
নাটোরের তাজুল ইসলাম, বয়স ৫৬ বছর। পেশায় স্কুলশিক্ষক হলেও দৃঢ় মনোবল, ইচ্ছাশক্তি ও সাহসে তিনি ব্যতিক্রমী এক উদাহরণ। দীর্ঘদিনের ডায়াবেটিস ও হৃদরোগে আক্রান্ত মানুষটি ২০১৬ সালে ওপেন হার্ট সার্জারি করান। চিকিৎসকদের কঠিন পরামর্শ ছিল জীবন সীমাবদ্ধ রাখতে হবে নিয়ম-কানুনে, বিশ্রামে থাকতে হবে সব সময়। কিন্তু সেই পরামর্শ অক্ষরে অক্ষরে মানেননি তাজুল ইসলাম। বরং শারীরিক সীমাবদ্ধতাকে জয় করে শুরু করেন নতুন এক যাত্রা। একটি মোটরসাইকেল নিয়ে স্ত্রী ফেরদৌসী আরাকে সঙ্গে করে দেশের ৬৪টি জেলা ঘুরেছেন এই শিক্ষক।
তাজুল ইসলামের কর্মস্থল নাটোরের সিংড়া উপজেলার মহিষমারি ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসা। ছোট শহরের সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত হলেও শুরু থেকেই ছিল দূর-দূরান্ত ঘোরার স্বপ্ন। প্রথম বাইক চালানো শুরু করেন ১৯৯৯ সালে। তখন থেকেই দেশের প্রকৃতি, মানুষ, পাহাড়-নদীকে কাছ থেকে দেখার আগ্রহ তৈরি হয়। কিন্তু সংসার, শিক্ষকতা আর দায়িত্বের চাপে সেই ইচ্ছা দীর্ঘদিন অবদমিত ছিল। ২০১৬ সালে হৃদযন্ত্রে জটিলতার কারণে ওপেন হার্ট সার্জারি হয় তার। দীর্ঘ বিশ্রামের পরও জীবন থেমে থাকেনি। বরং সেখান থেকেই শুরু হয় নতুন উদ্যমে পথচলা।
২০২২ সাল থেকে যাত্রা শুরু। স্কুল ছুটির সুযোগ পেলেই পেছনে একটি ব্যাগ, দুটি হেলমেট, ১০০ সিসির বাইক, সঙ্গে স্ত্রী, সামনে বাংলাদেশের মানচিত্র। বাইকে চেপে দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত ঘুরে দেখেছেন তারা। এ তালিকায় আছে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় জেলা বরিশাল, সাতক্ষীরা, পটুয়াখালী থেকে শুরু করে উত্তরের পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, কুড়িগ্রাম। বাদ যায়নি পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটির মতো পাহাড়ি পথও। সম্প্রতি মাত্র ৬ দিনে প্রায় ১,৭৭৭ কিলোমিটার রাইড সম্পন্ন করেন তিনি। টেকনাফ থেকে নাটোর পর্যন্ত পাড়ি দেন প্রায় ৭০০ কিলোমিটার।
পুরো যাত্রায় একা ছিলেন না তাজুল ইসলাম। প্রতিটি ভ্রমণে তার সঙ্গে ছিলেন স্ত্রী, একজন অবসরপ্রাপ্ত স্বাস্থ্যকর্মী। শীত, গরম, বৃষ্টি সব রকমের আবহাওয়াতেই পেছনের সিটে থেকে পাশে থেকেছেন জীবনসঙ্গিনী। তাদের প্রতিবেশীরা বলেন, তারা শুধু এক দম্পতি নন, একজোড়া সহযাত্রী, যারা হাতে হাত রেখে জীবনকে দেখেছেন নতুন করে। তারা শুধু ভ্রমণ করেন না, তারা আমাদের শেখান, জীবন মানে থেমে যাওয়া নয়। একবার হৃদয় যদি বাঁচতে চায়, তাকে কেউ থামাতে পারে না। এ গল্প শুধু গর্বের নয়, কৃতজ্ঞতার।
এ ভ্রমণে নেই কোনো স্পনসরশিপ, নেই ভিডিও কনটেন্ট তৈরির পরিকল্পনা। আছে শুধুই ভালোবাসা ভ্রমণের প্রতি টান, দেশের মানুষের সঙ্গে মিশে যাওয়ার আন্তরিক ইচ্ছা। একটি বাইক, একটি ব্যাগ, একটি ফোন আর একটি অদম্য মন নিয়ে দেশের পথে বারবার রওনা হয়েছেন তিনি। পথে পেয়েছেন মানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসা ও আতিথেয়তা।
তাজুল ইসলাম জানান, দেশের ৬৪ জেলা ঘোরা তার জীবনের অন্যতম বড় অর্জন। এখন তার স্বপ্ন বাইক নিয়ে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে পা রাখা দেশের বাইরের রাস্তায়। বিশেষ করে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও সিকিমের পথই বেশি টানে তাকে। তার ভাষায়, ‘বাংলাদেশ তো অনেকটাই দেখা হলো, এবার বাইক নিয়ে দেশের বাইরেও যেতে চাই। সহজ নয় জানি, তবে ইচ্ছা থাকলে পথ একদিন ঠিকই বের হয়ে আসে। তিনি আরও বলেন, বড় কিছু হতে চাই না, শুধু চাই যতদিন বাঁচি, চলতে চলতে নতুন কিছু দেখতে ও শিখতে।
তাজুল ইসলামের স্ত্রী ফেরদৌসী আরা জানান, তার স্বামী হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ২০১৬ সালে ওপেন হার্ট সার্জারি করান, তারপর থেকে তিনি তার স্বামীকে দ্রুত সুস্থ করে তোলার জন্য সর্বদা সেবাযত্ন করেন। ২০২২ সালে তিনি চাকরিও ছেড়ে দেন। তার স্বামীর খুব ইচ্ছা ছিল যে, তারা দু'জন যতদিন বাঁচবেন, বাংলাদেশের ৬৪ জেলা মোটরসাইকেল নিয়ে ঘুরে দেখবেন। দীর্ঘ সময় তার স্বামীর মোটরসাইকেলের পেছনে বসে থেকে কোনো সমস্যা হয়নি, একসাথে হাসাহাসি করে সময় পার করেছেন, কখনো খারাপ লাগেনি। বরং তার সঙ্গী হয়ে ৬৪ জেলা ঘুরে বেড়াতে পেরে তিনি ধন্য।
তাজুল ইসলাম দেখিয়ে দিয়েছেন, বয়স বা শারীরিক অসুস্থতা সব সময় বাধা নয়। সাহস, ইচ্ছাশক্তি আর চলার মানসিকতা থাকলে মানুষ অনেক দূর যেতে পারে। একজন শিক্ষক হয়েও তিনি যা করেছেন, তা শুধু অনুপ্রেরণার নয়, বিশ্বাসের গল্প। জীবন চলার পথে এমন মানুষগুলো আমাদের মনে করিয়ে দেন চাইলেই পথ তৈরি হয়।
সর্বশেষ খবর
এক্সক্লুসিভ এর সর্বশেষ খবর