জয়পুরহাটের আক্কেলপুরে নয় বছর ধরে ফ্রিতে সেহরি এবং ইফতার করাচ্ছেন রফিক হোটেলের মালিক রফিকুল ইসলাম। প্রতিদিন এক থেকে দেড়শো রোজাদার ব্যক্তি এখানে সেহরি এবং ইফতার করেন। অনেক টাকার মালিক না হলেও সারা বছর যা আয় করেন সেখান থেকে কিছু টাকা স য় করে রমজান মাস জুড়ে তিনি সেহরি ও ইফতার করান। বছরের এগারো মাস ব্যবসা করলেও রমজানের এক মাস মেহমানদারি করেন তিনি।
শুক্রবার দিবাগত রাত ৩টার দিকে রফিক হোটেলে গিয়ে দেখা যায়, সেহরি খাওয়ার ভিড় চোখে পড়ার মত আক্কেলপুরের কলেজ বাজারের কাঁচা মালপট্টিতে রফিকের হোটেলে। ভেতরে ঢুকে দেখা গেল সবাই হাতে হাতে প্লেট নিয়ে যে যার মত করে টেবিলে বসে খাবার খাচ্ছেন। তখন মালিকসহ বয়রাও ব্যস্ত সময় পার করছেন। খালি নেই কারও হাত। হোটেল জুড়ে চলছে জমজমাট সেহরিপর্ব। আবার খাবার খেয়ে টাকা না দিয়েই চলে যাচ্ছেন সবাই। টাকা না দিয়ে সেহরি খাবেন সবাই এটাই রোজার একমাস ধরে রফিক হোটেলের নিয়ম। এই নিয়মটি তিনি গত নয় বছর থেকে ধরে রেখেছেন।
হোটেলটি তেমন একটা বড় নয়। মালিকও তেমন অবস্থাশালী নয়। তিনি বছরের এগারো মাস হোটেলের খাবার বিক্রি করেন। এই আয় দিয়ে তিনি পুরো বছর সংসার চালান। পাশাপাশি রমজান মাসে জনসাধারণকে টাকা ছাড়াই সেহরি ও ইফতার খাবারের জন্য টাকা জমা করেন। প্রতি বছর রোজার শুরু থেকে শেষদিন পর্যন্ত তিনি রোজাদারদের টাকা ছাড়াই সেহরি ও ইফতারি খাওয়ান। প্রতিদিন সেহরিতে ১ শত ২০ এবং ইফতারে দেড়শ রোজাদার ব্যক্তিদের সেহরি ও ইফতারি করান রফিক।
স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, হোটেল মালিকের নাম রফিকুল ইসলাম রফিক। তিনি ভাড়া নিয়ে হোটেল ব্যবসা করেন। আক্কেলপুর পৌরশহরেই তার বসবাস। তার হোটেলের নামও রফিক হোটেল। তিন ২০১৬ সাল থেকে নয় বছর ধরে পৌর শহরে রফিক হোটেলে রমজান মাসে নিয়মিত টাকা ছাড়াই সেহরি ও ইফতার করাচ্ছেন রোজাদার জনসাধারনদের। কলেজ হাটে আসা সরকারি কর্মকর্তা, কর্মচারী, ব্যবসায়ীরা, হাসপাতালে রোগীদের সঙ্গে আসা স্বজনরা এই হোটেলে টাকা ছাড়াই নিয়মিত সেহরি ও ইফতারি খাচ্ছেন। হোটেল মালিক রফিকুল নিজে এবং তার হোটেলের কর্মচারীররা মিলে ইফতারি ও সেহরির খাবার পরিবেশন করেন। সেহরির খাবারে ছিল গরুর মাংস, মাছ, ভাজি, ডাল এবং এক গ্লাস দুধ দিয়ে সমাপ্ত হয় সেহরি পর্ব। আর ইফতারিতে থাকে মাংসের বিরিয়ানি, ছোলা বুট, বুন্দা, মুড়ি, পিঁয়াজু, বেগুনি সাথে একগ্লাস শরবত। রোজাদারেরা তৃপ্তি সহকারে সেহরি ও ইফতার করছেন। হোটেলের অভ্যন্তর ছাড়িয়ে বাহিরে হাটের জায়গায় ডেকোরেটরের কাপড় বিছিয়ে ইফতার করানো হয়।
সেহরি খেতে আসা উপজেলা মৎস্য সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মোশফেকুর রহমান বলেন, চাকুরির সুবাদে আমি এখানে একা থাকি। সারা বছর হোটেল থেকে খাবার কিনে খেতে হয়। আর রমজান মাসে সেহরি খাওয়া নিয়ে খুব চিন্তায় থাকতে হতো। রফিক আমাদের বিপদের বন্ধু। সেহরি খেয়ে টাকা দিতে চাইলেও সে কোন টাকা নেয় না। সকলকে ফ্রিতে ইফতার এবং সেহরি খাওয়ানোই তার ইচ্ছা।
