
বর্তমান বাংলাদেশ সঙ্কট উত্তরণের প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে, বলে মন্তব্য করেছেন শিল্প মন্ত্রণালয় এবং গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান।
তিনি বলেন, বর্তমান বাংলাদেশ সঙ্কট উত্তরণের প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থার পতনই ন্যায়বিচারের গ্যারান্টি নয়। এক্ষেত্রে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। আমাদের বিচারব্যবস্থাকে ভয়মুক্ত করতে হবে, নিরাপত্তা বাহিনীর সংস্কারসহ ছাত্র আন্দোলনকে যেকোনো দখলদারিত্ব থেকে রক্ষা করতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনে জুলাই বিপ্লবের প্রথম বার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে আয়োজিত প্রথম জুলাই বিপ্লব আন্তর্জাতিক সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এ মন্তব্য করেন তিনি।
আদিলুর রহমান বলেন, আমরা আজ যে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী শাসনের পতন দেখেছি, সেটার নিষ্ঠুরতা আমাদের বিবেককে সামগ্রিকভাবে ক্ষতবিক্ষত করেছে। এই শাসনব্যবস্থা রাষ্ট্রকে জনগণের বিরুদ্ধে অস্ত্রে পরিণত করেছিল। শুধু তাই নয়, র্যাব, পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে সন্ত্রাসের হাতিয়ার বানানো হয়েছিল। গুম-খুন হয়ে উঠেছিল নিত্যদিনের ঘটনা। কবি, শিক্ষক, সাংবাদিক ও ছাত্রনেতাদেরকে 'অপরাধী' হিসেবে জেলে ভরা হয়েছিল। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মুক্ত চিন্তায় বাঁধা দেওয়া হতো।
আদিলুর রহমান তার বক্তব্যে জুলাই বিপ্লবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান স্মরণ করে বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবারও সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছে। এর শ্রেণীকক্ষগুলো হয়ে উঠেছিল রণকৌশলের কেন্দ্র, ছাত্ররা হয়ে উঠেছিল বিবেকের যোদ্ধা। আমরা বিদেশি গবেষক, অধ্যাপক ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর কাছে কৃতজ্ঞ যারা বিপজ্জনক সময়েও বাংলাদেশের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন।
বক্তব্যের শেষে তিনি এই সম্মেলনকে একটি 'জাতীয় অঙ্গীকারে' পরিণত করতে জুলাই বিপ্লবের দলিলপত্র, ভিডিও, ফটো নিয়ে একটি আর্কাইভ গড়ে তোলা, স্কুল-কলেজের পাঠ্যক্রমে জুলাই ইতিহাস সত্যনিষ্ঠভাবে অন্তর্ভুক্ত করার আহ্বান জানান।
জুলাই গণঅভ্যুত্থান সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি, একাডেমিক ও গবেষণাপত্র উপস্থাপন ও বিশ্লেষণমূলক আলোচনা এবং বাংলাদেশ ২.০' গঠনের দিকনির্দেশনা তৈরি- এ লক্ষ্যে আয়োজিত এই সম্মেলনে অংশ নিয়েছে দেশ ও বিদেশের মোট ১৫টি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও সিভিল সোসাইটি সংগঠন।
এর আগে জুলাই বিপ্লবে শহীদ জাহিদুজ্জামান তানভীনের মা বিলকিস জামান ও বাবা শামসুজ্জামান বক্তব্য প্রদান করেন। এ সময় তারা সকল শহীদ পরিবারের পক্ষ থেকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে শহীদদের সনদ চান।
