
নাম আব্দুল্লাহ আল আমিন। তিনি কক্সবাজার সদরের খরুলিয়া তালিমুল কোরআন মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক। ১৯৯২ সালে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে তার বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির পাহাড়সম অভিযোগ তুলে আসছে শিক্ষার্থীরা। দুর্নীতির এই ঘটনা উপজেলা নির্বাহী অফিসারসহ জেলা প্রশাসককে লিখিতভাবে জানানো হলেও এখনও কোন ব্যবস্থা নেননি।
শিক্ষার্থীদের দাবি, প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পেয়ে আল আমিন ক্ষমতার দম্ভে ধরাকে সরা জ্ঞান করছে। মাদ্রাসার বিপুল পরিমাণ অর্থ লুটপাট, শিক্ষার্থীদের যৌন হয়রানি, কমিটি গঠনে নজিরবিহীন স্বজনপ্রীতি, পারিবারিক লাঠিয়াল বাহিনী ব্যবহার করে প্রতিষ্ঠানে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে অনিয়ম-দুর্নীতির মহা নায়ক হয়ে উঠেছেন।
তার অপসারণসহ প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ তৈরির দাবি জানিয়ে মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ ও মানববন্ধন করেছেন শিক্ষার্থীরা।
মঙ্গলবার (৮ অক্টোবর) সকাল ১০ টা থেকে দুপুর দেড়টা পর্যন্ত চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের খরুলিয়া চেয়ারম্যানপাড়া এলাকায় এ কর্মসূচি পালন করেন তারা।
এ সময় ‘জেগেছেরে জেগেছে, রক্তে আগুন জেগেছে’,‘হাসিনা গেছে যে পথে, আমিন যাবে সেই পথে’,‘এক দফা এক দাবি, সুপারের পদত্যাগ’ ইত্যাদি স্লোগান দেন শিক্ষার্থীরা। অবরোধ চলাকালে সড়কের দুইপাশে শত শত যানবাহন দাঁড়িয়ে থাকে। এতে সড়কের দুইদিকে প্রায় ৫ কিলোমিটার যানজটের সৃষ্টি হয় এবং যাত্রীরা চরম দুর্ভোগে পড়েন।
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নেওয়া যাবতীয় অর্থ লুটপাট, প্রতিষ্ঠানের জিনিসপত্র বিক্রি, নিজের স্ত্রীকে শিক্ষিকা বানিয়ে অনুপস্থিত থেকে বেতন উত্তোলন, নৈশ প্রহরীর বেতন আত্মসাৎ, আপন বোনকে আয়া পদে নিয়োগ দিয়ে দায়িত্ব পালন না করে বেতন উত্তোলন, যথাসময়ে অডিট না করা এবং মা-ভাইসহ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ম্যানেজিং কমিটি গঠনে স্বেচ্ছাচারিতা ও বিতর্কিত নানা সিদ্ধান্তের কারণে মাদ্রাসাটি এখন অনিয়ম আর দুর্নীতির স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে।
এসময় শিক্ষার্থীরা বলেন, শেখ রাসেল স্মৃতি ল্যাবের জন্য সরকার থেকে দেওয়া ১৩ টি ল্যাপটপ বিক্রি করে দিয়েছেন তিনি। প্রধান শিক্ষক আল আমিন টেন্ডার ছাড়াই প্রতিষ্ঠানের সবকিছু বিক্রি করে যাবতীয় টাকা আত্মসাৎ করে যাচ্ছেন। ফরম পূরণ ও রেজিস্ট্রেশনে সরকারের বেধে দেওয়া টাকার কয়েকগুণ বেশি টাকা নেন। নিয়োগ বাণিজ্য করে লাখ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ করেন তারা। গরমে কষ্ট হলেও শ্রেণিকক্ষে ফ্যান চালাতে দেন না। শিক্ষার বিষয়ে ঠিকমতো তদারকি করেন না। এমনকি এত বড় প্রতিষ্ঠানের কোন কোনো কক্ষে ফ্যান পর্যন্ত নেই। প্রতিবাদ করতে গেলে উলটো হুমকি-ধামকি দেন প্রধান শিক্ষকসহ তার লাঠিয়াল ভাইয়েরা।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা জানান, প্রধান শিক্ষক কৌশল পরিবর্তন করে স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে প্রতিষ্ঠানের কয়েকজন শিক্ষকসহ সিন্ডিকেট করে নানা অনিয়ম-দুর্নীতি শুরু করেন। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ফি আদায়, বিনা রশিদে অর্থ আদায়, ভুয়া বিল করে টাকা আত্মসাৎ, কোচিং বাণিজ্য, উপবৃত্তির শিক্ষার্থী নির্বাচনে অনিয়মসহ নানা অনিয়ম-দুর্নীতি করছেন যুগ যুগ ধরে। এমনকি মাদ্রাসাটির শিক্ষার মান তলানিতে গিয়ে ঠেকলে ছাত্রছাত্রী ও এলাকাবাসী প্রধান শিক্ষক আমিনের পদত্যাগসহ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়ে আসছিলো। কিন্তু জেলা শিক্ষা অফিসার নাছির উদ্দিনের নিকটতম আত্মীয় হওয়ায় তার ছত্রছায়ায় প্রধান শিক্ষক নির্বিঘ্নে নিজের অপকর্ম চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পায় বলে দাবি করেন তারা।