পার্শ্ববতীর্ নওগাঁর বদলগাছী উপজেলার কোলাহাট এলাকার বাসিন্দা রিফাত হোসেন শাওন বলেন, হাসপাতালে রুগি নিয়ে এসেছি। রাতে সেহরি খাওয়ার জন্য হোটেল খুঁজতে এসে এই হোটেলে আসি। এখানে অনেক ভালো মানের খাবার পরিবেশন করা হয়। খাবার পরে বিল দিতে এসে জানতে জানতে পারলাম তিনি টাকা না নিয়ে সেহরি খাওয়ান। তার এই কার্যক্রমে আমাদের মতো অনেক বিপদগ্রস্ত লোকের উপকার হয়।
কথা হয় কাঁচা সবজি ব্যবসায়ী ইয়াছিন আলী সাথে, তিনি বলেন, খুব সকালে কাঁচা মাল কিনতে বাজারে আসতে হয়। প্রতি রমজান মাসে পুরোমাস বিনা পয়সায় সেহরি ও ইফতার করান রফিক। বিষয়টি আমার খুব ভাল লেগেছে। তাই আমিও মাল কিনতে এসে এখানে সেহরি খাই।
স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আলাউদ্দিন মন্ডল নামের এক কর্মচারী বলেন, আমি রাত্রিকালীন রোগীদের সেবা দিয়ে থাকি। শেষ রাতে বাসায় গিয়ে সেহরি খাওয়া কষ্টকর হয়ে পড়ে। রফিক হোটেল থাকায় বাড়ি না গিয়ে এখানেই সেহরি খাই। এখানে মাংস, ভাজি, ডিম, ডাল এবং দুধ দিয়ে সেহরি করানো হয়। এতে আমরা অনেক উপকৃত। তার জন্য দোয়া করি।
পৌর সদরের বাসিন্দা শাদমান হাফিজ বলেন, অনেক লোকের মাঝে ইফতার করতে ভাল লাগে। তাছাড়া এতে বরকত আছে। তাই আমিও ইফতার করতে এখানে এসেছি।
বগুড়ার দুপচাঁচিয়া এলাকার শামিম বলেন, ব্যাবসায়িক কাজে এখানে এসে ইফতারের সময় হওয়ায় রফিক হোটেলে গিয়ে ইফতার করেছি। আমার কাছে ইফতারির টাকা নেয়নি। আমার মতো অনেকেই ইফতার করেছেন। হোটেলের মালিক কারও কাছে টাকা নেন না।
হোটেল মালিক রফিকুল ইসলাম রফিক বলেন, রমজান মাসে খাবারের হোটেলগুলো বন্ধ থাকে। এতে ইফতারি ও সেহরির সময় রোজাদারদের অনেক কষ্ট হয়। বছরের এগারো মাস আমি হোটেল ব্যবসা করি। যা আয় হয় তার থেকে কিছু টাকা জমিয়ে রেখে রমজান মাসে সকল রোজাদারদের ইফতার করানোর চেষ্টা করি। ২০১৬ সাল থেকে এই কার্যক্রম শুরু করেছি। এ কাজে আমার হোটেলের কর্মচারীরা সহযোগিতা করে। তারাও এই মাসে কোন পারিশ্রমিক নেয় না। মূলত পরকালের মুক্তি এবং মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যেই আমি এই কাজ করি। আমি যতদিন বাঁচবো এটা যেন চালু রাখতে পারি এজন্য আপনার দোয়া করবেন।
আক্কেলপুর পৌরসভার চার নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আমিনুল ইসলাম পল্টু বলেন, জয়পুরহাট জেলার মধ্যে রফিক হোটেলের মালিক রফিকুল ইসলাম তার হোটেলে নয় বছর ধরে টাকা ছাড়াই সেহরি ও ইফতার করিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। এর মাধ্যমে বাহির এলাকা থেকে আগত রোজাদাররা অনেক উপকৃত হন। এটি একটি মহৎ কাজ। রফিক গরিব হলেও তার মন অনেক বড়।
সালাউদ্দিন/সাএ
সর্বশেষ খবর
এক্সক্লুসিভ এর সর্বশেষ খবর