
শ্বাসরুদ্ধকর, অকল্পনীয় এবং সম্ভবত চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ইতিহাসে অন্যতম অবিস্মরণীয় সেমিফাইনাল ম্যাচ। যার পরতে পরতে ছিল রোমাঞ্চ, টানটান উত্তেজনা আর দু'পক্ষেরই শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত হার না মানা লড়াই।
সেই লড়াইয়ে জয় হয়েছে ইতালিয়ান ক্লাব ইন্টার মিলানের। সফরকারী বার্সেলোনা অনেকাংশে এগিয়ে থেকেও ফাইনাল থেকে এক কদম দূরেই তাদের থামতে হচ্ছে। ৪-৩ গোলে তাদের বিদায় করল সিমোন ইনজাঘির দল।
ঘরের মাঠ সান সিরোতে আজ (মঙ্গলবার) সেমিফাইনালের ফিরতি লেগ খেলতে নেমে প্রথমার্ধেই দ্বিগুণ লিড নিয়েছিল ইন্টার। সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বার্সা দ্বিতীয়ার্ধে তিন গোল করে লিড নেয়। লড়াই জমিয়ে তুলে ইন্টার মিলান ফের গোল করে যোগ করা সময়ে। ৩-৩ সমতার পর খেলা অতিরিক্ত সময়ে গড়ায়। ৯৯ মিনিটে শেষ পেরেকঠোকা গোল আসে মিলানের পক্ষে।
এ নিয়ে সর্বশেষ তিন মৌসুমে দ্বিতীয়বার ইউসিএলের ফাইনালে উঠল ইন্টার। ইনজাঘির অধীনেই তারা দু'বার ইউরোপীয় সর্বোচ্চ প্রতিযোগিতাটির চূড়ান্ত মঞ্চে পা রাখল। টিকিট কাটল ১ জুন হতে যাওয়া মিউনিখের শিরোপানির্ধারণী রাতের। বিপরীতে ২০১৪-১৫ মৌসুমের পর এবার দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান ঘটানোর স্বপ্ন ছিল হ্যান্সি ফ্লিকের শিষ্যদের। কিন্তু তাদের অপেক্ষার পারদ আরও বাড়িয়ে হতাশা নিয়েই ফিরতে হচ্ছে। এর আগে দুই দলের প্রথম লেগ ছিল ৩-৩ সমতায়। ফিরতি লেগ শেষে যা দাঁড়াল ৭-৬ ব্যবধানে
যদিও ম্যাচের শুরুতে স্বাগতিক ইন্টার মিলানের গতি ছিল কিছুটা ধীরস্থির। সুযোগটি ভালোভাবেই নেয় বার্সা। হ্যান্সি ফ্লিকের শিষ্যরা বলের নিয়ন্ত্রণ নেয় পুরোপুরি। যদিও তারা ঠিকঠাক গোলের লক্ষ্যে শট নিতে পারছিল না। মিলানের ডিফেন্ডার ফেদেরিকো ডিমার্কো'র কড়া মার্কিংয়ে ছিলেন লামিনে ইয়ামাল। তবুও মানবপ্রাচীর এড়িয়ে স্বভাবসুলভ কারিকুরিতে প্রথমার্ধে বেশ কয়েকবারই তিনি হানা দেন মিলানের রক্ষণে। তবে প্রতিপক্ষ ডিফেন্ডাররা মোটেও তাকে শট নেওয়ার সুযোগ দেননি।
ব্লু-গানাদের একপেশে প্রদর্শনীর মাঝেই ২১ মিনিটে লাউতারো মার্টিনেজের গোলে এগিয়ে যায় ইন্টার। মূলত বার্সা ফুটবলারদের বল দেওয়া-নেওয়ায় ধীরগতির কারণে স্বাগতিকরা সুযোগ পেয়ে যায়। বল কেড়ে নিয়ে অনেকটা দূর এগিয়ে বক্সে ঢুকে লাউতারোকে বল বাড়ান ডেনজেল ডামপ্রিস । বার্সা গোলরক্ষক তার দিকে আগুয়ান থাকায় বাঁয়ে আর্জেন্টাইন ফরোয়ার্ডের জন্য ফাঁকা জায়গা তৈরি হয়ে যায়। তড়িৎ শটে সেই সুযোগ হাতছাড়া করলেন না লাউতারো। ১-০ গোলে এগিয়ে ফেটে পড়ে পুরো সান সিরোর গ্যালারি।
