
মোঃ আবু বকর সিদ্দিক: বাংলাদেশের অন্যতম সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক কেন্দ্র ময়মনসিংহ শহর, যা ব্রিটিশ আমলের জমিদারি, শিক্ষা আন্দোলন এবং সাহিত্য-সংস্কৃতির ধারায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। শহরের বিভিন্ন সড়কনাম ও স্থাপনা—যেমন শশীকান্ত রোড, রানীমার লেন কিংবা হরিকিশোর রায় রোড—এখনো বহন করে সেই ঐতিহ্যের চিহ্ন। এই শহরেই শৈশব কাটিয়েছিলেন উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী, যিনি পরবর্তীতে বাংলা শিশু সাহিত্যের অগ্রদূত হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন এবং সাহিত্যিক, প্রকাশক ও সম্পাদক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। তার পৌত্র সত্যজিৎ রায় জন্মগ্রহণ করেন ও বেড়ে ওঠেন কলকাতায় এবং পেশাগত জীবনও কাটে সেখানেই। তার পূর্বপুরুষদের কিছু সময়ের জন্য ময়মনসিংহে বসবাস থাকলেও তাঁর নিজের কোনো প্রত্যক্ষ সংযোগ ছিল না। ফলে সাম্প্রতিক সময়ে একটি পরিত্যক্ত সরকারি ভবন ভাঙাকে কেন্দ্র করে তার নামকে ভুলভাবে জড়িয়ে যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে, তা ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও প্রমাণ-ভিত্তিক বিশ্লেষণ ছাড়া গ্রহণযোগ্য নয়।
সত্যজিৎ রায়ের পূর্বপুরুষদের ইতিহাস শুরু হয় ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলা থেকে, যখন তার অষ্টম পুরুষ রামসুন্দর দেব বৈবাহিক সূত্রে চলে আসেন বর্তমান বাংলাদেশের শেরপুর জেলার যশোদলে। তার শ্বশুর ছিলেন তৎকালীন শেরপুর অঞ্চলের জমিদার গুণীচন্দ্র। জামাতা হিসেবে রামসুন্দর দেব শ্বশুরের জমিদারির দেখভাল শুরু করেন এবং ক্রমে নিজস্ব জমিদারিও বিস্তৃত করেন ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোনা জেলায়। তিনি ও তার উত্তরসূরিরা ‘দেও’ বা ‘দেব’ পদবিতে পরিচিত ছিলেন।
১৮৫০–১৯০০ সালের মধ্যে তাদের জমিদারির পরিধি প্রায় ৩০–৪০ হাজার বিঘা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল বলে জানা যায়, যার মধ্যে কিশোরগঞ্জের মসুয়া, বাজিতপুর, ময়মনসিংহের ফুলপুর এবং নেত্রকোনার আটপাড়া এলাকা অন্তর্ভুক্ত ছিল। রামসুন্দর দেবের তৃতীয় প্রজন্ম রমাকান্ত দেব কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদী উপজেলার মসুয়া গ্রামে একটি জমিদারবাড়ি নির্মাণ করেন এবং পরিবার নিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। এই জমিদার বাড়িটিই ছিল উপেন্দ্রকিশোর রায়ের পৈতৃক নিবাস ও জন্মস্থান।
উপেন্দ্রকিশোর রায়ের আসল নাম ছিল কামদারঞ্জন দেব। তাঁর পিতা কালীনাথ দেব ছিলেন রমাকান্তের পুত্র, যিনি তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ময়মনসিংহ শহরের ধনাঢ্য ব্যক্তি হরিকিশোর রায়ের কাছে পুত্র কামদারঞ্জনকে দত্তক দেন। দত্তক নেওয়ার পর কামদারঞ্জনের নাম রাখা হয় “উপেন্দ্রকিশোর রায়”। এই দত্তকপুত্র উপেন্দ্রকিশোর ও হরিকিশোর রায়ের নিজের পুত্র নরেন্দ্রকিশোর মিলে ছিলেন ওই পরিবারের দুই উত্তরাধিকারী, যাঁদের মধ্যে হরিকিশোর তার সম্পত্তি বণ্টন করে দেন।
