বিশ্বের বিভিন্ন শহরে বায়ুদূষণের মাত্রা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এর মধ্যে ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার বেশ কিছু বড় শহর বিশেষভাবে আক্রান্ত। এমন পরিস্থিতিতে ঢাকার বায়ুদূষণও উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে, যা নাগরিকদের জন্য শ্বাসকষ্টসহ নানা স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করছে। বর্তমানে ঢাকার বায়ুমান সূচক (এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স বা একিউআই) এমন অবস্থায় পৌঁছেছে, যা 'অস্বাস্থ্যকর' হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
ঢাকার বায়ু দূষণের বর্তমান অবস্থা
আজ, ৯ জানুয়ারি, ২০২৫, বৃহস্পতিবার সকালে ঢাকার একিউআই স্কোর ছিল ১৮৬, যা বিশ্বের দূষিত শহরগুলোর তালিকায় ঢাকাকে পঞ্চম অবস্থানে রাখে। এটি 'অস্বাস্থ্যকর' বায়ু হিসেবে বিবেচিত হয়। এ সময় দিল্লির একিউআই স্কোর ছিল ৩১২, যা 'ঝুঁকিপূর্ণ' হিসেবে চিহ্নিত। পাকিস্তানের লাহোর শহরও বায়ুদূষণের কারণে একই ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি। এতে করে ঢাকার অবস্থান আরও কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে, কারণ বায়ু দূষণের মাত্রা জনস্বাস্থ্যের জন্য গুরুতর হুমকি সৃষ্টি করছে।
বিশ্বব্যাপী দূষণের সূচকে ঢাকার অবস্থান কখনও ১, ২ বা ৩ নম্বরে ওঠে, যা এই শহরের ভয়াবহ বায়ু দূষণের মাত্রাকে প্রতিফলিত করে। বিশেষত শীতকালীন মৌসুমে দূষণের মাত্রা সবচেয়ে বেশি বেড়ে যায়। ধোঁয়া, ধূলিকণা এবং যানবাহনের নির্গত ক্ষতিকর গ্যাসের কারণে শহরের বাতাসে একাধিক বিষাক্ত উপাদান মিশে যায়, যা নাগরিকদের শ্বাসতন্ত্রে প্রবেশ করে এবং বিভিন্ন রোগের সৃষ্টি করতে পারে।
বায়ুদূষণ কি শুধুই একটি পরিবেশগত সমস্যা?
বায়ুদূষণ শুধু পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর নয়, এটি স রাসরি মানুষের স্বাস্থ্যেও মারাত্মক প্রভাব ফেলে। বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, দীর্ঘসময় ধরে বায়ুদূষণের শিকার হওয়া মানুষের মধ্যে শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি, অ্যালার্জি, হৃদরোগ এবং ক্যান্সারের মতো নানা ধরনের রোগের প্রবণতা বাড়তে পারে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েন শিশু, প্রবীণ, অসুস্থ ব্যক্তিরা এবং গর্ভবতী মহিলারা। বায়ুদূষণ শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণের কারণ হয়ে দাঁড়ায়, যা শিশুদের ক্ষেত্রে আরও ভয়াবহ হতে পারে। এছাড়া, নিয়মিত দূষিত বাতাসে শ্বাস নেওয়া মানুষের মধ্যে স্নায়ু ও মস্তিষ্কের বিভিন্ন সমস্যা তৈরি করতে পারে, যা ভবিষ্যতে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।
ঢাকার মতো বড় শহরে যেখানে জনসংখ্যা প্রচুর, সেখানে বায়ুদূষণের প্রভাব খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। একদিকে যেমন পরিবহন, শিল্প, নির্মাণ কাজ, অন্যদিকে গৃহস্থালি বর্জ্য, সিগারেটের ধোঁয়া এবং অন্যান্য ক্ষতিকর উপাদান বাতাসে মিশে দূষণের মাত্রা বাড়িয়ে তোলে। বিশেষ করে শীতকালে বাতাসের গতিশীলতা কমে যাওয়ার কারণে এই দূষিত উপাদান বাতাসে দীর্ঘ সময় ধরে স্থিতিশীল থাকে, ফলে দূষণ বেড়ে যায়।
একিউআই স্কোর এবং তার প্রভাব
একিউআই স্কোরের মান অনুযায়ী, বায়ু দূষণের বিভিন্ন স্তরের উপাদান এবং তার প্রভাব জানা যায়:
০-৫০ স্কোর: ভাল – এই অবস্থায় বায়ু নিরাপদ এবং মানুষের জন্য কোন ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি থাকে না।
৫১-১০০ স্কোর: মাঝারি – কিছু সংখ্যক সংবেদনশীল গোষ্ঠী যেমন শিশুরা, বৃদ্ধরা এবং কিছু রোগী এই অবস্থায় সমস্যা অনুভব করতে পারে।
১০১-১৫০ স্কোর: অস্বাস্থ্যকর – সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য অস্বাস্থ্যকর।
১৫১-২০০ স্কোর: অস্বাস্থ্যকর – এই অবস্থায় সাধারণ মানুষের জন্যও ক্ষতিকর।