৪২ মিনিটে লাউতারোকে বক্সে ফাউল করে বসেন পাউ কুবারসি, যদিও তার লক্ষ্যবস্তুটা ছিল বলে। কিন্তু তার আগেই মিলান ফরোয়ার্ডের ডানপায়ে আঘাত পড়ে বার্সা ডিফেন্ডারের। ভিএআর দেখে পেনাল্টি দেন রেফারি সাইমন মারসিনিয়াক। স্পট কিকের সময় গোলরক্ষক ভয়চেক সিজনি বাঁয়ে ধাবিত হন, কিন্তু কালানগ্লু শট নেন ডান বারে। বল জালে জড়াতেই ব্যবধান বাড়ে মিলানের। ২-০ (অ্যাগ্রিগেটে ৫-৩) গোলে পিছিয়ে থেকেই বিরতিতে যায় কাতালানরা।
দ্বিতীয়ার্ধেও বলের পজেশন ধরে রেখে ম্যাচে ফিরতে মরিয়া হয়ে ওঠে বার্সেলোনা। ৫৪ মিনিটে দলগতভাবে আক্রমণের ধার বাড়িয়ে বাঁ প্রান্ত থেকে ক্রস নেন জেরার্ড মার্টিন। বক্সের মাঝামাঝিতে কিছুটা এগিয়ে এক স্পর্শে জালে জড়ান এরিক গার্সিয়া। ২-১ এ ব্যবধান কমিয়ে মুহূর্তেই বার্সা পুরো মোমেন্টাম কেড়ে নেয়। এরপর সমতায় ফিরতে তারা সময় নেয় মাত্র ৬ মিনিট। ৬০ মিনিটে মার্টিনের আরেকটি ক্রসে হেড দিয়ে এবারের গোলটি করেন দানি অলমো। স্কোরবোর্ড তখন ২-২, অ্যাগ্রিগেট ৫-৫।
সমতা ফিরলেও ম্যাচের লাগাম পুরোপুরি বার্সার হাতে চলে যায়। আর ইন্টার মিলান হয়ে পড়ে ছন্নছাড়া। কিছুক্ষণ বাদে উভয় দলই কয়েকটি পরিবর্তন আনে ম্যাচে। তবে ইন্টারের ছন্দ ফিরছিল না কিছুতেই। ৮০ মিনিটের আগে মিনিট দুয়েকের মধ্যে দুই দফায় তাদের রক্ষণ ভেদ করে শট নেন ইয়ামাল। প্রথমটি ছিল দুর্দান্ত, বক্সের বাইরে থেকে বাঁকানো, পরেরটি বক্সে ঢুকে কয়েকজন ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে। দু'বারই গোলরক্ষক ইয়ান সোমার তাকে পরাস্ত করেছেন।
নির্ধারিত সময় শেষ হতে হতে মনে হচ্ছিল খেলা বুঝি অতিরিক্ত সময়ে গড়াবে। কিন্তু সেই সম্ভাবনায় জল ঢেলে ফল নির্ধারণী গোল করে বসলেন রাফিনিয়া। ফ্লিকে আজকের ম্যাচে তাকে সেন্টার ফরোয়ার্ডে খেলিয়েছেন। তাই বাম প্রান্তে সেভাবে তার বলের টান চোখে পড়েনি। তবে দারুণ ফর্মে থাকা এই ব্রাজিলিয়ান গোল না পেলে যে পূর্ণতা আসে না। প্রথমে তার জোরালো শট আটকান সোমার, ফিরতি বল পেয়ে দ্বিতীয় বারে শট নিয়ে সফল রাফা। ইউসিএলের চলতি মৌসুমে এটি তার যৌথভাবে সর্বোচ্চ ১৩তম গোল।
খানিক বাদেই যোগ করা সময়ের দ্বিতীয় মিনিটে ইয়ামালের জোরালো শট বারে লেগে ফেরে। তবে নাটকীয়তার শুরু এরপর, শেষ বাঁশি বাজানোর দুই মিনিট আগে বার্সা রক্ষণের দুর্বলতার সুযোগে তাদের বক্সে ডামপ্রিস কাটব্যাক করেন ফ্রান্সিসকো অ্যাকারবিকে। তার স্লাইড ঠেকাতে পারেননি গোলরক্ষক সিজনি। ৩-৩ সমতায় ফেরে ইন্টার। আর ৬-৬ অ্যাগ্রিগেটে ম্যাচ গড়ায় অতিরিক্ত ৩০ মিনিটে।
৯৯ মিনিটে এবার লিড নিলো ইন্টার। বার্সার অর্ধে মার্কাস থুরাম ও মেহদি তারেমি হয়ে বল পান ডেভিড ফ্রাত্তেসি। সিজনিকে দর্শক বানিয়ে তিনি কয়েকজনের মাঝখান দিয়ে দূরের পোস্টে জালে ঠিকানা খুঁজে নেন। ইন্টার ৪-৩ ও ৭-৬ অ্যাগ্রিগেটে এগিয়ে যায়। এরপর মুহুমুর্হু আক্রমণ শাণিয়েছেন লেভানডফস্কি-ইয়ামালরা।
বারবারই তাদের ব্যর্থ করে দিয়েছেন ইন্টার গোলরক্ষক সোমার। ম্যাচজুড়ে স্বাগতিকদের গোলবারের ত্রাণকর্তা হয়ে থাকা এই তারকার হাতেই উঠেছে ম্যাচসেরার পুরস্কার।
মুনতাসির/সাএ
সর্বশেষ খবর