
কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার হ্নীলা ইউনিয়নের পানখানী এলাকায় একসময় দিনমজুর হিসেবে কাজ করা মোস্তাক, যিনি নিজেকে 'ডিবি মোস্তাক' হিসেবে পরিচয় দিয়ে আসছিলেন, তাকে র্যাব আটক করেছে বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে। কোনো পদ বা সরকারি নিয়োগ ছাড়াই দীর্ঘদিন ধরে তিনি নিজেকে পুলিশ ও র্যাবের সোর্স হিসেবে পরিচয় দিয়ে মাদকের দালালি এবং অপরাধের এক অঘোষিত সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন।
সাম্প্রতিক অনুসন্ধান ও স্থানীয়দের তথ্যানুসারে, মোস্তাকের বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুললেই ইয়াবা বা অস্ত্র মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়ার ভয় দেখাতেন তিনি। স্থানীয় প্রশাসন সবকিছু জানলেও এতদিন নীরব ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে।
মোস্তাক হ্নীলা ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের এক দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা কালা মিয়া ছিলেন মাটিকাটা শ্রমিক। মোস্তাকের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না এবং তিনি একসময় ট্রলি চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন। পরবর্তীতে নিজেকে 'ডিবি পুলিশের সোর্স' হিসেবে পরিচয় দিতে শুরু করেন এবং র্যাব ক্যাম্পে নিয়মিত যাতায়াত শুরু করেন। টেকনাফ থানার তৎকালীন ওসি প্রদীপ কুমার দাশের সময়ে তিনি আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন এবং প্রদীপের তল্পিবাহক হিসেবে চাঁদাবাজি, ভয়ভীতি প্রদর্শন ও মাদক সংশ্লিষ্টতা দিয়ে এলাকার মানুষকে দমন করতেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
এলাকাবাসীর ভাষ্যমতে, র্যাব বা পুলিশের যেকোনো অভিযানে মোস্তাক অস্ত্র হাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের পাশে থাকতেন, নিজেকে প্রশাসনের অংশ হিসেবে তুলে ধরতেন। এর মাধ্যমে তিনি প্রশাসনের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক আছে বলে প্রচার করেন এবং অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠেন।
সূত্রমতে, 'ডিবি মোস্তাক' শুধু একজন ব্যক্তি নন, এটি একটি ভয়ঙ্কর গডফাদারসুলভ চক্রের প্রতীক। অভিযোগ আছে, যে মাদক কারবারিরা মোস্তাকের 'চ্যানেল' ব্যবহার করে ইয়াবা পাচার করে, তারা নিরাপদ থাকে। তবে কেউ তার সঙ্গে বিরোধে জড়ালে তাকে অস্ত্র বা মাদকের মামলায় ফাঁসানো হয়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, কক্সবাজার সদরসহ দেশের একাধিক থানায় মোস্তাকের বিরুদ্ধে মাদক সংশ্লিষ্ট একাধিক মামলা রয়েছে, তবে কোনো মামলাতেই তিনি দোষী সাব্যস্ত হননি। এক সময়ের দরিদ্র ট্রলি চালক মোস্তাক বর্তমানে একাধিক ডাম্পার ট্রাক, নোহা মাইক্রোবাস, রেঞ্জ রোভার জিপ এবং দুটি দামি মোটরসাইকেলের মালিক। পানখানী এলাকায় তার নির্মিত ডুপ্লেক্স বাড়িটির মূল্য ৭০ লাখ টাকা বলে স্থানীয় সূত্র জানালেও মোস্তাক দাবি করেন, সেটি ৩০ লাখে কিনেছেন। তার নামে এবং স্ত্রী সানজিদা আক্তারের নামে ৫ থেকে ১২ একর জমি রয়েছে। এবি ব্যাংকের কক্সবাজার শাখায় স্ত্রীর নামে কোটি টাকারও বেশি স্থায়ী আমানত রয়েছে। স্থানীয়ভাবে প্রচার আছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক সদস্যের সঙ্গে তার গোপন আর্থিক সম্পর্ক রয়েছে।
স্থানীয়দের ভাষ্য অনুযায়ী, মোস্তাকের বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুললেই বিপদে পড়ে। একজন নারী বলেন, এই লোকের নামে কেউ একটা কথাও বললে রাতারাতি ডিবি ধরে নিয়ে যায়। অথচ সে নিজেই ইয়াবা কারবারির দালাল। আরেকজন সাবেক জনপ্রতিনিধি বলেন, মোস্তাক এখন শুধু একজন ব্যক্তি নয়, একটি আতঙ্কের নাম। তার টাকার উৎস যেমন রহস্যময়, তেমনি প্রশাসনের নীরবতা আরও ভয়ঙ্কর।
প্রশাসনের একটি অংশ জানিয়েছে, 'ডিবি মোস্তাক' নামে তাদের কোনো স্বীকৃত সোর্স নেই। তাহলে কোন ক্ষমতা বলে তিনি নিজেকে ডিবি ও র্যাবের সোর্স দাবি করে এলাকায় ত্রাস সৃষ্টি করতেন, সে বিষয়ে তারা নিশ্চিত নন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মোস্তাক বলেন, একজন অফিসার উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে আমার বিরুদ্ধে মাদক মামলা দিয়েছিল। ডাম্পার ও নোহা আমার মালিকানায় রয়েছে- এটা সত্যি। তবে বাড়িটা ৭০ লাখ নয়, ৩০ লাখ টাকায় কিনেছি। এসব আমি বৈধভাবে গাড়ির ব্যবসা করে অর্জন করেছি।
র্যাবের একটি বিশেষ টিম অভিযানে নেমে তাকে গ্রেফতার করেছে। স্থানীয়দের প্রত্যাশা, তার সম্পদের উৎস, মাদকের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা এবং ছদ্মপরিচয়ের অপব্যবহার- সবকিছুর পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত হবে। এই গ্রেফতার যেন প্রশাসনের জন্য একটি শিক্ষা হয়, এবং 'সোর্সের পরিচয়ে অপরাধের রক্ষাকবচ' তৈরি যেন আর কেউ করতে না পারে – এই দাবি এখন পুরো টেকনাফবাসীর।
সর্বশেষ খবর