
ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষ চলাকালীন সেনাবাহিনীর মুখপাত্র কর্নেল সোফিয়া কুরেশিকে নিয়ে একটি মন্তব্য করার কারণে দিল্লির যে অধ্যাপককে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ, তাকে বুধবার সুপ্রিম কোর্ট অন্তর্বর্তীকালীন জামিন দিয়েছেন। ভারতের নামকরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অশোকা ইউনিভার্সিটির রাজনীতি বিজ্ঞানের ওই অধ্যাপকের নাম আলী খান মাহমুদাবাদ।
সংঘর্ষের মধ্যেই ৮ মে এক পোস্টে অধ্যাপক আলী খান লেখেন, ‘কর্নেল সোফিয়া কুরেশির প্রশংসা করছেন অনেক দক্ষিণপন্থী ভাষ্যকার, এটা দেখে আমি খুশি। তবে এরা যদি একইভাবে গণপিটুনি, নির্বিচারে বুলডোজার চালানো ও বিজেপির ঘৃণা ছড়ানোর শিকার হওয়া মানুষদের হয়েও আওয়াজ তুলতেন, যাতে এই মানুষগুলো ভারতের নাগরিক হিসেবে নিরাপত্তা পায়।’
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করা এই মন্তব্যের কিছু শব্দ বিচার-বিবেচনা করে দেখার জন্য জ্যেষ্ঠ পুলিশ কর্মকর্তাদের দিয়ে একটি বিশেষ তদন্তদল গঠন করার কথাও বলেছেন সুপ্রিম কোর্ট। গত ১৮ মে হরিয়ানা পুলিশ আলী খানকে গ্রেপ্তার করেছিল।
তবে অধ্যাপক আলী খান একা নন, ভারতশাসিত কাশ্মীরের পেহেলগাম হত্যাকাণ্ড ও তারপর পাকিস্তানের সঙ্গে সংঘর্ষের আবহে ১০০-এরও বেশি মানুষকে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, পাকিস্তানের সমর্থনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করার কারণে।
২ রাজ্যে গ্রেপ্তার শতাধিক
অনেক রাজ্য থেকেই গ্রেপ্তারের খবর পাওয়া গেলেও সব থেকে বেশি মানুষ গ্রেপ্তার হয়েছে আসাম আর উত্তর প্রদেশে। আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা জানিয়েছেন, তার রাজ্যে এখন পর্যন্ত ৭৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আর উত্তর প্রদেশে গ্রেপ্তার হয়েছে অন্তত ৩০ জন। আসামে যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাদের মধ্যে রয়েছেন এআইইউডিএফের বিধায়ক আমিনুল ইসলামও। গত ২৩ এপ্রিল পেহেলগাম হামলা নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করার অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে।
পরের দিন আসামের নগাঁও পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। পরে জেলা আদালতে জামিন পেলেও সঙ্গে সঙ্গেই আবার তাকে জাতীয় নিরাপত্তা আইনে আটক করা হয়।
অন্যদিকে উত্তর প্রদেশ থেকে বিবিসির দুই প্রতিনিধির পাঠানো তথ্য অনুযায়ী, সে রাজ্যে যে ৩০ জন গ্রেপ্তার হয়েছে, তাদের ১৮টি জেলা থেকে ধরা হয়েছে। তাদের মধ্যে আছেন বরেলি জেলার বাসিন্দা মুহম্মদ সাজিদ। পুলিশের ভাষ্য মতে, তিনি একটি পোস্টে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ লিখেছিলেন।
এ ছাড়া পশ্চিম উত্তর প্রদেশের মেরঠের এক সেলুন মালিক ও তার সহযোগীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয় ৭ মে। তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘পাকিস্তানের সমর্থনে’ পোস্ট করেছিলেন। মুজাফফরনগর জেলার পুলিশ আনোয়ার জামিল নামের এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে একই অভিযোগে এফআইআর দায়ের করে। একটি ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর জামিলের বিরুদ্ধে মামলা করা হয় বলে পুলিশ জানিয়েছে।
জম্মু ও কাশ্মীর
শ্রীনগর থেকে বিবিসির সংবাদদাতা মাজিদ জাহাঙ্গীর বলছেন, সামাজিক মাধ্যমে ভারতের বিরুদ্ধে ‘অসন্তোষ’ ও ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী চিন্তা-ভাবনা’ ছড়ানোর অভিযোগে সেখানকার পুলিশ হিলাল মীর নামের এক সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করেছে।
জম্মু ও কাশ্মীর পুলিশের সন্ত্রাস দমন শাখা এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘কাশ্মীরিরা ব্যবস্থার দ্বারা প্রতারিত হয়েছেন—এই কথা বলে যুবসমাজের ভাবনাকে উসকে দিতে এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী চিন্তা তাদের মাথায় ঢোকাতে’ যে পোস্ট করেছিলেন মীর, সে জন্যই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
মীর তুরস্কের আনাদোলু নিউজ এজেন্সির হয়ে কাজ করতেন। তবে তার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু বিবিসিকে বলেছেন, পুলিশ তাকে ছেড়ে দিয়েছে।
