়েকজন সদস্য গুলি করতে করতে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দিকে এগোচ্ছে। আবদুর রহমান শেখ রমা বাড়ির ভেতরে ফিরে দেখেন, লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরা অবস্থাতেই বঙ্গবন্ধু নিচে অভ্যর্থনা কক্ষে নেমে এসেছেন। আ ফ ম মুহিতুল ইসলামকে বলছেন, ‘পুলিশ কন্ট্রোল রুমে লাগাতে বললাম। লাগালি না?’
আ ফ ম মুহিতুল ইসলাম জানান, তিনি চেষ্টা করেও লাইন পাচ্ছেন না। একপর্যায়ে গণভবন এক্সচেঞ্জের লাইন পাওয়া গেলেও অপর প্রান্ত থেকে কেউ কথা না বলায় বঙ্গবন্ধু নিজেই টেলিফোন হাতে নিয়ে বলেন, ‘আমি প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিব বলছি।’ কিন্তু জাতির পিতার কথা শেষ হওয়ার আগেই একঝাঁক গুলি বাড়িটির দক্ষিণ দিকের জানালার কাচ ভেঙে অফিস কক্ষের দেয়ালে বিদ্ধ হয়। এরপর অবিরত গুলি আসতেই থাকে।
বঙ্গবন্ধু পাহারারত সেনা ও পুলিশ সদস্যদের বলেন, ‘এত গুলি হচ্ছে, তোমরা কী করছ?’ এরপর দোতলায় নিজের কক্ষে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
এরপর বঙ্গবন্ধু তার মিলিটারি সেক্রেটারি কর্নেল জামিল উদ্দিনকে ফোনে বলেন, ‘জামিল, তুমি তাড়াতাড়ি আসো। আর্মির লোক আমার বাসা অ্যাটাক করেছে। সফিউল্লাহকে ফোর্স পাঠাতে বলো।’ তিনি সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল কে এম সফিউল্লাহকেও ফোন করে বলেন, ‘সফিউল্লাহ, তোমার ফোর্স আমার বাড়ি অ্যাটাক করেছে। কামালকে (শেখ কামাল) বোধ হয় মেরে ফেলেছে। তুমি জলদি ফোর্স পাঠাও।’
এসময় মেজর এ কে এম মহিউদ্দিনের নেতৃত্বে বিপথগামী সেনাসদস্যরা বঙ্গবন্ধুকে চারপাশ থেকে ঘিরে রাখে। ওই সময় মেজর বজলুল হুদা এসে ঔদ্ধত্যপূর্ণ স্বরে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা বলে। রাষ্ট্রপতিকে নিচে নেমে আসতে বাধ্য করে। বঙ্গবন্ধু সিঁড়িবারান্দার মুখে এসে দাঁড়ান। ঠিক সে সময়ই মেজর নূর চৌধুরী সিঁড়ির গোড়ায় উপস্থিত হলে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পাল্টে যায়।
একজন ঘাতক উচ্চকণ্ঠে চিৎকার করে ওঠে,‘কেন সময় নষ্ট করা হচ্ছে?’ সিঁড়ির কয়েক ধাপ নামার পরই নিচের দিক হতে সাত থেকে আট ফুট দূরে অবস্থানরত দুই ঘৃণিত ঘাতক মেজর নূর চৌধুরী ও মেজর বজলুল হুদার স্বয়ংক্রিয় স্টেনগান থেকে একের পর এক বেরিয়ে আসে ১৮টি তাজা বুলেট। সিঁড়ির ধাপে গড়িয়ে পড়েন বঙ্গবন্ধু। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটে চলে সিঁড়ি বেয়ে। এর কিছুক্ষণ পরই শহীদ হন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
তখন বিশ্বজুড়ে কি প্রতিক্রিয়া ছিল?
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর গোটা বিশ্বে নেমে এসেছিল তীব্র শোকের ছায়া। ছড়িয়ে পড়েছিল হত্যাকারীদের প্রতি ঘৃণার বিষবাষ্প। হত্যার খবর শুনে স্তম্ভিত হয়ে পড়েছিল বিশ্বসম্প্রদায়। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ২৮ আগস্ট ‘দ্য গার্ডিয়ান’ লিখেছিল, ‘১৫ আগস্টের ঘটনার ভেতর দিয়ে যেন বাংলাদেশের জনগণ আইয়ুবের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মীয় প্রচারণা এবং সামরিক শাসনের কালে প্রত্যাবর্তন করেছে।’
১৯৮২ সালের ৫ এপ্রিল টাইম ম্যাগাজিনে বলা হয়, ‘১৫ আগস্ট অভ্যুত্থান ও শেখ মুজিবের হত্যার পর গণতান্ত্রিক আমলের অবসান হয়।’ ফিন্যান্সিয়াল টাইমস্ উল্লেখ করে, ‘মুজিব না থাকলে বাংলাদেশ কখনোই জন্ম নিত না।’ পশ্চিম জার্মানির পত্রিকায় বলা হয়েছিল, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে চতুর্দশ লুইয়ের সঙ্গে তুলনা করা যায়। জনগণ তার কাছে এত জনপ্রিয় ছিল যে, লুইয়ের মতো তিনি এ দাবি করতে পারেন যে, আমিই রাষ্ট্র।’
কিউবার বিপ্লবী ফিদেল ক্যাস্ত্রো বলেছিলেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি, বঙ্গবন্ধুকে দেখেছি। শেখ মুজিবের মৃত্যুতে বিশ্বের শোষিত মানুষ হারাল তাদের একজন মহান নেতাকে, আমি হারালাম একজন অকৃত্রিম বিশাল হৃদয়ের বন্ধুকে।’ ইরাকের সাবেক প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন বলছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হচ্ছেন সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের প্রথম শহীদ। তাই তিনি অমর।’
বঙ্গবন্ধুর নিহত হওয়ার খবর শুনে মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘তোমরা আমারই দেওয়া ট্যাঙ্ক দিয়ে আমার বন্ধু মুজিবকে হত্যা করেছ! আমি নিজেই নিজেকে অভিশাপ দিচ্ছি।’ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হেনরি কিসিঞ্জার বলেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের মত তেজী এবং গতিশীল নেতা আগামী বিশ বছরের মধ্যে এশিয়া মহাদেশে আর পাওয়া যাবে না।’
সর্বশেষ খবর