
আওয়ামী লীগ নেতা ওবায়দুল কাদের লম্বা সময় গা ঢাকা দিয়ে থাকার পর সম্প্রতি মুখ খুলেছেন। বিবিসি বাংলার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে ওবায়দুল কাদের এখনও বাংলাদেশে কার্যত নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক থাকার কথা দাবি করেছেন।
প্রতিবেশি দেশ ভারতের কলকাতায় অবস্থান করে সেখান থেকে কথা বলা শুরু করেছেন তিনি। কাদের দাবি করেছেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের শাসনের পতনের তিন মাস তিনি বাসা বদল করে করে আত্নগোপনে ছিলেন। শেষ পর্যন্ত গত বছরের নভেম্বর মাসে তিনি নিরাপদে দেশ ছেড়ে গেছেন।
ছাত্র-জনতার সেই আন্দোলনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, আটশোর বেশি হত্যাকাণ্ড ও দমননীতি চালানোর অভিযোগের ক্ষেত্রে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ ও এর নেতৃত্বের কোনো অনুশোচনা নেই। তাদের ক্ষমা চাওয়া বা ভুল স্বীকারের কোনো লক্ষণও দৃশ্যমান নয়। এ নিয়ে দেশের রাজনীতিতে নানা আলোচনা রয়েছে।
সাক্ষাৎকারে ওবায়দুল কাদের জানান, তারা যখন দেশে এসে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালানোর পরিবেশ পাবেন, তখন ক্ষমা চাওয়া, ভুল স্বীকার করা বা অনুশোচনার বিষয় আসবে। ছাত্রদের সেই আন্দোলনে নিজেদের কিছু ভুল এবং পরিস্থিতি নিয়ে তাদের মধ্যেও আলোচনা হচ্ছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
তার দাবি, আওয়ামী লীগ সরকার পতনের আন্দোলনকে 'গণউত্থান' বলা সঠিক হবে না। এতে উত্থান হয়েছে 'সাম্প্রদায়িক শক্তির'।
আওয়ামী লীগের শাসনের পতনের দিনই গত বছরের ৫ অগাস্ট শেখ হাসিনা ভারতে চলে যান। দলটির ও তাদের সরকারের মন্ত্রী, সংসদ সদস্য বা নেতাদের বড় অংশই পালিয়ে যান ভারত, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে। কিন্তু ওবায়দুল কাদের কোথায় আছেন, তা নিয়ে ছিল রহস্য, ছিল নানা আলোচনা। কারণ গত সাড়ে ৯ মাসে তিনি কোনো মিডিয়ায় কথা বলেননি। অথচ শেখ হাসিনার শাসনের পতনের আগের দিন পর্যন্ত প্রায় প্রতিদিনই সংবাদ সম্মেলন করে দল ও সরকারের পক্ষে বক্তব্য তুলে ধরতেন কাদের।
শেষপর্যন্ত সাড়ে ৯ মাস পর সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলা শুরু করেছেন ওবায়দুল কাদের। তিনি এতদিন কীভাবে ছিলেন, কখন দেশ ছাড়লেন, এখন কোথায়-কীভাবে আছেন, এসব নিয়ে বিবিসির এই সাক্ষাৎকারে কথা বলেছেন তিনি।
পতনের আভাস কী পেয়েছিলেন? এই প্রশ্নের জবারে ওবায়দুল কাদের জানান, ৫ অগাস্ট তিনি জাতীয় সংসদ ভবন এলাকায় সরকারি বাসভবনে ছিলেন। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সড়ক পরিবহন মন্ত্রী হিসেবে সরকারি ওই বাড়িতে থাকতেন তিনি।
কাদের জানান, তিনি সেদিন যখন ঢাকামুখী মিছিলের খবর পান, তখন সংসদ ভবন এলাকাতেই অন্য একটি বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