উপেন্দ্রকিশোর তাঁর শৈশব কাটান ময়মনসিংহ শহরের ‘হরিকিশোর রায় রোড’-এর একটি ঐতিহ্যবাহী বাড়িতে, যা পরবর্তীতে তাঁর স্ত্রীর নামানুসারে পরিচিত হয় ‘পূর্ব্যলক্ষ্মী ভবন’ নামে। এই বাড়ি ছিল হরিকিশোর রায় রোডের তৃতীয় লেনে, শাহী জামে মসজিদ ও বর্তমানে প্রতিষ্ঠিত দুর্লভ ডালিয়া টাওয়ারের নিকটবর্তী। এখান থেকেই উপেন্দ্রকিশোর রায় পড়াশোনা করেন ময়মনসিংহ জিলা স্কুলে এবং ১৮৭৯ সালে তিনি কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। উল্লেখযোগ্য যে, উপেন্দ্রকিশোর ছিলেন ময়মনসিংহ জিলা স্কুলের অন্যতম সেরা ছাত্রদের একজন, এবং সেসময়ে পাশের হার ছিল মাত্র ১৫%–২০%।
১৯৪৮ সালে পূর্নলক্ষ্মী ভবনটি বিক্রি করে দেওয়া হয়। ঐতিহাসিক সূত্র অনুযায়ী, ভবনটি ক্রয় করেন মুমিনুন্নিসা কলেজের প্রতিষ্ঠাতা দুর্লভ খানের পুত্র, যিনি প্রথমে সেটি পুনর্গঠিত করে ‘দুর্লভ ভবন’ নামে পরিচিত করে তোলেন। ১৯৫৩–২০১২ সাল পর্যন্ত ভবনটি তিনতলা আধা-পাকা রূপে ব্যবহৃত হয় এবং ২০১২ সালে এটি গুঁড়িয়ে সেখানে নির্মিত হয় আধুনিক ১৪তলা ‘দুর্লভ ডালিয়া টাওয়ার’।
এদিকে হরিকিশোর রায় রোডের প্রথম লেনে অবস্থিত অন্য একটি পুরনো ভবন ঘিরেই মূল বিভ্রান্তির সূত্রপাত। উক্ত ভবনটি ১৮৯০ সালের আশপাশে নির্মিত হয়, যা জমিদার শশীকান্ত আচার্য্যের কর্মচারীদের জন্য ব্যবহৃত হতো। পরে টাঙ্গাইল জেলার মির্জাপুরের দানবীর রণদাপ্রসাদ সাহা জমিদার শশীকান্তের কাছে কয়লা-ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য এই ভবনটি ও আশপাশের জমি ব্যবহারের অনুমতি নেন। এখানে ‘Old DC Power Station’ নামে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয় ১৯২০-এর দশকের শেষ দিকে, যা পরবর্তীকালে ১৯৬৫ সালে East Pakistan Power Board নামে পরিচিত হয়।
১৯৭১ সালে রণদাপ্রসাদ সাহার মৃত্যুর পর ভবনটি অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে সরকার অধিগ্রহণ করে এবং পরবর্তী সময়ে জেলা পরিষদের সচিবদের বাসভবন হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ১৯৮৭ সালে ভবনটি বাংলাদেশ শিশু একাডেমির নামে বরাদ্দ দেওয়া হয়। ২০০৭ সালে এটি ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয় এবং ২০১০ সালে ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে লিজ প্রস্তাব অনুমোদন পাওয়ার পর, ২০১২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি জেলা প্রশাসনের সঙ্গে শিশু একাডেমির মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি লিজ চুক্তি (দলিল নং ১৪১৬) সম্পাদিত হয়।