২০১-৩০০ স্কোর: খুব অস্বাস্থ্যকর – শিশু, প্রবীণ এবং অসুস্থদের জন্য এই স্কোরের বায়ু শ্বাস নেওয়া বিপজ্জনক। সাধারণ মানুষের জন্যও স্বাস্থ্য ঝুঁকি রয়েছে।
৩০১-৪০০ স্কোর: ঝুঁকিপূর্ণ – এই অবস্থায় বায়ু অতিমাত্রায় ক্ষতিকর এবং নাগরিকদের বাড়ির মধ্যে অবস্থান করা উচিত।
আজকের (৯ জানুয়ারি) স্কোর ১৮৬ হওয়ায় ঢাকার বাতাস 'অস্বাস্থ্যকর' অবস্থায় রয়েছে, যা শ্বাসতন্ত্রের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি সৃষ্টি করছে। বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিচ্ছেন, শিশুরা, প্রবীণরা এবং যেসব ব্যক্তি শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যায় ভুগছেন, তাদের বাইরে যাওয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত।
ঢাকায় বায়ুদূষণের কারণ
ঢাকায় বায়ুদূষণের প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে:
যানবাহন: ঢাকায় যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে প্রতিদিন প্রচুর পরিমাণে কার্বন মনোক্সাইড এবং নাইট্রোজেন অক্সাইড বাতাসে মিশে দূষণ সৃষ্টি হচ্ছে।
নির্মাণ কাজ: রাজধানীতে বহুতল ভবন নির্মাণের জন্য বিপুল পরিমাণ ধুলাবালি বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে। এই ধুলাবালি শ্বাসের সঙ্গে মানুষের শরীরে প্রবেশ করছে এবং নানা ধরনের শ্বাসকষ্টের সমস্যা তৈরি করছে।
বর্জ্য এবং ফসল পোড়ানো: নগরীজুড়ে অনেক স্থানে বিভিন্ন ধরনের বর্জ্য পোড়ানো হয়, যা বাতাসে বিষাক্ত গ্যাস এবং ক্ষতিকর কণা তৈরি করে।
শিল্পকারখানা: ঢাকায় অবস্থিত অনেক শিল্পকারখানা থেকে নির্গত ধোঁয়া ও গ্যাস দূষণের পরিমাণ আরও বাড়িয়ে তোলে।
ঢাকায় বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে কি পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে?
ঢাকা শহরের বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে সরকার এবং পরিবেশ অধিদপ্তর বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, তবে তা যথেষ্ট নয়। এর মধ্যে রাস্তা পরিষ্কারকরণ, যানবাহনের পরিশোধিত নির্গমন ব্যবস্থা, শিল্পকারখানার নির্গমন কন্ট্রোল এবং গাছপালা রোপণের মতো পদক্ষেপ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। তবে, এসব পদক্ষেপ আরও শক্তিশালী ও দ্রুত কার্যকর করার প্রয়োজন রয়েছে। বিশেষ করে, যানবাহনের নিবন্ধন ব্যবস্থা কঠোর করা, পুরনো এবং বেশি দূষিত গাড়ি চলাচল সীমিত করা, এবং নির্মাণ কাজের সময় ধুলা নিয়ন্ত্রণে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি।
নাগরিকদের সচেতনতা বৃদ্ধি
ঢাকার বায়ুদূষণ পরিস্থিতি মোকাবেলায় নাগরিকদের সচেতনতা বৃদ্ধি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বায়ুদূষণের খারাপ প্রভাব থেকে রক্ষা পেতে সবাইকে সচেতন হওয়া উচিত। বিশেষত, বাইরের কাজ বা চলাচলের সময় মাস্ক ব্যবহার করা, গাড়ির পরিস্কার এবং পরিবহন ব্যবস্থার উন্নতি করতে উদ্যোগ নেওয়া, এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে পরিচালনা করা নাগরিকদের দায়িত্ব।
ভবিষ্যত পরিকল্পনা
ঢাকার বায়ুদূষণ পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে যদি কার্যকরী পদক্ষেপ না নেওয়া হয়। প্রশাসন এবং নাগরিকদের একযোগে কাজ করতে হবে, যাতে ঢাকার বায়ু আরও দূষিত না হয়ে যায় এবং স্বাস্থ্যঝুঁকি কমানো যায়। এ জন্য শক্তিশালী নীতি এবং নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা তৈরি করা, গাড়ি ও শিল্পখাত থেকে দূষণ কমানো এবং সবশেষে সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা জরুরি।
সার্বিকভাবে, ঢাকার বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া না হলে, এটি আগামীতে শহরের বাসিন্দাদের স্বাস্থ্য ও জীবনযাত্রার উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলবে।
সর্বশেষ খবর
স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা এর সর্বশেষ খবর