
সাতক্ষীরার শ্যামনগরে আদিবাসীদের জাতীয় পর্যায়ের গণমাধ্যম আইপিনিউজ এর আয়োজনে এবং আর্টিকেল-১৯, ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন ও ফ্রি প্রেস আনলিমিটেড এর সহায়তায় "সুন্দরবন অঞ্চলের আদিবাসীদের মানবাধিকার পরিস্থিতি ও আদিবাসী গণমাধ্যম এর ভূমিকা" শীর্ষক একটি মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়৷
বৃহস্পতিবার (১৫ই মে) উপজেলার সুন্দরবন আদিবাসী মুন্ডা সংস্থা (সামস্) এর কনফারেন্স রুমে অনুষ্ঠিত মতবিনিময় সভায় নির্ধারিত আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সুন্দরবন আদিবাসী মুন্ডা সংস্থার সভাপতি ও স্থানীয় মুন্ডা নেতা গোপাল মুন্ডা, স্থানীয় মুন্ডা নারী নেত্রী ও শ্রীফলকাটি গ্রামের পাসমোড়ল সঞ্জলী মুন্ডা, মানবাধিকার কর্মী ত্রিজিনাদ চাকমা, সুন্দরবন প্রেসক্লাবের
সভাপতি বিলাল হোসেন, সাধারণ সম্পাদক জিএম মাছুম বিল্লাহ, পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের ঢাকা মহানগরের সভাপতি জগদীশ চাকমা, সামস্ এর প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর রাম প্রসাদ মুন্ডা প্রমুখ। উক্ত মতবিনিময় সভায় মডারেটর হিসেবে ছিলেন আইপিনিউজ এর নির্বাহী সম্পাদক সতেজ চাকমা।
মতবিনিময় সভার শুরুতে আইপিনিউজ এর যুগ্ম সম্পাদক অমর শান্তি চাকমা বলেন, আদিবাসীরা ঐতিহাসিক কাল ধরে নিজেদের অধিকার থেকে বঞ্চিত । ক্রমাগত তাঁদের অধিকারগুলো সংকুচিত হচ্ছে। ফলে তারা প্রতিনিয়ত মানবাধিকার লঙ্ঘন থেকে শুরু করে নানা ধরনের ঘটনার সম্মুখীন। আমরা জানি যে পাহাড় ব্যতীত সমতলেও বহু আদিবাসী জনগোষ্ঠী বাস করে৷ তার মধ্যে সুন্দরবন অঞ্চলে মুন্ডা আদিবাসীদের বসবাস। মূলত এ অঞ্চলের আদিবাসীদের মানবাধিকার পরিস্থিতি জানা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যে-সব ঝুঁকির মধ্যে তারা থাকা সেসব বিষয়গুলো নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে উঠিয়ে নিয়ে আসার জন্যই আমাদের এই আয়োজন। সেই সাথে আদিবাসী গণমাধ্যম হিসেবে আইপিনিউজ এর ভূমিকা নিয়ে জানানো এবং কীভাবে আইপিনিউজ ও এ অঞ্চলের আদিবাসীদের মধ্যে ঘনিষ্ঠটা বাড়বে সেটা নিয়েও আমরা কথা বলতে পারি৷
নারী নেত্রী সঞ্জলী মুন্ডা বলেন, আমাদের এ অঞ্চলের আদিবাসীদের প্রধান সমস্যা ভূমি ও জলবায়ু পরিবর্তন কেন্দ্রিক । এ অঞ্চলের তাপমাত্রা আগের চেয়ে অনেক বেশী বেড়েছে। তাছাড়া আমাদের আমাদের মুন্ডা সমাজে বাল্য বিবাহের হার অনেক বেশী। আমাদের আয়ের উৎসও কমে যাচ্ছে এবং নানা ঝামেলা মিমাংসার জন্য ইউনিয়ন চেয়ারম্যান কিংবা মেম্বারের কাছে গেলে আমরা ন্যায্য বিচার পাই না৷ অনেক সময় বিধবা ভাতা, বয়স্ক ভাতা দাবী করলে তারা আমাদের থেকে টাকা চাওয়া হয়৷ আমাদের যদি টাকাই থাকতো তবে কেন ভাতা চাইবো আমরা। আর এসব অন্যায় যদি না বলি, চুপ থাকি এসব আরো বাড়বে বৈ কমবে না। তাই আমাদেরকে এসব বলতে হবে।