এর আগেই, ২০০৯–২০১০ সালে ফরাসি স্থাপত্য সংরক্ষণ বিশেষজ্ঞ রোমেইন লাচারের নেতৃত্বে ময়মনসিংহ শহরের একটি আন্তর্জাতিক প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ পরিচালিত হয়, যা ছিল জার্মানির অর্থায়নে এবং স্থানীয় পৌরসভার সহায়তায়। এই জরিপে শহরের ২৮০টি প্রত্নসম্পদকে তিনটি ক্যাটাগরিতে শ্রেণিবিন্যাস করা হয়। প্রথম ক্যাটাগরিতে রাখা হয় শশীলজ, আলেকজান্ডার ক্যাসেলসহ ছয়টি ভবন; দ্বিতীয় ক্যাটাগরিতে রাখা হয় ৫৪টি ভবন, যার মধ্যে শিশু একাডেমির বর্তমান ভবনটিও অন্তর্ভুক্ত ছিল। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, দ্বিতীয় ক্যাটাগরির ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হলেও ভাঙা উচিত নয়, বরং সংরক্ষণের চেষ্টা করা উচিত।
তবে বাস্তবতা ভিন্ন। শিশু একাডেমির ভবনটি একদিকে জরাজীর্ণ ও পরিত্যক্ত, অন্যদিকে তার স্থাপত্য ঐতিহ্য বিষয়ে পর্যাপ্ত জনসচেতনতা বা সংরক্ষণ তৎপরতা গড়ে ওঠেনি। অবশেষে ২০২৪ সালে ময়মনসিংহ জেলা কনডেমনেশন কমিটির সুপারিশে ভবনটি ভাঙার প্রক্রিয়া শুরু হয়।
মূল বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়—উপেন্দ্রকিশোরের শৈশবকালীন বসতভিটা (পূর্ণলক্ষ্মী ভবন) এবং শিশু একাডেমির বর্তমান ভবন—দু’টিই একই রোডে (হরিকিশোর রায় রোড) অবস্থিত হওয়ায়। স্থানিক সাদৃশ্য, নামের মিল, এবং দত্তকসূত্রে পারিবারিক ইতিহাস জানার ঘাটতি—সব মিলিয়ে জনমনে ধারণা গড়ে ওঠে যে এই ভবনই সত্যজিৎ রায়ের পারিবারিক ভিটে।
কিন্তু প্রত্নতত্ত্ব গবেষক স্বপন ধরসহ একাধিক স্থানীয় ইতিহাসবিদের মতে, বাংলাদেশ শিশু একাডেমির বরাদ্দপ্রাপ্ত ভবনটি রায় পরিবারের সঙ্গে কোনোভাবেই সম্পৃক্ত নয়। এটি মূলত জমিদার শশীকান্ত আচার্য্যের পুত্রদের দ্বারা নির্মিত এবং পরবর্তীকালে রণদাপ্রসাদ সাহার ব্যবহারে দেওয়া হয়। ১৯৭১ সালে রণদাপ্রসাদ সাহার মৃত্যুর পর ভবনটি সরকারের নিয়ন্ত্রণে আসে।
অন্যদিকে, পূর্ণলক্ষ্মী ভবনের কোনো ভৌত চিহ্ন আর অবশিষ্ট নেই। বর্তমানে সেটি আধুনিক বাণিজ্যিক ভবনে পরিণত হলেও ইতিহাস-ভিত্তিক দলিল, নকশা ও মৌখিক স্মৃতির মাধ্যমে তার পূর্ববর্তী পরিচয় সংরক্ষিত রয়েছে। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের কাছে এই সম্পর্কিত স্থাপনা বা স্থায়ী শনাক্তকরণের কোনো রেকর্ডও নেই, যা এই বিভ্রান্তিকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
এই দ্বৈত ইতিহাস এবং স্থানিক মিলের কারণে যেভাবে একটি ভুল ধারণা গড়ে উঠেছে, তা প্রমাণ করে—ইতিহাস বুঝতে হলে শুধু নাম বা স্থান নয়, জানতে হয় উৎস, প্রেক্ষাপট ও দলিলসমূহের নিরীক্ষা। নয়তো ভুল তথ্য আবেগকে উসকে দিয়ে সত্যকে আড়াল করে দেয়।
এই ঘটনাটি আমাদের সামনে এক গভীর প্রশ্ন তোলে—ইতিহাস আমরা কীভাবে মনে রাখি? নাম দিয়ে? রাস্তার পরিচয়ে? না কি সত্য-নির্ভর প্রামাণ্য চর্চায়?
সত্যজিৎ রায়ের নাম যেমন আমাদের গর্ব, তেমনি তাঁর উত্তরাধিকার রক্ষা করাও আমাদের দায়িত্ব। তবে সেটি যেন হয় সত্যকে ভিত্তি করে, আবেগ বা বিভ্রান্তিকে নয়। নয়তো একটি নাম থাকবে, কিন্তু তার ইতিহাস হারিয়ে যাবে ভুল ব্যাখ্যার ধুলিঝড়ে।
সর্বশেষ খবর
অন্যান্য... এর সর্বশেষ খবর