সম্মেলনে স্বাগত বক্তব্য দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও সম্মেলনটির আহ্বায়ক ড. মো. শরীফুল ইসলাম। স্বাগত বক্তব্যে সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী সকলকে ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, '২৪-এর জুলাই বিপ্লব কেবল একটি প্রতিবাদ নয়, এটি ছিল বাংলাদেশের যুবসমাজের একত্রিত হওয়ার একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক ড. মাহমুদুর রহমান, আমেরিকার স্ট্যাস্ট ডিপার্টমেন্টের অবসরপ্রাপ্ত কূটনীতিবিদ জন এফ. ডেনিলোইজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. মামুন আহমেদ উপস্থিত ছিলেন।
সম্মেলনের উদ্বোধনী অংশে 'ইন্ডিয়ান হেজিমনি এন্ড জুলাই রেভুলিউশন ২০২৪' শিরোনামে কী-নোট বক্তব্য প্রদান করেন দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক ড. মাহমুদুর রহমান।
এ সময় তিনি বলেন, ভারত নিজে একটি গণতান্ত্রিক দেশ হয়েও বাংলাদেশে একটি কর্তৃত্ববাদী সরকারকে সমর্থন করে। কারণ তারা মনে করেছিল যে শেখ হাসিনার মাধ্যমেই তাদের লক্ষ্য পূরণ হবে। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের ভোটে ভারতের সমর্থনই এই প্রমাণ করে।
তিনি আরো বলেন, ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লবকে ধর্মনিরপেক্ষ, ইসলামী ও জাতীয়তাবাদী আদর্শের এক অনন্য সংমিশ্রণ যা বিশ্ব ইতিহাসে বিরল। এই বিপ্লব শুধু আমাদের দেশেই নয় বরং সমগ্র মুসলিম বিশ্বের জন্য একটি শিক্ষণীয় ঘটনা।
আমেরিকার স্ট্যাস্ট ডিপার্টমেন্টের অবসরপ্রাপ্ত কূটনীতিবিদ জন এফ. ডেনিলোইজ বলেন, জুলাই বিপ্লব কোনো বিদেশী শক্তি বা গভীর রাষ্ট্রের ষড়যন্ত্রের ফল নয়। এটি সম্পূর্ণভাবে বাংলাদেশের মানুষের নিজস্ব সংগ্রামের ফসল। ষড়যন্ত্র তত্ত্বে বিশ্বাসীদের কাছে প্রমাণ দেওয়া কঠিন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য কোনো দেশ এতে জড়িত ছিল না। আজ পর্যন্ত আমি এমন কোনো প্রমাণ দেখিনি। যদি এমন কোনো প্রমাণ কারো কাছে থাকে আমি সেটা দেখাতে চ্যালেঞ্জ করছি। তিনি আরো বলেন, বিপ্লব সফল হওয়ার পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অস্থিতিশীলতা পরিবেশ ও তথ্য যুদ্ধের মুখোমুখি হয়েছে যা এখনও চলমান রয়েছে। এর থেকে পরিত্রাণ পেতে সরকারকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানান তিনি।
এ সময় আমেরিকার প্রশাসন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বিভিন্নভাবে সহায়তা করেছে তা উল্লেখ করে বাংলাদেশে ভবিষ্যতে সরকারের যারা দায়িত্বে আসবেন তাদেরকে বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের ভুলগুলো থেকে শিক্ষা নিতে হবে উল্লেখ করে জুলাই বিপ্লবের চেতনাকে ধারণ করে বিপ্লবে অংশগ্রহণকারীদের যথার্থ গুরুত্ব দেওয়ার আহ্বানও জানান তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. মামুন আহমেদ বলেন, ২৪-এর জুলাই বিপ্লব কেবল একটি প্রতিবাদ ছিল না, এটি ছিল জাতীয় জাগরণ। এ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে গণতান্ত্রিক সংগ্রামের কেন্দ্রবিন্দু বলে উল্লেখ করেন তিনি।
সম্মেলনে উপস্থাপনের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রায় ৪০০ টি প্রবন্ধ জমা পড়ে। এরমধ্যে ৬০টি প্রবন্ধ মৌখিক উপস্থাপনের জন্য এবং ৬০টি পোস্টার মনোনীত করা হয়। পরে সম্মেলন শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি) অডিটোরিয়ামে 'লাল জুলাই' নামক একটি মঞ্চ নাটক উপস্থাপন করা হয়।
রার/সা.এ
সর্বশেষ খবর