তিনি বলেন, ‘আমি আমার বাসায় ছিলাম, সংসদ ভবন এলাকায়। যখন ঢাকা নগরী অভিমুখে বিভিন্ন দিক থেকে মিছিল আসছিল। মিছিলে তাদের একটা আক্রমণাত্মক মনোভাব ছিল। লাঠি-সোটা নিয়ে তারা যখন ঢাকা মহানগরের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল, তখন তাদের মধ্যে যে বিদ্বেষের ভাব, সেটা বুঝতে পারলাম।’
ওই বাসায় লুকিয়ে থাকার এক পর্যায়ে তিনি জানতে পারেন যে, সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বেতার ও টেলিভিশনে ভাষণ দেবেন।
কাদের বলেন, ‘সে খবরটি পেয়ে আমার বাইরে যাওয়ার সুযোগ ছিল না। সংসদ ভবন এলাকাতেই আর একটা বাড়িতে আমি আশ্রয় নিয়েছিলাম।’
সংসদ ভবন এলাকায় অন্য একটি বাড়িতে যখন আশ্রয় নেন কাদের, তখন সঙ্গে তার স্ত্রীও ছিলেন। এক পর্যায়ে সেই বাড়িতে প্রবেশ করেন আন্দোলনকারীরা। তখন স্ত্রীসহ তিনি বাথরুমে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
কাদের বলেন, ‘আমি একটু নিরুপায় হয়ে বাথরুমে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলাম। সেখানে অনেক্ষণ থাকতে হয়েছে। একটা পর্যায়ে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নামে যারা সেদিন এসেছিল আমাদের বাসাবাড়ি আক্রমণ করতে, অনেকে ভাঙচুর-লুটপাট করছে। একটা বিভৎস অবস্থা।’
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে কাদের বলেন, ‘এরা যখন সারা ঘরের সবকিছু লুটপাট ভাঙচুর করে, এতক্ষণ ধরে আমার ওয়াইফ তাদেরকে বাথরুমের দরজায় দাঁড়িয়ে বারবার বলছিল আমি অসুস্থ। তারা প্রথমে বিষয়টিকে বিশ্বাস করে অগ্রসর হয়নি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যেটা বাস্তবে দেখলাম, ভেতরে যে কমোড এবং বেসিন- এটা তাদের টার্গেট। সেজন্য তারা জোর করে ঢোকার চেষ্টা করছিল। তো আমার ওয়াইফ আমাকে জিজ্ঞেস করল কী করব? আমি বললাম খুলে দাও।’
তিনি বলেন, ‘বাথরুমের দরজা খুলে দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে অনেকেই ঢুকে পড়ল। তারা হঠাৎ আমার দিকে তাকায় - দেখলাম যে তাদের বিস্ময়ে ভরা চোখ। অবাক বিস্ময়ে তারা আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমাকে জিজ্ঞেস করল, আপনার প্রধানমন্ত্রী তো চলে গেছে, আপনি যাননি? আমি তখন নির্বাক। আমি কিছু বলিনি।’
কাদের বলেন, ‘এক পর্যায়ে তাদের মধ্যে একটা বিভক্তি দেখলাম। একটা গ্রুপ বলছে যে, না ওকে জনতার হাতে তুলে দেই। আবার কেউ কেউ বলছে, সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেই। একটা পর্যায়ে যারা আমাকে রক্ষা করতে চেয়েছিল তাদের সংখ্যার আধিক্যটা লক্ষ্য করলাম এবং তারা শেষ পর্যন্ত জয়ী হল।’
তিনি জানান, শেষপর্যন্ত আন্দোলনকারীদের সেই দলটি তার শার্ট পাল্টিয়ে এবং মুখে মাস্ক দিয়ে তাকে নিয়ে রাস্তায় নামে। আন্দোলনকারীরাই তাকে ও তার স্ত্রীকে একটা ইজিবাইকে নিয়ে রাস্তায় মানুষের ভিড় থেকে রক্ষা করে।
কাদের বলেন, ‘রাস্তায় লোকজনের ভিড় বেশি। আমার চাচা-চাচি অসুস্থ হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি- এ কথা বলে বলে বিভিন্ন জায়গায় বুঝিয়ে সুঝিয়ে আমাদেরকে নিয়ে গেল। আমরা বিপদমুক্ত হলাম একটা পর্যায়ে।’
