
নুরুল আমিন (৪৩) বসতভিটা থেকে প্রায় ৩ মিটার দূরে চলে এসেছে বাঁকখালী নদীর ভাঙন। যেকোনো সময় তার বসতভিটা নদীতে বিলীন হতে পারে। এই দুশ্চিন্তায় গত কয়েকদিন থেকেই নির্ঘুম রাত কাটছে পরিবারের ৬ সদস্যের। গত এক মাসে নদীভাঙনে তার ২ বিঘা আবাদি জমি চলে গেছে বাঁকখালীর পেটে।
কক্সবাজারের রামু উপজেলার কচ্ছপিয়া ও উত্তরকুল পূর্ব পাড়ার গ্রামের নুরুল আমিনের মতোই নির্ঘুম রাত কাটছে বৃদ্ধ সোলাইমান (৬৪) ও তার পরিবারের ৪ সদস্যের। সোলাইমানের বসতভিটা থেকে বাঁকখালী নদীর ভাঙনের দূরত্ব এখন ৪ মিটার।
কৃষক সোলাইমান গত গঙ্গলবার বিকেলে প্রতিবেদককে জানান, তার জীবনে ৭ বার বসতভিটা হারিয়েছেন বাঁকখালী নদীর ভাঙনে। এখন এই বসতভিটায় বসবাস করছেন গেল ১৩ বছর ধরে। এ বসতভিটাও বাঁকখালীর পেটে চলে যেতে পারে যেকোনো সময়।
তিনি কান্না জড়িত কন্ঠে বলেন, নদীভাঙনে বসতভিটা বিলীন হওয়ার ভয়ে রাতে ঘুমাতে পারছি না। এ বসতভিটা নদীর উদরে চলে গেলে ভূমিহীন ও গৃহহীন হয়ে পড়ব। চরম দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে বাঁচতে হবে আমাদের। একই আতংক রামুর দক্ষিণ মিঠাছড়ি, রাজারকুল, চাকমারকুল ও ফতেখাঁরকুলসহ অন্তত পাঁচ ইউনিয়নের কয়েক হাজার পরিবারের।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রামু থেকে কক্সবাজার সদর উপজেলা হয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশেছে বাঁকখালী নদী। এক সময়ের জীবনদাতা এই নদীই এখন হয়ে উঠেছে মানুষের দুঃস্বপ্ন। চলতি বর্ষায় নদীটির রামু অংশে ভয়াবহ ভাঙন দেখা দিয়েছে। ইতোমধ্যে গর্জনিয়া ও কচ্ছপিয়ার বিস্তীর্ণ জনপদ নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। ভাঙনের মুখে রয়েছে শত শত পরিবার, শতবর্ষী মসজিদ, কবরস্থান, ফসলি জমি ও বিদ্যালয়।
স্থানীয়দের অভিযোগ, নদী থেকে অনিয়ন্ত্রিতভাবে বালু উত্তোলন করায় বাঁকখালীর গতিপথ বদলে গেছে। সেই সঙ্গে গত কয়েক বছরের অবহেলা ও অনিয়মিত নজরদারিতেও বেড়েছে ভাঙনের মাত্রা।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, এলজিইডির নির্মিত সড়ক ও পাশের একটি শত বছরের পুরনো মসজিদের অর্ধেক ইতোমধ্যেই নদীতে তলিয়ে গেছে। স্থানীয়দের দাবি, মসজিদটি রক্ষায় কোনো উদ্যোগ না নেওয়া হলে অচিরেই সেটিও ইতিহাস হয়ে যাবে।
গর্জনিয়ার থোয়াঙ্গারকাটা, মাঝিরকাটা, ক্যাজরবিল এলাকার বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে নদীর পেটে তলিয়ে গেছে একের পর এক বসতঘর। মানুষজন তাদের ঘরের আসবাব, দরজা-জানালা খুলে নিয়ে অন্যত্র আশ্রয়ের জন্য ছোটাছুটি করছে।
দীর্ঘদিন ধরেই কচ্ছপিয়া ইউনিয়নের উত্তরকুল ও পূর্বপাড়ায় দোছড়ি খালের ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু চলতি বর্ষায় তা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। তলিয়ে গেছে বহু ঘরবাড়ি, চলাচলের সড়ক, ফসলি জমি।
গর্জনিয়া দোছড়ির বাসিন্দা মাস্টার আমীর হোসাইন অসহায়ের মতো বলেন, বাড়ির সামনে এলজিইডির নির্মিত সড়ক ছিল। এখন কিছুই নেই। নদীর স্রোত আর অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের কারণে সড়কটাই নদীতে চলে গেছে। এখন আমার বাড়িও যে কোনো সময় বিলীন হয়ে যাবে।
ক্যাজরবিল এলাকার হাজী হাবিব উল্লাহ বলেন, জীবনের সব সঞ্চয় দিয়ে এই বাড়ি করেছিলাম। এখন কিছুই নেই। ঘর নদীতে চলে গেছে। আশেপাশের লোকজন কেউ খেতে পারছে না, কেউ ঘুমাতে পারছে না। চোখের সামনে স্বপ্নগুলো নদীতে তলিয়ে যাচ্ছে।
কচ্ছপিয়া ইউনিয়নের দোছড়ি এলাকার বাসিন্দা আবুল হাশেম বলেন, আগে উঠানে দাঁড়িয়ে নদী দেখা যেতো। এখন নদী এসে উঠানে দাঁড়িয়েছে। আমরা নিজ খরচে বালু ভর্তি বস্তা ফেলে কোনো রকমে ঠেকিয়ে রেখেছি। কিন্তু কয়দিন পারব?