শিক্ষার্থীরা বলেন, প্রধান শিক্ষক পদত্যাগ চেয়ে আন্দোলন করলে উলটো তার ভাইদের দিয়ে হুমকি-ধামকি ও নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে আমাদের। মাদ্রাসাটিতে সুপারের একক আধিপত্য। তার কথাই যেন শেষ কথা। তার আঙ্গুলের ইশারায় হয় সকল কাজ। প্রভাব এবং আধিপত্যের জোরে তটস্থ রাখে তার অধীনস্থ সবাইকে। ১৯৯২ সালে দায়িত্ব গ্রহণের পর কেলেঙ্কারিতে জড়িয়েছে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানটি। অনিয়ম, দুর্নীতি আর ক্ষমতার অপব্যবহার মিলিয়ে আল আমিন নিজের শক্তি প্রদর্শনের মাধ্যমে চলেন সব সময়। দায়িত্বে থাকা সুপার তার মাথায় ঘুরপাক খেতো মাদ্রাসার কাজ কার। তিনি যে রক্ষার দায়িত্বে রয়েছেন সেটা যেন ভুলেই গেছেন। রাজনৈতিক বিবেচনায় তিনি যেন দুর্নীতির বরপুত্র হয়ে উঠেছেন।
শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করে আরও বলেন, সম্প্রতি আল আমিনের অপসারণ চেয়ে শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ করলে তার এইসব অভিযোগ আমলে নিয়ে তদন্ত শুরু করে প্রশাসন। তদন্তে তার অনিয়ম দুর্নীতির প্রমাণ পেলেও রহস্যজনক কারণে এখন পর্যন্ত কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এ কারণে বাধ্য হয়ে আবার মাঠে নেমেছি।
বক্তব্যে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বলেন, আল আমিন নিজের স্ত্রীসহ পরিবারের ৭ জনকে মাদ্রাসাটিতে চাকরি দেন এবং পরিবারের লোকজনকে দিয়ে পরিচালনা পষদ গঠন করে একটি লাঠিয়াল বাহিনী তৈরি করে মাদ্রাসাটির চার পাশে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম কারেন। প্রধান শিক্ষক আব্দুল্লাহ আল আমিনের স্ত্রী জুলেখা বিনতে নাসিম মাদ্রাসার একজন এমপিওভুক্ত শিক্ষিকা। ২০০৮ সাল থেকে ক্লাসে তিনি অনুপস্থিত থেকেও নিয়মিত বেতন উত্তোলন করছেন। তার বোন জান্নাতুল মাওয়া এ্যামি একজন উচ্চ শিক্ষিত মহিলা। তাকে সামান্য আয়া পদে নিয়োগ দিয়েছেন সুপার আল আমিন। অথচ তিনি কোন প্রকার দায়িত্ব পালন না করে বেতন নিচ্ছেন হর হামেশাই।
তারা আরও বলেন, আল আমিন এবং তার অপরাপর অনুগত শিক্ষকদের পরস্পরের যোগসাজশে, স্থানীয় প্রভাব খাটিয়ে আত্মীয়-স্বজনদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতায় নানা অজুহাতে তিন যুগ ধরে মাদ্রাসাটির বিপুল সংখ্যক অর্থ হাতিয়েছেন। করোনাকালীন সময়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জন্য সরকার থেকে দেওয়া ৫ লক্ষ টাকা তিনি একাই মেরে দিয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন। এছাড়া ফরম ফিলাপের সময় বিভিন্ন স্তরভেদে শিক্ষার্থীদের টাকা দিতে হবে বলে বাধ্যতামূলক নির্দেশনা জারি করেন আল আমিন সিন্ডিকেট। এভাবে গত ৩১ বছরে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ভিন্ন ভিন্ন সংখ্যায় প্রায় কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেন বলে দাবি করেছেন ভুক্তভোগী শিক্ষর্থীরা।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের মধ্যে ইসমাইল, মুসলিম, আরিফ, হাসান, জিহাদসহ কয়েকজন বলেন, অতিরিক্ত ফি আদায়, ভর্তি বাণিজ্য, ভুয়া প্রকল্প বানিয়ে লাখ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে সুপারের বিরুদ্ধে। আমরা দুর্নীতিমুক্ত মাদ্রাসা চাই।
তারা আরও বলেন, বিগত কয়েকদিন আগেও প্রধান শিক্ষক আল আমিনের পদত্যাগ চেয়ে অবরোধসহ প্রশাসনকে লিখিত অভিযোগ দিয়েছি। তার অনিয়ম দুর্নীতির খবর বিভিন্ন প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক ও অনলাইনের গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে। এসব অনিয়মের তদন্তও করেছে। কিন্তু জানতে পেরেছি রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে এবং তদন্ত কমিটির লোকজনকে মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে এসব দুর্নীতি ধামাচাপা দেওয়া হয়েছে। আমরা অবাক হই, এত কিছুর পরে তিনি এই পদে বহাল আছেন।
সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নিলুফা ইয়াসমিন চৌধুরী বলেন, তাকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করে সহকারী প্রধান মঈন উদ্দিনকে ভারপ্রাপ্ত প্রধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তাকে আজ বিকেলের মধ্যে পদত্যাগ করতে বলা হয়েছে। অন্যথায় আমরা তার স্থায়ী বহিষ্কারের জন্য সুপারিশ করে মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠাবো।
শাকিল/সাএ
সর্বশেষ খবর
জেলার খবর এর সর্বশেষ খবর