শ্রীনগরের আরেক সাংবাদিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, তার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের টাইমলাইনের একটা পোস্ট সরিয়ে ফেলতে এক শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তা তাকে ফোন করেছিলেন। পরে তিনি ওই পোস্টটি ডিলিট করে দেন।
পশ্চিমবঙ্গেও গ্রেপ্তারি
এদিকে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের পরিসংখ্যান উদ্ধৃত করে দ্য হিন্দু সংবাদপত্র লিখেছে, রাজ্যের নানা জেলা থেকে ছয় থেকে আটজনকে ‘পাকিস্তানপন্থী’ পোস্ট করার জন্য গ্রেপ্তার করা হয়েছে। হুগলী, মুর্শিদাবাদ, হাওড়া, বারাসাত, বাঁকুড়া ও উত্তর দিনাজপুর থেকে এদের ধরা হয়েছে।
আবার কলকাতাসংলগ্ন বারাসাতে একটি গণপিটুনির ঘটনাও ঘটেছে ‘বিতর্কিত’ পোস্ট দেওয়াকে কেন্দ্র করে। অন্যান্য ধারার সঙ্গেই ধৃতদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগও করা হয়েছে যে তারা দুটি সম্প্রদায়ের মধ্যে বৈরিতার চেষ্টা করছিলেন।
এ ছাড়া মধ্য প্রদেশেও অন্তত সাতজন গ্রেপ্তার হয়েছে পেহেলগামের ঘটনার পর থেকে। দামোহ জেলার দুজনকে ধরা হয়েছে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়ানোর অভিযোগে। ওয়াসিম খান নামের একজন ওই পোস্টটি করেছিলেন এবং তাতে ‘আপত্তিকর মন্তব্য’ করেছিলেন তানভীর কুরেশি—এই কারণেই তাদের ধরা হয়েছে বলে পুলিশ জানিয়েছে। জব্বলপুরে এক ব্যক্তির অভিযোগের ভিত্তিতে জেলা পুলিশ উসকানিমূলক ও বিদ্বেষমূলক মন্তব্যের কারণে একজনকে গ্রেপ্তার করে।
এই রাজ্যে ধৃতদের মধ্যে আছেন ডিন্ডোরি জেলার একটি কলেজের শিক্ষক। তিনি অবশ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নয়, নিজের হোয়াটসঅ্যাপ স্ট্যাটাসে পেহেলগাম হামলাসংক্রান্ত একটি ভিডিও দিয়েছিলেন। আবার ২৫ এপ্রিল ইন্দোরে পেহেলগাম হামলার প্রতিবাদে বিক্ষোভের সময় ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ স্লোগান শোনা যায়।
ওই বিক্ষোভের একটি ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর পুলিশ কংগ্রেস দলের এক পৌর প্রতিনিধি আনোয়ার কাদরি ও আরো এক ব্যক্তিকে আটক করে। আনোয়ার কাদরি গ্রেপ্তার হওয়ার আগে বলেছিলেন, ভিডিওটি বিকৃত করা হয়েছে।
মধ্য প্রদেশের পাশের রাজ্য ছত্তিশগড়ে লুজিনা খান নামের এক নারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ‘অপারেশন সিঁদুর’ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রশ্ন তোলার অভিযোগে। লুজিনা খান একজন তরুণী ফটোগ্রাফার। ইনস্টাগ্রামে তার এক লাখের বেশি ফলোয়ার আছে।
পোস্ট নিয়ে বিতর্ক উঠলে তিনি তা মুছে দিয়ে আরেকটি পোস্টে লেখেন, ‘ভারতীয় সেনার সাহসিকতায় আমি গর্বিত। অনিচ্ছাকৃতভাবে একটি পোস্ট হয়ে গিয়েছিল, যেটি দ্বিতীয়বার পড়ার পর আমার ভুল বুঝতে পেরেছি এবং সেই পোস্টটি সরিয়ে দিয়েছি। আমার পোস্টে যদি মানুষের অনুভূতিতে আঘাত লেগে থাকে তাহলে আমি অন্তর থেকে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। আমি একজন ভারতীয় হিসেবে গর্বিত এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর জন্য গর্বিত।’
অভিযুক্ত থাকেন কানাডায়
এদিকে দক্ষিণ ভারতের রাজ্য কর্ণাটকের একটি ঘটনা সামনে এসেছে, যেখানে এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে পুলিশ অভিযোগ এনেছিল ভুয়া খবর পোস্ট করার। ওই পোস্টে লেখা হয়েছিল, বেলগাভি জেলায় কর্নেল সোফিয়া কুরেশির শ্বশুরবাড়িতে আরএসএসের কর্মীরা হামলা চালিয়ে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে।
ওই ভুয়া পোস্টদাতা এবং সেটিতে সমর্থন দেওয়া দুজনের বিরুদ্ধে মামলা করে পুলিশ। তবে পরে জানা যায়, ওই ভুয়া পোস্ট যিনি দিয়েছিলেন, তিনি আসলে কানাডার বাসিন্দা।
আবার এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ, যিনি পেহেলগাম হামলার সঙ্গে বিহার রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের যোগসূত্র রয়েছে বলে একটি ভিডিও পোস্ট করেছিলেন। আদালতে হাজির করা হলে তাকে দুই লাখ রুপির জামিনে ছেড়ে দেওয়া হয়, কারণ তিনি মানসিকভাবে অসুস্থ।
উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য মেঘালয়ের বাসিন্দা দুই অপ্রাপ্তবয়স্ককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘পাকিস্তানের সমর্থনে’ পোস্ট করেছিলেন। পুলিশ বলেছে, ফেসবুকের একটি ভিডিও পোস্টে তাদের গারো ভাষায় ভারতবিরোধী স্লোগান ও পাকিস্তানপন্থী স্লোগান দিতে দেখা গেছে।
এর আগে পেহেলগামের হামলার পর পরই ফেসবুক পেজে ঘৃণা ছড়ানোর অভিযোগে মেঘালয়ে এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ।
আরমান/সাএ
সর্বশেষ খবর