স্থানীয় বাসিন্দা জাকের হোছাইন বলেন, আমরা অনেকবার জনপ্রতিনিধি, উপজেলা প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ডকে জানিয়েছি। সবাই আশ্বাস দেয়, কাজের কাজ কিছু হয় না। এখন নদী যদি আর এক হাত এগোয়, আমার পুরো বাড়িটাই শেষ।
গর্জনিয়া ইউনিয়নের ক্যাজরবিল গ্রামের ৬৫ বছর বয়সী ফজল আহমদ চোখের পানি মুছতে মুছতে বলেন, আমার বাবার কবরটা ছিল বাড়ির সীমানায়। সকালে দেখি কবরটা নেই। সব নদীতে গেছে। এমন কষ্ট জীবনেও দেখিনি।
ক্যাজরবিল এলাকায় এখনো গা ছমছমে পরিস্থিতি। একদিন আগেও যেখানে শিশুরা খেলত, নারীরা উঠানে বসে মাছ কাটতো, আজ সেখানে নদীর গর্জন আর পানির ধ্বংসযজ্ঞ। এলাকা জুড়ে আতঙ্ক, দুশ্চিন্তা আর অসহায় মানুষের দীর্ঘশ্বাস।
স্থানীয় বাসিন্দা আমিনুল ইসলাম বলেন, রাতে বউ-বাচ্চা নিয়ে জেগে থাকি। ঘরের এক কোনায় বসে থাকি। মনে হয়, এখনই হয়তো ধ্বসে পড়বে, নদীতে পড়ে যাব।
গর্জনিয়ার থোয়াঙ্গারকাটা, মাঝিরকাটা, ক্যাজরবিল, দোছড়ি, মাস্টারপাড়া, পশ্চিমপাড়া- সবখানেই একই চিত্র। নদীভাঙনের কারণে ইতোমধ্যে বিলীন হয়েছে এলজিইডির নির্মিত পাকা সড়ক, শতবর্ষী একটি মসজিদ, বেশ কয়েকটি কবরস্থান, বাড়িঘর ও ফলের বাগান।
কচ্ছপিয়া ইউনিয়নের তৈয়ব উল্লাহ বলেন, নদী থেকে বালু তোলে একশ্রেণির অসাধু লোকজন। প্রশাসন চোখ বুজে থাকে। অথচ এই অপরিকল্পিত বালু তোলাই এখন আমাদের সর্বনাশ ডেকে এনেছে।
দোছড়ি এলাকার বাসিন্দা আবুল হাশেম জানান, বাড়ির উঠান নদীতে চলে গেছে। এখন ঘরের দরজা খুললেই নদী। আমরা নিজেরাই কিছু বালুর বস্তা ফেলে ঠেকানোর চেষ্টা করছি। কিন্তু তা কতদিন?
দোছড়ি, উত্তরকুল ও পূর্বপাড়ার স্থানীয়রা বলেন, এই ভাঙনের তোড় যদি এমন চলতে থাকে, তাহলে এই বর্ষা শেষ হতে না হতেই তাদের বসতবাড়ি, মসজিদ ও মাদ্রাসাসহ পুরো জনপদ নদীতে মিশে যাবে।
তাদের দাবি, দ্রুত অস্থায়ী প্রতিরোধ ব্যবস্থা, স্থায়ী টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ, বাস্তুচ্যুতদের জন্য পুনর্বাসন, অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধে অভিযান।
কচ্ছপিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবু মো. ঈসমাইল নোমান জানান, আমরা বারবার পানি উন্নয়ন বোর্ডকে জানিয়েছি। তারা এসেছে, পরিদর্শনও করেছে। কিন্তু কাজ শুরু হয়নি। প্রতিবার বর্ষায় মানুষ সর্বস্ব হারায়, আমরা শুধু আশ্বাস নিয়ে বসে থাকি।
রামু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রাশেদুল ইসলাম বলেন, ভাঙন পরিস্থিতি খুবই উদ্বেগজনক। আমরা পানি উন্নয়ন বোর্ডকে জানানো হয়েছে। তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। আশা করছি, অচিরেই পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. নুরুল ইসলাম জানান, ভাঙনের তথ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। অনুমোদন পেলে অন্তত অস্থায়ী প্রতিরোধ ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হবে।
কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মো. সালাহ উদ্দিন আহমদ বলেন, পরিদর্শন করা হয়েছে। কিন্তু আপাতত অর্থ সংকটে কাজ করা যাচ্ছে না। প্রকল্প অনুমোদন হলে কাজ শুরু হবে।
বাঁকখালী নদীর ভাঙন কেবল একটি নদীতীরবর্তী গ্রামের সমস্যা নয়। এটি প্রশাসনের দীর্ঘদিনের অবহেলা, পরিকল্পনাহীন উন্নয়ন এবং দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবস্থাপনার প্রতিচ্ছবি। এই ভাঙন যদি এখনই রোধ না করা হয়, তাহলে আগামী প্রজন্ম শুধু স্মৃতির গল্প শুনবে- এখানে একসময় গ্রাম ছিল, মসজিদ ছিল, মানুষ ছিল। এমনটাই মনে করছেন সচেতন মহল।
সালাউদ্দিন/সাএ
সর্বশেষ খবর
জেলার খবর এর সর্বশেষ খবর