
পাকিস্তান সরকার দেশটির বর্তমান সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনিরকে ফিল্ড মার্শাল পদে পদোন্নতি দিয়েছে। এই পদমর্যাদা পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে সবচেয়ে উচ্চ এবং বিরল। এমন পদমর্যাদা কেবলমাত্র পাকিস্তানের ইতিহাসে আইয়ুব খান পেয়েছিলেন। মুনির এখন পাকিস্তানের দ্বিতীয় ব্যক্তি যিনি এই মর্যাদাপূর্ণ উপাধি পেলেন।
এই সিদ্ধান্ত এমন সময় এলো, যখন ভারতের সঙ্গে চারদিনের সীমান্ত সংঘর্ষে দুই দেশের মধ্যে ব্যাপক উত্তেজনা ছড়িয়েছিল। দুই দেশ পরস্পরের দিকে ক্ষেপণাস্ত্র এবং ড্রোন হামলা চালায়, যা যুদ্ধের দিকে গড়াতে পারত। শেষ পর্যন্ত ১০ মে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়।
পাকিস্তান সরকার মনে করে, এই সংকটময় মুহূর্তে আসিম মুনিরের সাহসী এবং দূরদর্শী নেতৃত্বই দেশকে রক্ষা করেছে। এজন্য তাঁকে ফিল্ড মার্শাল করা হয়েছে।
মুনিরের পদোন্নতির কারণ কী?
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফের কার্যালয় থেকে জানানো হয়, সেনাপ্রধান মুনিরের ‘অতুলনীয় সাহস ও কৌশলগত নেতৃত্ব’ এই পদোন্নতির মূল কারণ। তিনি দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং শত্রুর বিরুদ্ধে সাহসী প্রতিরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তালাল চৌধুরী বলেন, মুনির দুই দিকেই সফলভাবে লড়াই করেছেন—পশ্চিম সীমান্তে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে এবং পূর্ব দিকে ভারতের মতো শক্তিশালী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে।
তালাল চৌধুরী বলেন, ’মুনিরের নেতৃত্বে আমরা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে এগিয়েছি এবং দেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছি।’
মুনির কী বললেন পদোন্নতি পাওয়ার পর?
এক বিবৃতিতে জেনারেল আসিম মুনির বলেন, এই পদোন্নতি তার ব্যক্তিগত অর্জন নয়, বরং এটি ‘পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনী এবং পুরো জাতির সম্মান’। তিনি এই সম্মানটি উৎসর্গ করেছেন দেশের শহীদদের, প্রবীণদের এবং নাগরিকদের।
ফিল্ড মার্শাল পদমর্যাদা কী?
ফিল্ড মার্শাল হল সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ উপাধি। এটি মূলত ব্রিটিশ সামরিক ঐতিহ্য থেকে এসেছে। এই পদে থাকা ব্যক্তি আজীবনের জন্য ওই মর্যাদা ধারণ করেন। একজন ফিল্ড মার্শালের নিজস্ব প্রতীক ও লাঠি থাকে। তারা সাধারণত স্যালুটের উত্তর দেন না, বরং একটি লাঠি নাড়িয়ে সম্মান প্রদর্শন করেন। পাকিস্তানে এই পদ এতটাই বিরল যে স্বাধীনতার পর কেবলমাত্র আইয়ুব খান এটি পেয়েছিলেন। তিনি ১৯৫৮ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে এক বছর পর নিজেকে ফিল্ড মার্শাল ঘোষণা করেন।
ভারতে কী ফিল্ড মার্শাল পদ আছে?
ভারতেও এই পদ আছে, এবং তা একইরকম বিরল। স্বাধীনতার পর মাত্র দুইজন ভারতীয় সেনাপ্রধান এই পদ পেয়েছেন—স্যাম মানেকশ (১৯৭৩ সালে) এবং কে এম কারিয়াপ্পা (১৯৮৬ সালে)। মানেকশ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়ে বিজয় অর্জন করায় তাকে এই উপাধি দেওয়া হয়।
পদোন্নতির রাজনৈতিক গুরুত্ব কী?
অনেকে মনে করেন, আসিম মুনিরের পদোন্নতির পেছনে শুধু সামরিক সাফল্য নয়, রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশও রয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক সিরিল আলমেইদা বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ হয়তো মুনিরের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো রাখতে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, যাতে সেনাবাহিনীর কাছ থেকে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা যায়। তিনি বলেন, ‘এটি শরিফের পক্ষ থেকে একটি বার্তা যে তিনি হুমকি নন, তাই তাকে সরিয়ে দেওয়ার দরকার নেই।’পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর রাজনৈতিক প্রভাব বহু পুরনো। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকেও সেনাবাহিনীর সঙ্গে টানাপোড়েনের কারণে ক্ষমতা হারাতে হয়েছে বলে মনে করা হয়।
সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ র্যাঙ্ক ‘ফিল্ড মার্শাল’ হলেন পাকিস্তানের সেনাপ্রধানসেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ র্যাঙ্ক ‘ফিল্ড মার্শাল’ হলেন পাকিস্তানের সেনাপ্রধান
সেনাবাহিনীর ভবিষ্যতের জন্য এই পদোন্নতির অর্থ কী?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফিল্ড মার্শাল হওয়া মূলত একটি আনুষ্ঠানিক সম্মান। এটি বাস্তব ক্ষমতার দিক থেকে সেনাপ্রধানের দায়িত্বে খুব বেশি পরিবর্তন আনে না। মুনির এখনো ২০২৭ সাল পর্যন্ত সেনাপ্রধান থাকবেন। তবে নতুন একটি আইনের ফলে তিনি চাইলে আরও পাঁচ বছর মেয়াদ বাড়াতে পারেন।
এসওএএস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মারিয়া রশিদ বলেন, ‘এই পদোন্নতির মাধ্যমে বোঝা যাচ্ছে, মুনিরের মেয়াদ বাড়ানো হবে।’এছাড়াও, অনেকে আশঙ্কা করছেন, ফিল্ড মার্শাল উপাধি দিয়ে সেনাবাহিনীর রাজনৈতিক প্রভাব আরও মজবুত করা হচ্ছে।
সমালোচনা ও প্রতিক্রিয়া
ওয়াশিংটন-ভিত্তিক নিরাপত্তা বিশ্লেষক সাহার খান বলেন, ’সেনাবাহিনীর এই অতিরিক্ত প্রভাব পাকিস্তানের গণতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর।’ অন্যদিকে, সরকারের পক্ষ থেকে এই সমালোচনাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলা হচ্ছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চৌধুরী বলেন, ’যারা সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে কথা বলছেন, তাদের প্রতি এটি একটি স্পষ্ট জবাব—এই বাহিনী আমাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করেছে, দেশের জন্য যুদ্ধ করেছে এবং জয় এনে দিয়েছে।’
আসিম মুনিরকে ফিল্ড মার্শাল পদে পদোন্নতি দেওয়া পাকিস্তানের সামরিক ইতিহাসে একটি বড় ঘটনা। এটি শুধু তার ব্যক্তিগত অর্জন নয়, বরং দেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতা, সীমান্তে উত্তেজনা, এবং সামরিক নেতৃত্বের ভবিষ্যতের দিকেও ইঙ্গিত দেয়। এই পদোন্নতি তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে আরও বড় মর্যাদা দিলেও এর গভীরে রাজনৈতিক, কৌশলগত এবং সামরিক নানা স্তরের অর্থ রয়েছে—যা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক নীতিতে প্রভাব ফেলতে পারে।
তথ্যসূত্র: আল জাজিরা
রার/সা.এ
সর্বশেষ খবর