জগদীশ চাকমা বলেন, বাংলাদেশে পাহাড় ও সমতলে ৫৪ টি'র অধিক আদিবাসী জনগোষ্ঠী বাস করে। কোথাও আদিবাসীরা ভালো অবস্থানে নেই। এ না থাকার অন্যতম কারণ হল- নিজেদের আত্মপরিচয়ের স্বীকৃতি না থাকা। স্বাধীনতার পরপরই আমাদের মহান নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা আদিবাসীদের পরিচয়ের স্বীকৃতি চেয়েছিলেন। কিন্তু দেয়া হয়নি। এতে আমরা পাহাড়ে তাঁর নেতৃত্বে লড়াই সংগ্রাম পরিচালনা করেছি৷ ফলে ১৯৯৭ সালে একটি চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে কিন্তু বিগত ২৭ বছরেও এই চুক্তি বাস্তবায়ন হয়নি। তাই এখনো আদিবাসীরা নানাভাবে নিপীড়িত হচ্ছে, আমাদের নারীরা ধর্ষণ, হত্যা ও নানা নিষ্পেষণের শিকার হচ্ছে। কাজেই সব জায়গায় আদিবাসীদের চিত্র একই। তাই পাহাড় এবং সমতলে আদিবাসীদের ঐক্যবদ্ধ লড়াই সংঘটিত করা ছাড়া বিকল্প নেই।
রামপ্রসাদ মুন্ডা বলেন, আদিবাসীদের আত্মপরিচয়ের অধিকার-মানবাধিকার। আমরা যখন আদিবাসী হিসেবে দাবি করি তখন আমাদেরকে থামিয়ে দেয়া হয় ৷ এটাও একটা মানবাধিকার লঙ্ঘন। বিগত সরকার আদিবাসী শব্দটি বিভিন্ন জায়গায় ব্যবহার না করার জন্য নির্দেশনা দিয়েছিল। এটাও আমাদের মত প্রকাশের স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ। এ ধরনের ঘটনাগুলো গণমাধ্যমে উঠিয়ে আসতে হবে। আমরা খুবই আনন্দিত যে আইপিনিউজ আদিবাসীদের একমাত্র গণমাধ্যম হিসেবে আমাদের খোঁজ নিতে হবে। তবে আমাদের কথাগুলো আমাদেরকেই বলতে হবে। তার জন্য আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্য থেকেই সাংবাদিক বের করতে হবে। এজন্য তরুণ ও আগ্রহী প্রতিভাবানদেরকে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার জন্য আইপিনিউজকে অনুরোধ জানায়৷
সুন্দরবন প্রেসক্লাবের সভাপতি বিলাল হোসেন বলেন, আমার ভালো লাগছে- আইপিনিউজ নামে আদিবাসীদের নিজস্ব একটি গণমাধ্যম আছে। নিজেদের কথা নিজেরাই বলছে। এটা আমাদের জন্য অনেক আনন্দের একটি সংবাদ। কিন্তু আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি আদিবাসীরা নিজেদের কথাগুলো বলতে ভয় পায়। আমরা অনেক সময় যে তথ্যগুলো চাই সেগুলো পাই না৷ আদিবাসীরা নিজেদের বেদনার কথাগুলো বলতে ভয় পান কিংবা চেপে রেখে দেন। এমন হলে তো আমরা লিখতে পারবো না৷ কাজেই আপনাদেরকে বলতে হবে। আমি আরো একটা কথা বলি- আমরা প্রায়শ: বলে থাকি জলব্য়ু পরিবর্তন হচ্ছে এবং এ কারণে এ অঞ্চলের মানুষ ক্ষদিগ্রস্থ হচ্ছে৷ এসব বলে বলে যে ক'টি এনজিও চালু আছে তাতে অবস্থার তো উন্নতি হয়না৷ বরং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে যে ক্ষতি হচ্ছে তা ক্রমশ খারাপের দিকে যাচ্ছে৷