৫ অগাস্ট ঢাকায় এভাবে বিপদমুক্ত হওয়ার কথা বলেন কাদের। কিন্তু কোথায় গিয়ে বিপদমুক্ত হলেন এবং এরপর কোন এলাকায় বা কার আশ্রয়ে আত্মগোপনে ছিলেন-এ নিয়ে কিছু বলেননি তিনি। তার বক্তব্য অন্য কোনো পক্ষ থেকে নিরপেক্ষভাবে যাচাই করতে পারেনি বিবিসি।
পরে দেশ ছাড়ার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে কাদের বলেন, ‘দেখুন কীভাবে এসেছি, এটা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। এটা বলার কী দরকার আছে? এসেছি তিন মাস পরে। ৫ অগস্টের তিন মাস পর আমি নভেম্বর মাসে দেশ ছেড়েছি। এটুকু বলতে পারি।’
কাদের জানান, ভারত যাওয়ার আগে তার সঙ্গে দলের নেত্রী শেখ হাসিনা বা অন্য কারও সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না।
তিনি বলেন, ‘কোনো যোগাযোগ ছিল না। সেখান থেকে আমি কোনো যোগাযোগের চেষ্টা করিনি। তখন আসলে আমার একটা কনসার্ন ছিল যে, আমাকে ধরার জন্য বিভিন্ন জায়গায় তল্লাশি অভিযান চলছিল। আমাকে বার বার বাসা পরিবর্তন করতে হয়েছে। আমার ওখানে অ্যারেস্ট হওয়ার একটা ঝুঁকি আছে।’
কাদের আরও বলেন, ‘আমাকে অনেকগুলো মেডিসিন নিতে হয়। আমার তো বাইপাস সার্জারি হয়েছিল। সেই কারণেই তখন এ ঝুঁকি নেয়া আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। অনেকেই আমাকে প্রথম থেকেই দেশ ছাড়তে বলেছিল। কিন্তু আমি চেষ্টা করেছি দেশেই থাকার। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যেভাবে এখানে সেখানে তল্লাশি, তাতে আমি আর ঝুঁকি নিতে চেষ্টা করলাম না। বাধ্য হয়েই আমাকে দেশত্যাগ করতে হয়েছে।’
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের কোনো পরিবর্তন হয়নি বলে উল্লেখ করে কাদের বলেন, ‘আমি এখনো দলের সাধারণ সম্পাদক। আমাদের দলে তিন বছর পর পর কাউন্সিলে নেতৃত্ব পরিবর্তন হয়। আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত মেয়াদ আছে। আমি এখন সাধারণ সম্পাদক হিসেবে কথা বলা শুরু করেছি।’
পাঁচই অগাস্টে সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতি, সংসদের স্পিকার ও আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী, এমপিদের অনেকে এবং পুলিশসহ বিভিন্ন বাহিনীরও অনেকে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন সেনানিবাসে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ওবায়দুল কাদেরও দেশের কোনো একটি সেনানিবাসে আশ্রয় নিয়েছিলেন, এমন আলোচনা, গুঞ্জন ছিল।
সে সময় আশ্রয় নেয়াদের ৬২৬ জনের একটি তালিকা সম্প্রতি সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে প্রকাশ করা হয়েছে। অবশ্য সেই তালিকায় ওবায়দুল কাদেরের নাম নেই।
কাদের দাবি করেন, ক্যান্টনমেন্টে আশ্রয় নেয়ার বিষয়টা তার ধারণায় ছিল না।
তিনি বলেন, ‘ক্যান্টনমেন্টে আশ্রয় নিতে হবে, এরকম কোনো ধারণা আমার ছিল না। তখন আমি একটা প্রাইভেট বাড়িতেই আশ্রয় নিয়েছিলাম। প্রথম দুই দিন চেঞ্জ (বদল) করে করে ছিলাম। ক্যান্টনমেন্টে গিয়ে আশ্রয় নিতে হবে, এরকম চিন্তা আমি তখন করিনি।
সূত্র: বিবিসি বাংলা
রার/সা.এ
সর্বশেষ খবর
রাজনীতি এর সর্বশেষ খবর