সুন্দরবন প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক জিএম মাছুম বিল্লাহ বলেন, আমি যদি ইতিহাসের দিকে তাকাই তবে দেখি- মুন্ডাদের আগের অবস্থা অনেক শোষণীয় ছিল। যখন মুন্ডারা আগে বাঙালিদের উঠান ধরে দা কোদাল দিয়ে যাইত তখন গ্রামের মানুষ "কুলি" বলে হেয় করত। কিন্তু এখন তাদের শিক্ষার হার বেড়েছে এবং অনেকটা ভালো পজিশনে আছে। এখন তারা নিজেদের ভয়েস রেইজ করছে। কিছুটা হলেও তাদের অবস্থান উন্নতি হয়েছে। আমি আশা করি তারাও একদিন অধিকার পাবে এবং একদিন তারা এই সুন্দরবনের জঙ্গল সাফ করে এই অঞ্চলকে মানুষের জন্য বাসযোগ্য করেছেন তাই তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা দরকার আমাদের।
মানবাধিকার কর্মী ত্রিজিনাদ চাকমা বলেন, আমরা যে রাষ্ট্রে বাস করছি সে রাষ্ট্র যদি সত্যিকার অর্থে যদি গণতান্ত্রিক,গণমুখী ও প্রগতিশীল হত তবে আমাদেরকে এত অধিকার নিয়ে কথা বলতে হত না৷ রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে নাগরিকদের মানবাধিকার রক্ষা করা৷ কিন্তু আমাদের রাষ্ট্র সেটা রক্ষা করতে ব্যর্থ। সেজন্যই আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীরা লড়াই করছি। আইপিনিউজ এর মাধ্যমে আমাদের কথাগুলো তুলে ধরছি- এটাও আমাদের লড়াইয়ের একটি অংশ। আমাদের উপর যে শোষণ, নিপীড়ন অব্যাহত রয়েছে সেসব থেকে উত্তোরণের জন্য এসব কথা বলতে হবে। অধিকার কেউ কাউকে দেয় না। সংগ্রাম করেই অধিকার আদায় করে নিতে হবে।
সামস এর সভাপতি গোপাল মুন্ডা বলেন, আমরা জানি যে আইপিনিউজ আমাদের আদিবাসীদের কথাগুলো তুলে ধরে। কাজেই আদিবাসীরা এ অঞ্চলে যারা আমরা আছি তাদের কাজ হবে আমাদের অভিজ্ঞতার কথাগুলো তাদের কাছে তুলে ধরা। জলবায়ু পরিবর্তন থেকে শুরু করে নানা ধরনের মানবাধিকার লংঘের যে ঘটনার সম্মুখীন আমরা হই, সেসব নিয়মিত তাদের সাথে যোগাযোগ রেখে তুলে ধরতে হবে। কারণ, তারা লিখলেই আমাদের বিচার প্রাপ্তির পথ সুগম হবে।
মতবিনিময় সভায় আরো অংশ নেন সামস এর কোশাধ্যক্ষ তাপস কুমার মুন্ডা, রতিকান্ত মুন্ডা, আশিক মুন্ডা, প্রিয়তোষ মুন্ডা, আনন্দিনী মুন্ডা। এ মতবিনিময় সভায় সাতক্ষীরা’র শ্যামনগর উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম ও পাহাড় থেকে প্রায় ৩০ জন আদিবাসী অংশগ্রহণ করে।
আরমান/সাএ
সর্বশেষ খবর